বাংলাদেশের বহুস্থানে রাধাকৃষ্ণের মন্দির বর্তমান আছে৷ এই সকল মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের সেবা-ব্যপদেশে কীর্তনের অল্পবিস্তর অনুশীলন দেখা যায়৷ কোনও কোনও কৃষ্ণমন্দিরে প্রতিদিন, কোনও মন্দিরে পর্বের সময় কীর্তনের অনুষ্ঠান হয়৷ বৈষ্ণব তীর্থসমূহে পর্বের সময়ে কীর্তনের ব্যবস্থা করিতেই হয়, যথা– রাসের সময়ে রাসলীলা, হোলির সময়ে হোলিগান, ঝুলনের সময়ে ঝুলনগান, বসন্তপঞ্চমী উপলক্ষ্যে বসন্তগান ইত্যাদি৷ কিন্তু অনেক স্থলে উপযুক্ত গায়কের অভাবে যেন তেন প্রকারেণ সারিয়া দেওয়া হয়৷ নবদ্বীপে প্রতি বৎসরে ‘ধুলোট’ হয় অর্থাৎ বঙ্গের বহু কীর্তনওয়ালা সমবেত হইয়া শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর জন্মস্থানে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় (মহাপ্রভুর জন্মতিথি) আপন আপন কৃতিত্বের পর্যাপ্ত পরিচয় দিয়া থাকেন৷ এই সময়ে বহু ‘যাত্রী’ নবদ্বীপে যাইয়া কীর্তন শুনিয়া আসেন৷ তাঁহাদের দ্বারা কীর্তনওয়ালার যশঃ বাহিত হইয়া সমগ্র দেশে প্রচারিত হয়৷ শান্তিপুর, শ্রীখণ্ড,ঝামটপুর প্রভৃতি স্থানে প্রতি বৎসর পর্ববিশেষ বা মেলার সময়ে কীর্তন অনুষ্ঠিত হয়৷ ঝামটপুর শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ-প্রণেতা কৃষ্ণদাস কবিরাজের জন্মস্থান৷ এখানে কীর্তন গান করিলে সারা বৎসর সফলতা লাভ করা যায় এই আশায় ঐ অমর কবির তিরোধান-উৎসবে কীর্তনওয়ালারা নিজ নিজ ব্যয়ে সেখানে গিয়া গান করিয়া থাকেন৷ শ্রীখণ্ড শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের স্থান বলিয়া তাঁহার তিরোভাব-তিথিতে শ্রীখণ্ডেও সমারোহের সহিত কীর্তন হইয়া থাকে৷ বহু বৈষ্ণব ভক্ত ঐ উপলক্ষে কাটোয়া ও শ্রীখণ্ডে সমবেত হন৷ শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের স্থান বলিয়া কালনায়ও কীর্তনগানের অনুষ্ঠান হয়৷ এখানে গৌরাঙ্গমন্দিরে মহাপ্রভুর শ্রীহস্তলিপি রক্ষিত আছে৷ কেন্দুবিল্বে জয়দেবের তিরোভাব-মহোৎসব হয় এবং রামকেলিতেও রূপসনাতনের স্মৃতিপূজা উপলক্ষ্যে এক বৃহৎ উৎসব হইয়া থাকে৷
বৈষ্ণব ভক্ত ও মহাপুরুষদিগের তিরোভাব-মহোৎসবে তাঁহাদের লীলাবিষয়ক যে কীর্তন হয় তাহাকে ‘সূচক কীর্তন’ বলা হয়৷ রূপ ও সনাতন গোস্বামীর সূচক, জীব গোস্বামীর সূচক, নরোত্তমদাস ঠাকুরের সূচক প্রভৃতি স্মৃতিবন্দনার এক অপূর্ব কৌশল৷ অদ্যাপি এই সূচক কীর্তন শুনিয়া ভক্তকুল অশ্রুপরিপ্লুত হইয়া থাকেন৷ সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণবভক্ত ও নামকীর্তনিয়া শ্রীযুক্ত রামদাস বাবাজি বর্তমানে এই সূচক গানের একমাত্র ভাণ্ডারী বলিলে অত্যুক্তি হয় না৷ অশ্রু পুলক কম্প প্রভৃতি সাত্ত্বিকভাব-সমন্বিত এই কীর্তন যিনি না শুনিয়াছেন, তাঁহাকে ঠিক বুঝাইয়া দেওয়া কঠিন৷ এই সূচকগান মহাপুরুষ বা ভক্তগণের তিরোভাব-তিথি ব্যতীত গান করিবার রীতি নাই৷ বৃন্দাবনে সকল গোস্বামিগণের সূচক গান বা চরিতকীর্তন এখনও হইয়া থাকে৷
সেইরূপ কীর্তনের কোন কোন পালাও সেই সেই পর্ব অতীত হইলে অন্য সময়ে গাহিবার রীতি অভিজ্ঞেরা অনুমোদন করেন না৷ যথা ঝুলন, নন্দোৎসব, হোলি, বসন্ত, ফুলদোল প্রভৃতি সেই সেই পর্বের দিন বা তাহার নির্ধারিত কয়েকদিনের মধ্যে ব্যতীত গীত হইবার উপায় নাই৷ অন্যান্য সংগীতের তুলনায় কীর্তনগানের সম্পর্কে স্বাধীনতা এইরূপে সীমাবদ্ধ৷ রাত্রিতে গোষ্ঠ বা কুঞ্জভঙ্গ, সকালে রাসলীলা বা উত্তরগোষ্ঠ গীত হয় না৷ খণ্ডিতা সকালে ব্যতীত হয় না, কুঞ্জভঙ্গ অতি প্রত্যুষে গাহিবার রীতি আছে৷ কেহ কেহ কলহান্তরিতা, মান প্রভৃতি বিকালে বা সন্ধ্যায় গীত হইলে শুনেন না৷ লীলার ক্রম অনুসারে পালার ক্রম নির্দিষ্ট হয়৷ সব সময়ে হয়তো এ নিয়ম রক্ষিত হয় না৷ কিন্তু বৈষ্ণবসমাজে এই নিয়ম-রক্ষার দিকে যথেষ্ট যত্ন দেখা যায়৷ তাহার আর এক কারণ এই যে, সময় অনুসারে পালা নির্দিষ্ট হওয়ায় গানগুলির রাগরাগিণীও সেইভাবে ব্যবস্থিত হইয়াছে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে কুঞ্জভঙ্গে ভৈরব, উত্তরগোষ্ঠে গৌরী এবং রাসে বেহাগের প্রাচুর্য দেখা যায়৷