চর্যাগীতির পরবর্তী পদগান অষ্টপদী বা গীতগোবিন্দ প্রবন্ধশ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত-এবং এইকথা কবি জয়দেবও নিজে স্বীকার করে বলেছেন ঃ “শ্রীবাসুদেবরতিকেলিকথাসমেনমেতং করোতি জয়দেবকবিঃ প্রবন্ধম্‌” (১ম সর্গ, ২য় শ্লোক)৷ “বালবোধিনী” টীকাকার পূজারী গোস্বামীও সেইকথার প্রতিধ্বনি করে বলেছেন ঃ “এতৎ শ্রীগীতগোবিন্দাখ্যা প্রবন্ধং প্রকর্ষেণ বাধ্যতে শ্রোতৃণাং হৃদয়মস্মিন্নিতি প্রবন্ধস্তং করোতি প্রকাশয়তি” ৷ অবশ্য গীতগোবিন্দগানের আলোচনার সময়ে এইসম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো৷ পূর্বেই বলেছি যে, পদাবলীকীর্তনের গীতিরূপ ও গীতশৈলীর যথাযথ আলোচনা করতে হলে খ্রীষ্টীয় শতকের প্রথম থেকে ১৫শ-১৬শ শতকের বাংলাসাহিত্যে গাথা, গীতিরূপ ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ধারা এবং পরিবেশের আমাদের কিছুটা অনুশীলন করা উচিত, কেননা দীর্ঘ সময় ব্যবধানের মধ্যে যতগুলি পদসাহিত্য, গীতিরূপ ও কাব্যসম্ভারের সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে –তারাই বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনে যথেষ্ট পরিমাণে উপাদান ও প্রেরণা যুগিয়েছে৷
চর্যা ও গীতগোবিন্দ-পদগানের “পদ”-শব্দটি আবার বিশেষ অর্থবোধক ৷ আমরা খ্রীষ্টীয় ৭ম থেকে ১৪শ শতকের মধ্যে রচিত সঙ্গীতশাস্ত্রগুলি থেকে জানতে পারি যে, “পদ”-শব্দটি প্রবন্ধ বা প্রবন্ধগানের একটি অঙ্গবিশেষ৷ পার্শ্বদেব শার্ঙ্গদের ও অন্যান্য সঙ্গীতশাস্ত্রীরা প্রবন্ধের অপরিহার্য “পদ”-অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সকল শ্রেণীর গান বা গীতিরূপকেই প্রবন্ধগানের পর্যায়ভুক্ত বলেছেন৷ সেদিক থেকে চর্যা, ব্রজ, গীতগোবিন্দ প্রভৃতি গীতি বা গানগুলি প্রবন্ধশ্রেণীরই অন্তর্ভূক্ত৷ ১৩শ শতকের সঙ্গীতশাস্ত্রী শার্ঙ্গদেব, ১৭শ শতকের সঙ্গীতশাস্ত্রী তাঞ্জোরের রঘুনাথ নায়ক ও দক্ষিণ-ভারতের পণ্ডিত বেঙ্কটমখী “সঙ্গীত-রত্নাকর”, “সঙ্গীতসুধা” ও “চতুর্দণ্ডীপ্রকাশিকা” গ্রন্থগুলিতে চর্যাকে নিঃশংসয়ে প্রবন্ধগীতির পর্যায়ভুক্ত বলেছেন ৷ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, শার্ঙ্গদেব প্রবন্ধাধ্যায়ে বলেছেন ঃ “অধ্যাত্মগোচরা চর্যা”(২.২৯৬) , অর্থাৎ চর্যাগীতি অধ্যাত্মপ্রকৃতির পরিচায়ক৷ শার্ঙ্গদেব সঙ্গীত-রত্নাকরের চতুর্থ অধ্যায়ে বিপ্রকীর্ণপ্রবন্ধের প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “বদনং চর্চ্চরী চর্যা পদ্ধডী রাহুডী তথা”(৪.৩২)৷ শার্ঙ্গদেবের মতো ত্রিপদী, চতুষ্পদী, ষট্‌পদী, চতুর্মুখ, হংসীলীল, চর্চরী, মঙ্গল, ধবল প্রভৃতির মতো চর্যাও প্রবন্ধগান৷ চর্যার প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক গীতিরূপ ও গীতিশৈলী সম্ভবতঃ সহজ সাধারণ হলেও সাধক শিল্পীদের সৃষ্টিপ্রতিভায় ক্রমশঃ তা প্রবন্ধরূপ পরিগ্রহ করেছিল৷ শার্ঙ্গদেব চর্যাগীতির সঠিক রূপ,প্রকৃতি ও গায়নশৈলীর পরিচয় দিয়ে যা বলেছেন তার পরিচয় আমরা পূর্বেই দিয়েছি৷ মোটকথা পদ্ধডী, রাহুডী প্রভৃতি প্রধান ছন্দে চর্যাপদ রচিত হত এবং তাতে দ্বিতীয়াদি তালের সমাবেশ থাকত (এদের বিশেষ পরিচয় সঙ্গীত-রত্নাকরে দেওয়া আছে)৷ সাধারণতঃ সেই গান বা গীত ছিল দু”রকম ঃ ছন্দপ্রধান ও ছন্দ-অপ্রধান৷ ছন্দপ্রধান হলে তাকে বলা হত “পূর্ণ” এবং ছন্দের প্রাধান্য না থাকলে বলা হত “অপূর্ণ” ৷ তারা ছিল আবার সমধ্রুবা ও অসমধ্রুবা-রূপে দুইভাগে বিভক্ত৷ সমধ্রুবায় গানে সমগ্র পদের আবৃত্তি করা হত, আর কেবল ধ্রুবাংশটি আবৃত্তি করে গাওয়া হলে তাকে বলা হত অসম বা বিষমধ্রুবা চর্যার ধ্রুব ও উদ্‌গ্রাহ ধাতু দুটি যখন উদ্‌গ্রাহধাতু অপেক্ষা ধ্রুবধাতুর (“ধ্রুব”-শব্দটি বিচিত্র অর্থবোধক৷ ধ্রুবপদ বা গানের ধাতু, অংশ বা ভাগ৷ ধ্রুব প্রবন্ধ-হিসাবে ধ্রুবপদপ্রবন্ধ বা ধ্রুপদ৷ ধ্রুবপ্রবন্ধ ধ্রুবপদ (ধ্রুপদ) শাস্ত্রের দৃষ্টিতে সালগ-সূড় শ্রেণীর৷ নাট্যশাস্ত্রে “ধ্রুবা”-নাট্যগীতির পরিচয় আছে৷ প্রাচীন নাটকে জাতিরাগের সঙ্গে ছন্দ, অক্ষর, তাল প্রভৃতি সম্পৃক্ত হয়ে নাট্যগীতি ধ্রুবার ব্যবহার হত৷ তবে মনে রাখতে হবে যে, নাট্যগীতি ধ্রুবা ও ধ্রুবাপ্রবন্ধ জাতিতে ও শ্রেণীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ অনেকেই নাট্যগীতি ধ্রুবাকে ধ্রুবপ্রবন্ধের সমগোত্রীয় বলে ভুল করেন৷ আসলে নাট্যবধ্রুবা প্রবন্ধজাতীয় ধ্রুবপদ বা ধ্রূপদ থেকে পৃথক৷) প্রয়োগ কম হত তখন তাকে বলা হত বিষমধ্রুবাজাতীয় চর্যা৷ চতুর্থ অভোগধাতুকে পৃথকভাবেই ব্যবহার করা হত৷ উদ্‌গ্রাহক, ধ্রুব ও আভোগ এই তিন ধাতুর ব্যবহারে সমগ্র গান বা গীতির প্রকাশ হত বলে চর্যাপদকে (চর্যাপ্রবন্ধগানকে) “ত্রিধাতুক” বলা হত৷ ত্রিধাতুক চর্যায় মেলাপকধাতুর ব্যবহার হত না৷ অনেক সময় মেলাপক ও আভোগকে বাদ দিয়ে মাত্র উদ্‌গ্রাহ ও ধ্রুব এই দুটি ধাতুতেই চর্যাগীতি গান করা হত৷ পদ ও তাল এই দুটি অঙ্গযুক্ত বলে চর্যাকে বলা হত তারাবলীজাতীয় গান বা গীতি (“পদতালবদ্ধত্বাদ্দ্ব্যঙ্গস্তারাবলীজাতীমান্”) সেকথা পূর্বেই বলেছি৷
এ তো গেল চর্যার গঠন ও গায়নশৈলীর কথা, কিন্তু চর্যায় যে সকল রাগের ব্যবহার হত তাদের গঠন ও বিকাশধারার কথাও এখানে কিছুটা আলোচনা করা উচিত৷ প্রাচীন ভারতে রাগের গঠনপ্রকৃতি নির্ধারিত হত সাতটি স্বরসম্বন্ধ গ্রামকে নিয়ে৷ স্বরসম্বন্ধ গ্রাম ছিল তিনটি –ষড়্‌জ, গান্ধার ও মধ্যম৷ ঐ প্রচলিত রীতি বা ধারার মধ্যে এলো ক্রমে পরিবর্তন৷ রাগগুলির নিয়ামকরূপে দেখা দিল মূর্ছনা৷ মূর্ছনার মধ্যেও সাতটি স্বরের দেখি সজ্জা বা বিকাশ৷ প্রতিটি গ্রামে মূর্ছনা সাতটি করে,সুতরাং তিন গ্রামের মূর্ছনা সংখ্যা একুশটি৷ গ্রাম তিনটি, সুতরাং মূর্ছনার সংখ্যা একুশটি (৭ ×৩ = ২১) বলে বিচিত্র রাগগুলিকে নিয়মিত করার রীতি মূর্ছনার সংস্থান মাধ্যমেই প্রচলিত হল৷ ক্রমে মূর্ছনার স্থান অধিকার করলো “থাট” বা ঠাট শব্দ৷ “থাট”- শব্দটির ব্যবহার ১৭শ শতকের গোড়াকার দিকে পণ্ডিত সোমনাথের “রাগবিরোধ”-গ্রন্থে পাওয়া যায়৷ “ঠাট” পারসিক শব্দ৷ এই উভয়ের অর্থই “গটন” বা “কাঠামো”৷ গ্রাম ও মূর্ছনার মতো সাত স্বরের লীলায়ন থাকে থাটেও৷ সুতরাং ৯ম-১১শ শতকের বজ্র ও চর্যা-গানে যে ভৈরবী, গুর্জরী, বসন্ত, গুণক্রী প্রভৃতি শাস্ত্রীয় রাগের ব্যবহার ছিল সেগুলির একটি নির্দিষ্ট নিয়ামক (Standard) থাট অবশ্যই ছিল একথা সঙ্গীতশাস্ত্রীরা স্বীকার করেন৷ প্রাচীন ভারতে অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে ভারতীয় সঙ্গীতধারায় রাগের মূল-নিয়ামক বা নির্ধারক হিসাবে গ্রাম ও মূর্ছনা এই উভয়েরই প্রচলন ছিল৷ ভরত নাট্যশাস্ত্রে গ্রাম ও মূর্ছনার পরিচয় দিয়েছেন ৷ কিন্তু ভরতের সময়ে (খ্রীষ্টীয় ২য় শতকে ) (নাট্যশাস্ত্রকে অনেকে খৃষ্টপূর্ব যুগে রচিত বলেন৷ নাট্যশাস্ত্র রচনা করেন ভরত ৷ “ভরত” সংজ্ঞা একটি “পদবী” ও “ভরত” পদবী বা উপাধিকারী ভরত ছিল প্রায় পাঁচজন৷ বৃদ্ধ,কোহল, দত্তিল, মতঙ্গ প্রভৃতি শাস্ত্রকারদের উপাধিও ভরত ছিল। নাট্যশাস্ত্রকার ভরতকে তাই “মুনিভরত”-বলা হত৷) গ্রাম ছিল মাত্র দুইটি – ষড়্‌জ ও মধ্যম৷ নানান্‌ কারণে (সেই বিস্তৃত আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে) গান্ধারগ্রামের প্রচলন লোপ পেল৷ সুতরাং গান্ধারগ্রামের সাতটি মূর্ছনার বিলুপ্তিও ঐ সঙ্গে ঘটলো৷ খ্রীষ্টীয় ১ম শতকের গ্রন্থ নারদীশিক্ষায় (১ম নারদ-রচিত “শিক্ষাশাস্ত্রে”) গান্ধারগ্রামেরও সাতটি মূর্ছনার উল্লেখ আছে৷ অনেকের মতে, গ্রাম ও মূর্ছনা-সঙ্কটের জন্য তখন থেকেই এক ধরনের শুদ্ধথাটের প্রচলন হোল — যার স্বরবিকাশ ছিল বর্তমান কালের কাফীরাগের বা থাটের স্বরসজ্জার মতো৷ বিদ্যারণ্য মুনি-নির্দেশিত শুদ্ধথাট মুখারীর স্বররূপও অনেকটা তাই ছিল৷ তবে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নির্দিষ্ট কোন শুদ্ধথাটের উল্লেখ নেই৷ বলা যায় যে, আমাদের প্রাচীন রাগগুলিকে নিরূপণ বা নির্ধারণ করার সুবিধার জন্যই আমরা রাগ-নিয়ামক একটি শুদ্ধথাটের প্রচলন মেনে নিয়েছি এবং সেদিক থেকে খ্রীষ্টীয় ৯ম-১১ম শতকের প্রবন্ধশ্রেণীভুক্ত ব্রজ ও চর্যা-গীতিদুটির নির্দিষ্ট নিয়ামক-রূপে একটি শুদ্ধথাটের অস্তিত্বও কল্পনা করা অসমীচীন নয়৷ তার স্বরবিকাশ ছিল বর্তমান উত্তর-ভারতীয় সঙ্গীতপদ্ধতির কাফীরাগের বা থাটের অনুযায়ী৷ কিন্তু বর্তমানে বিলাবলকে আমরা রাগ-নিয়ামক শুদ্ধথাট বা বিবর্তনের জন্য বর্তমানে সকল রাগরূপেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, আর তারি জন্য প্রাচীন রাগরূপের সঙ্গে বর্তমান বা নবীন রাগরূপের ঠিক মিল পাওয়া যায় না৷
পদাবলীকীর্তনের অন্যতম পটভূমিকা চর্যাগীতির আলোচনার পর অষ্টাপদী বা গীতগোবিন্দপদের বিশেষ আলোচনায় আমরা প্রবৃত্ত হব৷ কিন্তু তার আগে “প্রবন্ধ”-বস্তুসম্বন্ধে কিছুটা ধারণা আমাদের থাকা উচিত৷ পূর্বেই বলেছি যে, “পদ” অর্থে গান ছাড়াও প্রবন্ধগানের একটি অঙ্গকে বোঝায়৷ প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রীরা বিচিত্র প্রবন্ধগানের বিস্তৃত পরিচয় দিয়েছেন৷ “সঙ্গীত রত্নাকর”-গ্রন্থে প্রবন্ধের পরিচয় দিয়ে শার্ঙ্গদেব বলেছেন, প্রবন্ধ প্রধানতঃ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত — সূ্ড, আলি বা আলিসংশ্রয় ও বিপ্রকীর্ণ৷ অঙ্গ, তাল, ধাতু প্রভৃতি উপাদানে প্রকৃষ্টরূপে বদ্ধ হয়ে গান প্রকাশ পেলেই তাকে “প্রবন্ধ” বলা হত৷ শার্ঙ্গদেব বলেছেন ঃ “প্রবন্ধাস্ত্রিবিধাঃ সূ্ডস্থা আলিসংশ্রয়াঃ বিপ্রকীর্ণাশ্চি” (রত্নাকর ৪.২২-২৩)৷ তাছাড়া দ্বিধাতু, ত্রিধাতু ও চতুর্ধাতুভেদে প্রবন্ধ আবার তিন রকম৷ প্রবন্ধের ছয়টি অঙ্গঃ “প্রবন্ধোঽঙ্গানি ষট্‌”৷ এই ছয়টি অঙ্গের নাম–স্বর, বিরুদ, পদ, তেনক, পাট ও তাল৷ “স্বর” ষড়্‌জাদি সাত স্বর৷ “বিরুদ” অর্থে গুণ বা প্রশংসাবাচক শব্দ ঃ”বিরুদং গুণনাম স্যাৎ”৷ এই বিরুদ গদ্যে ও পদ্যে রচিত শৌর্য, গুণ, প্রশংসা, ধৈর্য,স্তুতিপ্রকাশক ঃ “তেন স্যান্মঙ্গলার্থপ্রকাশকঃ”৷ বিরুদের অর্থ-সার্থকতার সঙ্গে কীর্তনের কীর্তিগাথাগান কীর্তনের অর্থের বা অর্থ-সার্থকতার অনেকটা সাদৃশ্য আছে৷ তবে প্রবন্ধাঙ্গ বিরুদ ও প্রবন্ধরূপে কীর্তন এক বস্তু নয়৷ “পাট” অর্থে বাদ্যের বোল — যেগুলি মুখে মুখে উচ্চারণ করা হত ঃ “পাটো বাদ্যোক্ষারোৎকরঃ” এবং “তাল” মাত্রার সমষ্টি ও গানের সঙ্গতির থাক৷ অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ঘনশ্যাম-নরহরি চক্রবর্তী “ভক্তিরত্নাকর”-গ্রন্থের সঙ্গীতাংশে অতি প্রাঞ্জল ভাষায় এই অঙ্গগুলির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন,
স্বর বিরুদ পদ তেনক পাঠ তাল৷
এই ছয় অঙ্গে গীত পরম রসাল৷৷
স্বর স রি গ ম প ধা দিক নিরূপয়৷
গুণ-নাম-যুক্ত মতে বিরুদ কহয়৷৷
পদ শব্দ বাচক প্রকার বহু ইথে৷
তেনা তেনাদিক শব্দ মঙ্গল নিমিত্তে৷৷
পাট বাদ্যোদ্ভবাক্ষর ধা ধা ধিলঙ্গাদি৷
তাল চচ্চাৎপুট যত্যাদিক যথাবিধি৷৷
এ” ষড়ঙ্গ প্রাচীন আচার্য নিরূপয়৷
বাক্য স্বর তাল তেনা চারি কেহ কয়৷৷
প্রবন্ধগানের জাতি আছে ও সে” জাতি পাঁচটি৷ যেমন ,
মেদিন্যাথানন্দিনী স্যাদ্দীপনী ভাবনী তথা ৷৷
তারাবলীতি পঞ্চ স্যুঃ প্রবন্ধানাংতু জাতয়৷৷ (ঘনশ্যাম নরহরি চক্রবর্তী লিখিত “সঙ্গীতসারসংগ্রহ” ও “গীত-চন্দ্রোদয়” গ্রন্থদুটিও দ্রষ্টব্য। লেখক কর্তৃক সম্পাদিত “সঙ্গীতসারসংগ্রহ” শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ থেকে প্রকাশিত এবং “গীতচন্দ্রোদয়” লেখকের “রাগ ও রূপ” গ্রন্থের ২য় ভাগে অন্তর্নিবিষ্ট করা হয়েছে৷) অর্থাৎ মেদিনী, আনন্দিনী, দীপনী, ভাবনী ও তারাবলী এই পাঁচটি জাতি৷ এদের লক্ষণ নির্ণয় করতে গিয়ে রত্নাকরের টীকাকার সিংহভূপাল বলেছেন ঃ “ষড়্‌ভিরঙ্গৈরূপনিবদ্ধা মেদিনীত্যুচ্যতে; পঞ্চভিরঙ্গৈরূপানিবদ্ধা আনন্দিনী ; চতুর্ভিরঙ্গৈরূপনিবদ্ধা দীপনী; ত্রিভিরঙ্গৈরূপনিবদ্ধাভাবনী; দ্বাভ্যামঙ্গাভ্যামুপনিবদ্ধা তারাবলীতি”; অর্থাৎ ছয়টি অঙ্গ প্রবন্ধের নাম মেদিনী, পাঁচ অঙ্গযুক্ত প্রবন্ধ আনন্দিনী, চার অঙ্গযুক্ত দীপনী, তিন অঙ্গযুক্ত ভাবনী ও দুটি অঙ্গযুক্ত প্রবন্ধ ছিল তারাবলীজাতি৷ শার্ঙ্গদেব “কেষাংচন মতে” বলে অন্য মতানুযায়ী শ্রুতি, নীতি, সেনা,কবিতা ও চম্পূ এই পাঁচটি জাতির নামও উল্লেখ করেছেন৷ এই অন্য মতের জাতিগুলিও মেদিনীর প্রভৃতি মতো সমান অঙ্গযুক্ত৷ শেষোক্ত চম্পূজাতি গদ্য ও পদ্যযুক্ত পদের সমজাতীয়৷ প্রবন্ধগান আবার নির্যুক্ত ও অনির্যুক্ত ভেদে দুরকম৷ অনির্যুক্ত প্রবন্ধ ছন্দ, তাল প্রভৃতির নিয়মাধীন নয়, কিন্তু নির্যুক্তপ্রবন্ধে যথারীতি ছন্দ ও তালের সমাবেশ থাকে৷
চর্যা-সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার প্রয়োজন, কেননা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহের অভিমত ঃ “বৌদ্ধগানগুলিই (চর্যা) (অনেকে লিখেন “চর্য্যা”, কিন্তু “চর্যা” শব্দই ঠিক ৷) পরবর্তীকালের মহাজন পদাবলী ও মুসলমানি মারফতী-গানের পূর্বরূপ (proto-type)৷ এক সময়ে নাথগণের চর্যাগীতি সমস্ত ভারতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল৷ পারস্য সাহিত্যের গজলগীতিরও পূর্বরূপ চর্যাগীতি৷ পরবর্তীকালে হিন্দী ভাষায় দোহা রচনা তুলসীদাস, কবীর প্রভৃতি দ্বারা উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে৷” (বাংলা সাহিত্যের কথা” (১ম খণ্ড, ঢাকা ১৯৫৩), পৃঃ ৯)৷ তিনি পুনরায় লিখেছেনঃ “আমরা দেখিয়াছি যে, গীতগোবিন্দই বৌদ্ধগান (চর্যা) দ্বারা প্রভাবান্বিত৷ আর এই গীতগোবিন্দই বৈষ্ণব-পদাবলীর আদিম আদর্শ৷ জয়দেব স্বয়ং “পদাবলী”-শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন —
মধুর কোমল -কান্ত-পদাবলীং,
শৃনু তদা জয়দেবী-সরস্বতীম্‌৷
পদাবীলর কবিগণের মধ্যে সর্বপ্রাচীন চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি৷ চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” (যাহার আদি নাম “শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ”) আমরা পাইয়াছি৷ * * বৌদ্ধগানের “শূন্যতা” বৈষ্ণব-পদাবলীতে “রাধা” হইয়াছেন৷ তদ্ভিন্ন রাগ ও ভণিতা একরূপই আছে৷ কাজেই আমরা বলিতে পারি যে, বৌদ্ধগানই (চর্যা ও ব্রজগীত) যেমন একদিকে গজলের, তেমনি অন্যদিকে বৈষ্ণব পদাবলীর মূল-উৎস৷ ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই দিক দিয়া বৌদ্ধ-চর্যাগানের এক বিশেষ মূল্য আছে৷” (“বাংলা সাহিত্যের কথা” (১ম খণ্ড, ঢাকা ১৯৫৩), পৃঃ ৭৬)৷
চর্যা বা চর্যাগীতির ভাষা-সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অভিমত প্রকাশ করেছেন “সন্ধ্যাভাষা” — যা আলো-আঁধারি ভাষা, –কিছু বোঝা যায়, কিছুটা বোঝা যায় না৷ ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তাঁর An Introduction to Buddhist Esoterism (p. 32)-গ্রন্থেও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন৷ তিনি লিখেছেন ঃ “They (Vajrayani Mahasiddhas)wrote (gitis or songs) in a language which was designated by them as the Sandhyabhasa, or the twilight language, meaning these by that the contents may be explained either by the light of day, or by the darkness of night. The songs composed by the Mahasiddhas were all written in this language, which had always a hidden or a mystic meaning”(p. 35)৷ (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর Buddhist Mystic Songs গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ঃ “The original text with its Sanskrit commentary was edited by M.M.Haraprasad Shastri from a unique MS. obtained from Nepal. It was published in Bengali character under the title “Charyacharya-Vinishchaya” in a volume with other works entitled “Banddha Gan-O-Doha” by the Vangiya Sahitya Parishat of Calcutta in 1323 B.E.(=1916 A.D.)৷”(Published in the Dacca University Studies,Vol.IV Januarty,1940, No.II.)মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, চর্য্যা, (চর্যা) আলো-আঁধারি ভাষায় লেখা মন্তব্য -সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী বলেছেন, ভাষাটি মূলে সন্ধ্যাভাষা নয়, পরন্তু সন্ধাভাষা (সম্‌ + ধা) — একটি বিশেষ অভিসিন্ধি বা অভিপ্রায় নিয়ে প্রয়োগ করা ভাষা, সুতরাং অশিক্ষিত লিপিকারগণের ভ্রম বা প্রমাদবশতই “সন্ধাভাষা” পরবর্তীকালে বিকৃত সন্ধ্যাভাষায রূপান্তরিত হওয়া স্বাভাবিক৷ (Vide (a) Sastri : Sandhabhasa (in the Indian Historical Quaterly, Vol.IV,1928; (b) Dr. P.C.Bagchi) Sandhabhasa and Sandhavachana (in Studies in Tanra, 1939). মহামহোপাধ্যায় হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী “বৌদ্ধ গান ও দোহা”-গ্রন্থে লিখেছেন ঃ “সহজিয়া ধর্মের সকল বইই সন্ধ্যাভাষায় লিখা৷ সন্ধ্যাভাষার মানে, আলো আঁধারি ভাষা — কতক আলো,কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না৷ অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথায় আছে” (পৃঃ ৮)৷ ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন ঃ “আমার মনে হয়, সন্ধাভাষা কথাটিই পরবর্তীকালে আভিপ্রায়িক অর্থ হইতে অস্পষ্ট আলো-আঁধারি ভাষার একটা অর্থ গ্রহণ করিয়াছিল এবং এই ভাবেই সন্ধাভাষা সন্ধ্যাভাষাতে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছিল৷” (বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি (১৩৭৬) পৃঃ ১৩২)৷
ডক্টর সুকুমার সেন বলেন, কতকগুলি চর্যাগীতিতে তত্ত্ব-উপদেশ ও সাধনার ইঙ্গিত সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হইয়াছে বাহ্য অর্থের ঢাকনায়৷ এই ধরনের চর্যায় এমন শব্দ ও উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করা হইয়াছে যাহার দুইটি অর্থ একটি অর্থ–সাধারণের ভাষা, অপর অর্থ –চর্যাকর্তাদের সাধনার পারিভাষিক, যেন তাঁহাদেরই প্রাইভেট কোড্‌৷ এইরূপ দ্ব্যর্থ শব্দ ও প্রকাশরীতিকে সরহের দোহাকোষের “পঞ্জিকা”-কার অদ্বয়বজ্র এবং চর্যগীতিকোষের বৃত্তিকার মুনিদত্ত বলিয়াছেন সন্ধ্যাভাষা (সন্ধাভাষা), সন্ধ্যাভাষা, সন্ধ্যাবচন, সন্ধ্যাসংকেত, অথবা শুধু সন্ধ্যা৷ ডক্টর সুকুমার সেন মঃমঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয় মন্তব্য খণ্ডন করে লিখেছেন ঃ “এ কথা ঠিক নয়৷ সন্ধ্যা (সন্ধা) ভাষার কোন সম্পর্ক নাই দিবারাত্রির মোহনার সঙ্গে * * যে ভাষার বা শব্দের অভীষ্ট অর্থ অনুধ্যান করিয়া অর্থাৎ মর্মজ্ঞ হইয়া বুঝিতে হয়, অথবা যে ভাষার শব্দের অর্থ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট, তাহাই সন্ধ্যা (সন্ধা) ভাষা৷” (চর্যাগীতি-পদাবলী (১৯৫৬), পৃঃ ২৩-২৪) অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায় আর একটু সুচিন্তিতভাবে বিচার করে বলেছেন ঃ “তান্ত্রিক বৌদ্ধ যোগীদের সাধনপদ্ধতি গুহ্য ব্যাপার৷ সাধনার এই গুহ্যত্ব বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে তাঁরা কতকগুলি কায়িক এবং বাচনিক সংকেত সৃষ্টি করেছিলেন৷ * * এই সংকেতের তাৎপর্য কেবলমাত্র যোগীদেরই বোধগম্য ছিল ৷ * * হেবজ্রব্যাখ্যাবিবরণে আরও বলা হয়েছে, চর্যারত যোগী যখন পীঠ এবং ক্ষেত্রে যোগিনীর সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে তখন কায়িক সংকেতের দ্বারাই যোগিনীর সঙ্গে ভাবের আদন-প্রদান করবে৷ ( চর্যাগীতি (বিশ্বভারতী, ১৩৭২), পৃঃ ৩৮) “হেব্রজতন্ত্র” -গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ৭ম পটলে ও ২য় খণ্ডের ৩য় পটলে বিভিন্ন অঙ্গুলি ও দৃষ্টি-সংকেতের প্রকাশই ছোম্বা বা কারিক সংকেত৷ এই সংকেত বা ভাষার রহস্য শ্রাবকরাই ভেদ করতে পারত৷” ( চর্যাগীতি (বিশ্বভারতী, ১৩৭২), পৃঃ ৩৮) ৷
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বৌদ্ধতন্ত্রের মতো হিন্দুতন্ত্রেও সাংকেতিক ও দ্ব্যর্থ ভাষার প্রচলন ছিল৷ কৌলোপনিষদে “প্রাকট্যং ন কুর্যাৎ” (২৭) “আত্মরহস্যং ন বদেৎ (৩১), “গুপ্তা কূলবধূরিব” “পীত্বা পীত্বা পুন পীত্বা যাবৎ পততি ভূতলে” প্রভৃতি৷ পরশুরামকল্পসূত্রে এদের দুটি অর্থের বিশ্লেষণ আছে৷
চর্যার অর্থ আচার বা আচরণ৷ এগুলি গান করা হত৷ “কৌলজ্ঞান নির্ণয়” -গ্রন্থে যে চর্যার উল্লেখ আছে ঃ “শৃণু ত্বং বীরচামুণ্ডে পাত্রাণাং চর্য্যলক্ষণম্‌” (১২.৩) –এর অর্থ রহস্যমূলক আচরণ (mystic practice)৷ চর্যাকে তাই গেয় গাথা বা সাহিত্য বলা যায়৷ চর্যাগীতিগুলি একই সময়ে রচিত হয় নি৷ বহুকাল ধরে এগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল ও গান করা হত৷ বৈষ্ণব পদাবলীর মতো চর্যাগীতিতে ভণিতা আছে ও কবির নাম ভণিতায় উল্লিখিত৷ গান বা গীতিগুলি অধ্যাত্ম-সহজসাধনার অঙ্গরূপে ব্যবহৃত হত এবং সেইগানগুলি ছিল গুপ্তসাধনার জন্য অভিপ্রেত এবং বৌদ্ধ-অধ্যাত্মসাধনার উদ্বোধক ও পথনির্দেশক৷ “কৌলজ্ঞাননির্ণয়-গ্রন্থের অন্তর্গত অকুলবীরতন্ত্রে ব্রজযোগ ও সহজানন্দ-রূপ সামরস্য বা মুক্তির কথা আছে,
সর্বজ্ঞং সর্বমাসৃত্য সর্বতো হিতলক্ষণম্‌৷
* * *
ভাবাভাববিনির্মুক্ত উদয়াস্তমনবর্জিতঃ৷
স্বভাবমতিমতং শান্তং মনো যস্য মনোময়ম্‌ ৷৷ ১১-১৪
যখন সাধক সহজ-সাধনায় কৃতকার্য হন, তখন তাঁর অবস্থা হয় —
কার্যকারণনির্মুক্তমচিন্ত্যকমনাময়ম্৷
মায়াতীতং নিরালম্বং ব্যাপকং সর্বতোমুখম্‌৷৷
সমত্বঞ্চ একভূতঞ্চ * * * ৷ ৩৩.৩৪
বৌদ্ধ-বজ্রযানী সাধকরা চর্যাগীতির ব্যবহার করতেন তাঁদের অধ্যাত্মসাধনার অনুকূলে এবং সাধকরা প্রভাস্বর মহাসুখময় সহজানন্দকে লাভ করে কৃত-কৃতার্থ হতেন৷ অকুলবীরতন্ত্রে (বৌদ্ধ-ব্রজযানীদের তন্ত্র) এই সহজানন্দের বর্ণনা এরূপ —
দগ্ধবীজস্য সংভূতির্যথা নৈব প্রপদ্যতে৷৷
মূলচ্ছিন্নো যথা বৃক্ষঃ প্ররোহন্নৈব বিদ্যতে৷
অকুলবীরস্য বৈ তদ্বদ্‌ন পুনর্ভববন্ধনম্ ৷৷ ৮৩-৮৪
সহজকামী বৌদ্ধসাধকগণ ভব বা অস্তিত্ব (বাসনা) ও নির্বাণ বা অনস্তিত্বের (নির্বাসনা) পারে–ইতি ও নেতির পারে অবধূতিকা পথে উর্ধে স্থিত হয়ে অদ্বয় বোধিচিত্ত বা সহজানন্দ-রূপ মহাসুখ লাভ করেন৷
চর্যাগীতির অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে চর্যা-রচয়িতা বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার্যদের সাধনতন্ত্র ও অনুভূতিতত্ত্বেরও কিছুটা অনুশীলন করা দরকার, কেননা চর্যাগীতি যেমন ভাবসিদ্ধ অনুভূতির দ্বারা প্রদীপ্ত,চর্যার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত বৈষ্ণব-পদাবলীগুলিও তেমনি অনুভূতিরসে নিবিড়ভাবে সিক্ত৷ চর্যাগীতি মন্ত্রশক্তির মতো বজ্রযানী সাধকদের চিত্তকে সংযত ও জ্ঞানলাভের পথে প্রবুদ্ধ করত৷ অবধূতিকা-পথে চর্যা ছিল প্রেরণাদানের উৎসস্বরূপ৷
এক্ষণে দেখা যাক, ব্রজযানী বৌদ্ধ-সিদ্ধসাধকগণের সাধনতত্ত্বের রূপ কি ছিল — যে রূপকে গ্রহণ ও অনুভব করে তাঁরা সহজানন্দ লাভ করতেন৷ বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃতি ঘটে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে এবং চর্যাকারগণ সকলেই ছিলেন সহজিয়া-সাধক৷ সহজিয়া-বৌদ্ধধর্মের বিকাশ মহাযান -ধর্মমত থেকে৷ মহাযান মতে, শূন্যতার সঙ্গে মহাকরুণার মিলন অবিচ্ছেদ্যভাবে৷ করুণার বিশুদ্ধির জন্যই শূন্যতার সার্থকতা ও সেজন্য চর্যাগানগুলিতে বা তান্ত্রিক দোঁহাগীতিগুলিতে করুণার স্পর্শ পাই আমরা বিশেষভাবে৷ মহাযানীদের মধ্যে যারা আবার মন্ত্রনয়ের উপর বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁরা মুদ্রা, মণ্ডল, মন্ত্র, যন্ত্র, ধাবণী প্রভৃতির প্রচলন করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে বজ্রযান রূপে রূপায়িত করেন৷ “বজ্র” শব্দের অর্থ “শূন্যতা” ও সেজন্য বজ্রযানের মূল অর্থ “শূন্যতাযান”৷ তাই বজ্রযানের পূজাবিধি, মন্ত্র, দেবদেবী, সাধনতত্ত্ব ও সাধনসামগ্রী সমস্তই বজ্রচিহ্নিত ছিল৷ নেপালে বজ্রযান থেকে ক্রমশঃ কালচক্রযানের উদ্ভব হোল৷ কালচক্রযানের সাধনবৈশিষ্ট্য হোল শ্বাসপ্রশ্বাসধারার উপর আধিপত্য করা ও শ্বাসপ্রশ্বাসকে নিরুদ্ধ করে কালচক্রকে অতিক্রম করা৷ সহজযানী সাধকরা বজ্রযানী ও কালচক্রযানীদেরই সমন্বিত রূপ৷ সহজযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধচার্যদের সাধ্য ও সাধন উভয়ই ছিল “সহজ” এবং এই “সহজ”-স্বরূপই চিরপরিবর্তনের মধ্যে এক অপরিবর্তনীয় অদ্বয় রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং এই অদ্বয়রূপে আসীন হওয়ার নামই মহাসুখ বা সহজানন্দ লাভ৷ (এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা (ক) ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য-লিখিত Buddhist Esoterism,chapt.3 (খ) মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-লিখিত “অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ” গ্রন্থের Introduction এবং (গ) ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্ত-লিখিত “বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি” দ্রষ্টব্য৷ )
বৌদ্ধ-সহজিয়া বা বৌদ্ধ সহজযান মতাবলম্বীদের মহাসুখতত্ত্ব-সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন ঃ “* * Sunyavada of Nagardjuna was supplemented by that of the Vijnanavada of Maitreya, but to some minds there is little difference between the two.* * So another idea was thought in, and that is the idea of Mahasukha. * * But what is Mahasukha? It is a result of the union of two principles, existence in one principle and the existence is another principle, but they are one and the same, * * The Bodhi is pleasure, because without pleasur,there is no Bodhi”৷ ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য “গুহ্যসমাজতন্ত্র” বা তথাগতগুহ্যকতন্ত্রের ইংরাজী ভূমিকায়ও তান্ত্রিক বৌদ্ধ-দেবদেবী ও পূজাবিধির উল্লেখ করেছেন৷ “গুহ্যসমাজতন্ত্র” সম্ভবত খ্রীষ্টীয় ৩য় শতকে আচার্য অসঙ্গ রচনা করেন৷ গুহ্যসমাজতন্ত্রের পূর্বে খ্রীষ্টীয় ২য় শতকে “মঞ্জুশ্রীমূলকল্প” নামে তান্ত্রিক গ্রন্থ লিখিত হয় এবং “জ্ঞানসিদ্ধি” -গ্রন্থকার ইন্দ্রভূতি ঐ দুটি তন্ত্রের নামোল্লেখ করেছেন৷ গুহ্যসমাজতন্ত্রের রচয়িতা অসঙ্গ যোগাচারী ছিলেন এবং সম্ভবত এই অসঙ্গ “পারমিতা-সাধনা”র প্রবর্তক অসঙ্গ থেকে ভিন্ন ব্যক্তি৷ অবশ্য এটি নিয়ে মতভেদ আছে৷ তবে বজ্রযানী সাধকদের মধ্যে পঞ্চধ্যানীবুদ্ধ ও বুদ্ধশক্তি এবং ধারণী, মণ্ডল, মন্ত্র প্রভৃতির প্রবর্তন করে বিশেষভাবে গুহ্যসমাজতন্ত্র৷ শুদ্ধচিত্ত বৌদ্ধযোগীরা মন্ত্রে মন নিবিষ্ট করেন ও তখনই সমগ্র বিশ্বপ্রবঞ্চ সংবৃতি বা মায়ায় পরিণত হয় ও মনের বা চিত্তের বা বোধির তখন স্থিতি হয় অদ্বয়তত্ত্বে৷ তখন বাহ্য ও অন্তর বিশুদ্ধতা-রূপ অদ্বয়তত্ত্বে ও সত্যে প্রজ্ঞা ও উপায়ের (শিব ও শক্তির বা বিন্দু ও নাদের) লয় হয় সিদ্ধযোগী “মহাসুখ” উপলব্ধি করেন৷ (Introduction to Advayavaja-samgraha, pp. XXXII-XXXIII.)
ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধধর্মের বিকাশ-সম্পর্কে বলেছেন, যোগাচারী বৌদ্ধরা মাধ্যমিকদের শূন্যতার সত্তাকে বাদ না দিয়ে শূন্যতার সঙ্গে বিজ্ঞানের সহচারিতা স্বীকার করেন৷ তখন মাধ্যমিকদের “শূন্যতা” সত্তাসমপন্ন “তথতা”-য় রূপান্তরিত হয়৷ সুতরাং যোগাচারের পাশাপাশি মহাসুখবাদের অভ্যুত্থান হয় ও নাম গ্রহণ করে, বজ্রযান বা “the ament-vehicle”৷ বজ্রযানের মধ্যে নির্বাণ রূপ পেল শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ এই ত্রিতত্ত্বের রূপ নিয়ে এবং এই ত্রিত্ত্বকেই বজ্রযানীরা নাম দিলেন “বজ্র” নামে, কেননা এই বজ্রের স্বরূপ ও প্রকৃতি স্থির, অবিনশ্বর ও অচ্ছেদ্য৷
দৃঢ় সারমসৌশীর্ষমচ্ছেদ্যাভেদ্যলক্ষণম্‌৷
অনাদি অবিনাশী চ শূন্যতা বজ্রমুচ্যতে৷৷ (অদ্বয়বজ্রসংগ্রহে পঞ্চতথাগতমুদ্রাবিবরণম, (বরোদা সং), পৃঃ ২৩)
বজ্রযানী বৌদ্ধসাধকরা কল্পনা করলেন শূন্যই নৈরাত্মাদেবী–যাঁর অনন্ত গর্ভে ব্যষ্টিচিত্ত-রূপ বোধিচিত্ত বা বিজ্ঞানের বিকাশ অক্ষুণ্ণ থাকে৷ ক্রমে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মরূপ বজ্রযানের মধ্যে পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি ও অক্ষোভ্যের কল্পনা হোল৷ (পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের বিস্তৃত ব্যাখ্যা ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্তের “বৌদ্ধধর্ম ও চর্য্যাগীতি” পৃঃ ৬২-৬৬ দ্রষ্টব্য৷) সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হোল দেহশুদ্ধি, কায়া বা কায়-সাধনের তত্ত্ব, কেননা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দেহের মধ্যে পঞ্চ স্কন্ধাত্মক পাঁচটি নাড়ী ও পাঁচটি তথাগত বা ধ্যানীবুদ্ধের কল্পনার সংক্রমণ অপরিহার্য হোল৷ তাই একটি চর্যাগীতিতেও উল্লেখ দেখি —
পঞ্চ তথাগত কিঅ কেড়ুআল৷
বাহঅ কাঅ কাহ্নিল মহাসুহ সাঙ্গে৷৷
* *
চিঅ কণ্ণহার সুণত মাঙ্গে।
চলিল কাহ্ণ মহাসুহ সাঙ্গে।।
ধ্যানীবুদ্ধগণের সঙ্গে পঞ্চশক্তিরও কল্পনা করা হয়েছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধসাধনায়৷
মোটকথা সহজিয়া-সাধনায় সমরস বা সামরস্য-রূপ সহজানন্দ লাভ করাই ছিল বৌদ্ধ-চর্যারচয়িতা সহজ-সাধকদের উদ্দেশ্য৷ সরহপাদ একটি দোঁহাতে বলেছেন,
সঙ্কপাস তোড়হু গুরুবঅণেঁ
ণ্ণ সুনই সোণউ দীসই ন অণেঁ৷৷
* * *
ণউ বট্টই ণ তনুন্তে ণ বজ্জই৷
সমরস সহজাণন্দ জাণিজ্জই৷৷

সহজই সহজানন্দ এবং সহজকে উপলব্ধি করতে পারলেই নির্বিকল্প পরমানন্দ লাভ হয়৷ পরমানন্দস্বরূপ সহজানন্দ অদৃশ্য, অস্পৃশ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য –যেভাবে আত্মার স্বরূপ নির্ণীত হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায়৷ “বৌদ্ধগান ও দোহা”-গ্রন্থে শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন ঃ “সহজধর্মে বাচ্য নাই, বাচক নাই এবং ইহাদের সম্বন্ধও নাই৷ যে যে উপায়ে মুক্তির উপায় করুক না কেন, শেষে সকলকে সহজপথেই আসিতে হইবে৷ * * ভাবও নাই, অভাবও নাই; সকলই শূন্যরূপ, অর্থাৎ ভব ও নির্বাণে কোন ভেদ নাই, দুই এক সুতরাং সহজিয়ারা অদ্বয়বাদী” (পৃঃ ৮)৷ এই সহজ বা সহজানন্দকে বৌদ্ধতন্ত্রে মহাসুখ নৈরাত্মা বলা হয়েছে এবং “জ্ঞানসিদ্ধি”-গ্রন্থের ৭ম পরিচ্ছেদে এই মহাসুখবাদের বিশেষ পরিচয় দেওয়া হয়েছে৷ (Vide Two Vajrayana Works, G.O.S. No.XLIV, p.57, and vide also Advayavayaja-samgraha, p. XXXVIII)৷ অবশ্য সুত্তনিপাতে, ধর্ম্মপদে, অঙ্গুত্তর-নিকায়ে নির্ব্বাণ বা নির্বাণকেই “পরমসুখ” বা সহজানন্দ বলে বর্ণনা করা হয়েছে– “নিব্বাণং পরমং সুখম্‌”৷
এখানে মনে রাখা উচিত যে, বৌদ্ধ-তন্ত্রসাধনা হিন্তু ও নাথধর্মের যোগানুষ্ঠানপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল (অবশ্য মঃমঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিনয়তোষ ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকের অভিমত যে, হিন্দুতন্ত্রই বৌদ্ধতন্ত্রের নিকট ঋণী, অথবা বৌদ্ধতন্ত্রের আচার, পূজানুষ্ঠান, মন্ত্র, যন্ত্র ও দেবদেবীরা হিন্দুতন্ত্রে তনুপ্রবেশ করেছিল৷ অবশ্য এই মতবাদের অনেকেই পক্ষপাতী নন৷) এবং চর্যাপদে যোগশাস্ত্রের মতো ইডা, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ীর উল্লেখ আছে, নদীর উজান প্রভৃতির উল্লেখ আছে৷ এখানে ডক্টর শশিভূষণ দাশগুপ্তের “বৌদ্ধগান চর্যাগীতি” গ্রন্থ থেকে কিছুটা উদ্ধতি দিলাম বিষয়টি বিশেষভাবে বোধগম্যের জন্য৷ তিনি লিখেছেন ঃ “যোগসাধনার দিক হইতে দেখিতে পাইব, আমাদের দেহের মধ্যে তিনটি প্রধান নাড়ী আছে ঃ একটি বামগা–শ্বাসবাহী নাড়ী বা প্রাণবাহী নাড়ী, অপরটি হইল দক্ষিণগা–প্রশ্বাসবাহী নাড়ী বা আপনবাহী নাড়ী; এই দুই হইল দেহমধ্যে সর্বপ্রকার দ্বৈততত্ত্বের প্রতীক বা প্রতিনিধি, আর একটি নাড়ী আছে মধ্যগা নাড়ী, –তাহাকে বৌদ্ধতন্ত্রে বলা হয় অবধূতি বা অবধূতিকা৷ * * তাহাদের স্বাভাবিক নিম্নগা ধারাকে অবধূতিকা-পথে উর্ধ্বগা করিতে পারিলে অদ্বয়বোধিচিত্ত বা সহজানন্দ-রূপ মহাসুখ লাভ হয়৷ (পৃঃ ৯৫)
সিদ্ধাচার্য সরহপাদ যোগসাধনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন,
এত্থু সে সুরসরি জমুণা
এত্থু সে গঙ্গাসাঅরু৷
এত্থু পআগ বণারসি
এত্থু সে চন্দ দিবাঅরু ৷৷ প্রভৃতি
এত্থু অর্থে এখানে বা এই দেহেই সুরসরি বা সুরসরিৎ গঙ্গা ও জমুণা বা যমুণা এবং এখানে বা এই দেহেই গঙ্গাসাগর, প্রয়াগ ও বারাণসী, চন্দ্র, সূর্য (দিবাঅরু) প্রভৃতি বিরাজিত৷ সুতরাং সকল তীর্থে ভ্রমণ করে শান্তি নাই, আছে সহজানন্দে সুখ ও শান্তি৷ সুরহপাদের এই চর্যাগীতি সাধক রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের গানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷ সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, কাশী কাঞ্চী সবই আছে শ্যামা-মার চরণতলে ও কমলাকান্ত বলেছেন–
তীর্থভ্রমণ দুঃখগমন, মন-উচাটন হয়ো নারে৷
আনন্দে ত্রিবেণী স্নানে, শীতল হও না মূলাধারে৷৷
ত্রিবেণী কিনা গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী তথা ইডা পিঙ্গলা ও সুষুম্নার সঙ্গম রূপ৷ তিনটি নাড়ীই মূলাধারে ও সহস্রারে মিশ্রিত এবং মূলাধার ও সহস্রারই শক্তি ও শিবের স্থান এবং সামরস্য -আনন্দ ঐ দুটি স্থানেই সম্ভব হতে পারে৷ হটযোগপ্রদীপিকা, জ্ঞানসঙ্কলিনীতন্ত্র প্রভৃতিতে শিবশক্তিসামরস্যের উল্লেখ আছে এবং বৌদ্ধতন্ত্রেও আছে৷ শিবকে বিন্দুরূপ ও শক্তিকে নাদরূপে তন্ত্রে কল্পনা করা হয়েছে৷ শিব নিবৃত্তিতত্ত্ব ও ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি প্রবৃত্তিতত্ত্ব৷ এই নিবৃত্তি -প্রবৃত্তিতত্ত্বের নিম্নগা ধারায় সংবৃতি, মায়া বা ভব (সংসারপ্রবাহ ও প্রবৃত্তি) এবং এদের মিলনের উর্ধ্বগা ধারায় অদ্বয়ে প্রতিষ্ঠা, এবং সহজানন্দ বা মহাসুখপ্রাপ্তি৷ বৌদ্ধতন্ত্রমতে, বিন্দু–প্রজ্ঞা এবং নাদ –উপায়,সুতরাং বিন্দু ও নাদ বা প্রজ্ঞা ও উপায়ের উর্ধধারার-মিলনে “অবধূতিকামার্গ”৷ এই মার্গ অনুসরণ করে স্রোতে উজান দিয়ে উল্টোসাধন করলে মহাসুখ, সহজানন্দ বা সামরস্য লাভ হয়৷ এই সামরস্য দেহের মধ্যেই থাকে, এজন্য বৌদ্ধ-বজ্রযানী সিদ্ধাচার্যগণ, সহজিয়াগন ও বাউল সাধকগণ, কায়া বা কায়াসাধন ও উল্টাসাধনের পক্ষপাতী৷ উল্টাসাধনায় চর্যারচয়িতা বৌদ্ধসাধকরা অবধূতি বা অবধূতিকাকে বা নৈরাত্মাদেবীকে লাভ করেন সহজানন্দ লাভের জন্য৷ চর্যাগীতির তত্ত্বকথা ও মর্মকথা তাই৷ চর্যাগীতি অধ্যাত্মসাধনার গান এবং “গীতগোবিন্দ”-পদগান ও বৈষ্ণব-পদাবলী-কীর্তনের প্রতিষ্ঠা বা পাদভূমি৷ চর্যার অবধূতিকাই গীতগোবিন্দ ও পদাবলীকীর্তনের শ্রীরাধা এবং পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সাধনতত্ত্বে শ্রীকৃষ্ণ -রাধার সমন্বয়মূর্তি রসভাবঘন শ্রীচৈতন্য বা শ্রীগৌরাঙ্গমূর্তি৷