কলিকাতায় এক পুরানো পুস্তকের দোকানে পুস্তকের সন্ধানে গিয়া ১৩৬৪ সালের একখানি মাসিকপত্র হাত পাইলাম ৷৷ নাম ‘হিমাচল’৷ হিমাচলের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় একটি লেখা দেখিলাম — ‘কেতুগ্রামের কবি’ । লেখাটি আদ্যোপান্ত পড়িলাম ৷ লেখার আরম্ভ এইরূপ —
তিনি ছিলেন কবি …
সেদিন কবির চোখের জল বাঁধ মানছিল না ৷ “মঈ আঙ্গুল কাটিঞা কলম বানাইনুঁ, চোখের বারিতে কালি” কবি তাঁর ভাবাবেগে নিজস্ব সাহিত্যের ভেতর দিয়ে মা চণ্ডীকে নিবেদন করেছিলেন সমস্ত প্রাণ; যে প্রাণে আছে তাঁর ভয়, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, এই প্রাণেই কবি মা চণ্ডীকে পেয়েছিলেন ৷ শুধু পাওয়াই — কখনো কেউ সহজে পায় না ৷ সেই প্রাচীন যুগে — যে যুগে ছিল না সাহিত্য, ছিল না ভাষা সেই যুগেরই কবি তিনি ৷ কবি এমন সাহিত্য রচনা করেছিলেন যা আজ অবধি বাঙ্গলার তথা সমগ্র ভারতের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েচে ৷ তাঁর অমর লেখনী কখনো ব্যর্থ হয় নি, মুছে যায় নি তাঁর কাব্যসাধনা বাঙ্গালীর অন্তর থেকে৷
আজ থেকে কয়েক শ বছর পূর্বে বাঙ্গালা দেশের রাঢ় অঞ্চলে তাঁর বিকাশ হয় ৷ তিনি জাতিতে ছিলেন কুলীন অর্থাৎ উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ, জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার কেতুগ্রামে ৷ প্রথমে চরণদাস ঠাকুর এই নামে ছিল তাঁর পরিচয় ৷ তিনি পূজাদি কার্য করতেন বলে কেতু গ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে ঠাকুর বলে সম্বোধন করত ৷ তারপর তাঁর কাব্য-সাধনায় মা চণ্ডীকে তিনি জাগালেন সর্বসাধারণের হৃদয়ের মাঝে ৷ লোকে তাঁকে চণ্ডীদাস বলে অভিহিত করল ৷
কেতুগ্রামের উত্তরপ্রান্তে চণ্ডীদাসের জন্মস্থান ছিল ৷ এখন তাঁর নামানুযায়ী সেই জায়গাকে গ্রামের লোকে বলে ‘চণ্ডীভিটা’৷ বর্তমানে সেই জায়গা এক ব্রাহ্মণ-পরিবারের কর্তৃত্বাধীনে ৷
লেখক অতঃপর উক্ত প্রবন্ধে কেতুগ্রামের আরো প্রবাদের উল্লেখ করিয়াছেন ৷ লিখিয়াছেন, চণ্ডীদাস গ্রামের নীচজাতীয়া একটি বিধবাকে বিবাহ করেন ৷ গ্রামের লোক এইজন্য চণ্ডীদাসের উপর বিরক্ত হইলে তিনি স্বপূজিতা বিশালাক্ষীদেবীকে লইয়া কেতুগ্রাম হইতে নানুরে এক বন্ধুর আশ্রয়ে চলিয়া যান ৷ গ্রামের লোক তীর ধনুক লইয়া নানুর আক্রমণ করিলে নানোরের লোক সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন ৷ ব্যর্থমনোরথ গ্রামবাসীরা ফিরিয়া আসিয়া পীঠাধিষ্ঠাত্রী বহুলাক্ষীর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন ৷ ততদিনে বিবাদ মিটিয়া গিয়াছিল ৷ কেতুগ্রামের অধিবাসীরা বহুলাক্ষী প্রতিষ্ঠার জন্য চণ্ডীদাসকেই পৌরোহিত্যে নিযুক্ত করিয়াাছিলেন ৷ বহুলাক্ষী ছিলেন কেতুগ্রামের পাশে মড়াঘাটে ৷ তাঁহাকে গ্রামের মধ্যে আনিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয় ৷
দুর্গাপূজার সময় নানুরে বিশালাক্ষীদেবীর চার দিন বার্ষিক পূজা হয় ৷ এই পূজায় মহানবমী পূজার দিন কেতুগ্রামের তিলিদের পূজাই সর্বাগ্রে গৃহীত হয় ৷ তাহাদের প্রেরিত ছাগই বলিরূপে প্রথম প্রদত্ত হইয়া থাকে ৷ এই প্রথা আজিও চলিয়া আসিতেছে ৷
কেতুগ্রামের অধিবাসী শ্রীব্রজগোপাল গুপ্তের নিকট হইতে পত্র পাইয়া কেতুগ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম ৷ সেখানে যাঁহার গৃহে উঠিলাম তাঁহার নাম শ্রীফণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় ৷ তখন জানিতে পারিলাম, ‘হিমাচল’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির লেখক শ্রীমান্ দীপ্তি ইঁহারই পুত্র ৷ কয়েকদিন থাকিয়া ফণিভূষণের সাহায্যে গ্রাম হইতে হিমাচলে লিখিত প্রাবাদের সমর্থনমূলক বহু তথ্যের সন্ধান পাইলাম ৷ গ্রামের বহু লোক এখনো এই প্রবাদে বিশ্বাস করে ৷ গ্রামে যেমন চণ্ডীদাসের ভিটা আছে, তেমনই বিশালাক্ষী-মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে ৷ কেতুগ্রামে ভূপাল নামে এক রাজা ছিলেন ৷ ভূপালের পুত্রের নাম চন্দ্রকেতু ৷ ভূপাল পুত্রের নামে কেতুগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন ৷ গ্রামখানি প্রকাণ্ড, রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷ ভূপাল ছিলেন জাতিতে তিলি ৷ তাঁহার বংশধরগণ আজিও বিশালাক্ষীর পূজা পাঠাইয়া দেন নবমী পূজার দিন বীরভূম নানুরে ৷
কেতুগ্রামে চণ্ডীদাসের বংশে নৃসিংহ তর্কপঞ্চানন নামে এক পণ্ডিত বাস করিতেন, তিনি ‘গণমার্তণ্ড’ নামে ব্যাকরণের গণপাঠের বৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন ৷ এই গ্রন্থে নৃসিংহ আত্মপরিচয় দিতে গিয়া লিখিয়াছেন— (প্রবাদের চণ্ডীদাস যে কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন সে কথা এখনো লোকে ভুলিতে পারে নাই ৷ ভট্টাচার্য ইঁহাদের পাণ্ডিত্যের উপাধি)৷
ধীরঃ শ্রীল নৃসিংহজে মুখ কুলে জাতঃ কবীনাং রবি
বিদ্যায়া মনুকম্পয়া বিতরণে মহ্যাং সুপর্ণদ্রুমঃ৷
নানাশাস্ত্রবিচারচারুচতুরোঽলঙ্কারটীকা কৃতী
ভট্টাচার্য্যশিরোমণির্বিজয়তে শ্রীচণ্ডিদাসাভিধঃ৷
এই গণমার্তণ্ডে প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে নৃসিংহ একে একে পূর্বপুরুষগণের পরিচয় দিয়াছেন ৷ চণ্ডীদাসের পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজনের নাম গোপীনাথ ৷ তৎপুত্র মাধব, মাধবের পুত্রের নাম নয়ন, নয়নপুত্র কুমুদ, কুমুদতনয় শ্রীহরি ৷ শ্যামদাস বিদ্যাবাগীশ শ্রীহরির আত্মজ ৷ বিদ্যাবাগীশের পুত্র গোপাল সার্বভৌম ৷ গোপালের তিন পুত্রের অন্যতম কুশল তর্কভূষণ ৷ কুশলের পুত্র নৃসিংহ তর্কপঞ্চানন৷ কুশলের পরিচয় দিয়োছেন নৃসিংহ তর্কপঞ্চানন ৷
চণ্ডীদাসকুলাব্জার্ককুশলস্তর্কভূষণঃ ৷
নৃসিংহ তৎসুতং ব্যক্তি গণবৃত্তি নতং হরি ৷৷
চণ্ডীদাসের সময় হইতেই এই বংশ হরিপরায়ণ ৷ কেতুগ্রামে কয়েকবারই গিয়াছি, নৃসিংহ তর্কপঞ্চাননের ভিটা এবং তাঁহার টোলবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখিয়া আসিয়াছি ৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস কেতুগ্রামের চণ্ডীদাসই নানুরের বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাস এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন তাঁহারই রচনা ৷ কেতুগ্রাম হইতে আমি একখানি দলিল সংগ্রহ করিয়াছি ৷ তারিখ ১২১৮ সাল ৪ঠা অগ্রহায়ণ ৷ এই দলিলে তর্কপঞ্চাননের পুত্র রমাকান্ত ভট্টাচার্য ও তর্কপঞ্চানন উভয়েই দেহত্যাগ করিয়াছিলেন —দলিল হইতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ৷
চণ্ডীদাসের পিতার নাম অশ্বপতি ৷ চণ্ডীদাস ফুলিয়ার কবি কৃত্তিবাসের ভ্রাতুষ্পুত্র ৷ এই দিক দিয়া এবং তর্কপঞ্চানন হইতে দশম পুরুষ পূর্বের কাল গণনা করিয়া চণ্ডীদাসের সময় খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে অনুমান করিতে হয় ৷ আমি তাঁহাকে শ্রীমহাপ্রভুর অব্যবহিত পূর্ববর্তী বলিয়া মনে করি ৷ পূর্বেই বলিয়াছি ভূপাল জাতিতে তিলি ছিলেন ৷ কেতুগ্রামে তাঁহার বংশধরগণ বর্তমান রহিয়াছেন ৷ ভূপাল-রাজবংশের সঙ্গে বিশালাক্ষীর পূজার সম্বন্ধ ছিল ৷ রাজবংশধরগণ আজিও এই সম্বন্ধ বজায় রাখিয়াছেন ৷ কেতু গ্রামের বহু পুরাতন প্রবাদে অবিশ্বাসের কোনো হেতু নাই ৷ আধুনিক গবেষকগণ গিয়া কেহ এই প্রবাদ সৃষ্টি করেন নাই৷ কেতুগ্রামে নৃসিংহ তর্কপঞ্চাননকে পাইতেছি৷ তাঁহার প্রদত্ত বংশতালিকার সঙ্গে কুলগ্রন্থ -কথিত কৃত্তিবাসের বংশধারার ঐক্য রহিয়াছে ৷ সুতরাং চণ্ডীদাস যে কেতুগ্রাম হইতেই নানুরে গিয়া বাস করিয়াছিলেন সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নাই৷
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লইয়া আমি ১৩৩৪ সালে প্রকাশিত বীরভূম-বিবরণে (তৃতীয় খণ্ড) বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছিলাম ৷ আমি এই আলোচনায় চণ্ডীদাসের কবিত্ব বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছি যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মহাকবির রচনা ৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হইতে বহু পদ উদ্ধৃত করিয়া আমার মতের সমর্থক প্রমাণ দিয়াছিলাম ৷ বইখানির তেমন প্রচার না হওয়ায় আমার অভিমত শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাই ৷ বীরভূম-বিবরণ তৃতীয়খণ্ডের রচনার সময় আমার ধারণা ছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবিই পদাবলী-প্রচলিত দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণিতার পদগুলি রচনা করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু পুনঃপুনঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পাঠ করিয়া এখন সে মত পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছি৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে দ্বিজ চণ্ডীদাস পৃথক্ ব্যক্তি এবং তিনি মহাপ্রভুর সমসাময়িক কবি ৷ তবে এ কথা ঠিক যে দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বংশীখণ্ডের এবং রাধাবিরহখণ্ডের প্রচুর প্রভাব আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সুর—
বড়ায়ি গো কত দুখ কহিব কাহিনী ৷
দহ বুলি ঝাঁপ দিল সে মোর সুখাইল লো
মুই নারী বড় অভাগিনী ৷৷
অথবা
সুখ দুখ পাঁচ কথা কহিতে না পাইল ৷
ঝালিয়ার জল যেন তখনই পালাইল ৷৷
একেবারে দ্বিজ চণ্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগের বাঁধা সুর ৷ বংশীখণ্ডের ‘কেনা বাঁশী বাএ বড়াই কালিনী নঈ কুলে’— বুক ভাঙা আকুলতায় দ্বিজ চণ্ডীদাসকেও অতিক্রম করিয়াছে৷
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন লইয়া যাঁহারা আলোচনা করিয়াছেন তাঁহারা আজিও ইহার সম্পূর্ণ মর্ম বুঝিতে পারেন নাই ৷ আমি তাঁহাদের অবগতির জন্য কয়েকটি সূত্রের সন্ধান দিতেছি ৷
১৷ জয়দেবের অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মঙ্গলকাব্য ৷ মঙ্গলকাব্যের যে লৌকিক ধারা, তাহার মধ্যে দুইটি ধারা প্রধান ৷ প্রথম ধারা বিরুদ্ধপক্ষের ভক্তকে নানা দুঃখ-কষ্ট দিয়া আপনার মতের সুদৃঢ় সমর্থনকে রূপান্তরিত করা ৷ উদাহরণঃ মনসামঙ্গলের চাঁদ সদাগর, চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি সদাগর ৷ দ্বিতীয় ধারায় বিরুদ্ধপক্ষের অভক্তকে বধ করিয়া আপন ভক্তের বিজয় ঘোষণা ৷ যেমন ধর্মমঙ্গলের লাউসেন ধর্মের কৃপায় কালীভক্ত ইছাই ঘোষকে বধ করিয়া ধর্মঠাকুরের মহিমা প্রকাশ করিয়াছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রথম ধারার অন্তর্গত কাব্য ৷ মনসামঙ্গলের চাঁদ সদাগর হেঁতালের বাড়ি মারিয়া মনসার ঘট ভাঙ্গিয়া দিয়াছেন ৷ ধনপতি চণ্ডীর ঘটে লাথি মারিয়াছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শ্রীকৃষ্ণপ্রেরিত ফুল পান বড়ায়ি-এর হাত হইতে লইয়া রাধা দুপায়ে দলিয়াছেন ৷ বড়ায়িকে চড় মারিয়াছেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ নানা ছলে কৌশলে শ্রীরাধাকে আপনার করিয়া লইয়াছেন ৷ মনসামঙ্গলে, চণ্ডীমঙ্গলে চাঁদ সদাগর, ধনপতি সদাগর পুরুষ ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা রমণী ৷ সুতরাং আত্মসাতের পদ্ধতি পৃথক হইতে বাধ্য ৷
২৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ‘বাণখণ্ড’ সকলেই দেখিয়াছেন ৷ কিন্তু বাণখণ্ডের প্রকৃত রহস্য কেহই উদ্ঘাটন করেন নাই ৷ বহুদিন পূর্বে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় আমি ‘রসশাস্ত্র এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাম দিয়া একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম— দেখিতেছি সে প্রবন্ধও কাহারো দৃষ্টিপথে পড়ে নাই ৷ আদিরসের দুই ভাগ, বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ ৷ বিপ্রলম্ভ চারি ভাগে বিভক্ত ৷ পুরাতন মতে এই চারি ভাগ-পূর্বরাগ, মান, প্রবাস ও করুণ ৷ করুণাখ্য বিপ্রলম্ভের লক্ষণ ”যুনো রেকতরস্মিন্ গতবতি লোকান্তরং পুনর্লভ্যে”৷ যুবক-যুবতীয় দুই জনের মধ্যে একজন লোকান্তরিত হইবেন এবং পুনরায় সেই দেহেই তাহাদের মিলন ঘটিবে ৷ ইহাই করুণাখ্য বিপ্রলম্ভ৷ লোকান্তর অর্থে মৃত্যুও হইতে পারে, কিংবা অন্য কোনো লোকও হইতে পারে ৷ কাদম্বরীতে চন্দ্রাপীড়ের মৃত্যু হইয়াছিল, কিন্তু দেহটি অবিকৃত ছিল এবং পুনরায় সেই দেহেই কাদম্বরীর সঙ্গে চন্দ্রাপীড়ের মিলন ঘটিয়াছিল ৷ লোকান্তর, শকুন্তলাকে তাহার মাতা মেনকা অপ্সরাতীর্থ হইতে অপহরণপূর্বক কশ্যপের আশ্রমে লইয়া যান ৷ শকুন্তলা সেইখানেই ছিলেন৷ মহারাজা দুষ্মন্তের স্বর্গ হইতে ফিরিবার পথে তাঁহার সঙ্গে সেখানেই পুনর্মিলন হইয়াছিল৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বাণখণ্ডে এই করুণাখ্য বিপ্রলম্ভ বর্ণিত হইয়াছে৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পূর্বরাগ মান, করুণ এবং প্রবাস আছে ৷ একেবারে বিপ্রলম্ভের সম্পূর্ণ বর্ণনা ৷
বাণখণ্ডে কৃষ্ণ বড়ায়িকে বলিতেছেন— আমি রাধাকে মন্মথ বাণ মারিব ৷ বড়ায়ি কৃষ্ণকে সমর্থনপূর্বক বিশেষরূপে উত্তেজিত করিতেছেন৷ বলিতেছেন—
হান পাঁচবাণে তাক না করিহ দয়া ৷
গোয়লিনী রাধার খণ্ডুক সব মায়া ৷৷
কথা কয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ৷ সব মায়া খণ্ডনের অর্থ—সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি নহে ৷ তিনি বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী, এই স্মৃতি তাঁহার জাগ্রহ হউক ইহাই নিগূঢ়ার্থ ৷ বড়ায়ি বলিতেছেন —
ত্রিজগতে নাথ তোহ্মে দেব বনমালী ৷
তোহ্মাকে না করে ভয় রাধা চন্দ্রাবলী ৷৷
উলটিঞা সে যাচু তোহ্মাকে যতনে ৷
গাইল বড়ু চণ্ডীদাস বাসলী গণে ৷
এই বাণখণ্ড হইতেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ধারা পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে ৷ বংশীখণ্ডে ও রাধাবিরহে শ্রীরাধাই কৃষ্ণকে প্রার্থনা করিয়াছেন । আর পূর্ব পূর্ব পালায় যে সমস্ত কথা বলিয়া রাধা কৃষ্ণকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন— কৃষ্ণ রাধাকে ঠিক সেই কথা বলিয়া গালাগালি সুদ-সহ শোধ করিয়া দিয়াছেন ৷ বাণ মারিবার পূর্বে বড়ায়ি রাধাকে কৃষ্ণের নিকট যাইতে বলিয়াছেন, রাধা সে কথায় কর্ণপাত করেন নাই ৷ আবার বাণের ভয়ে কৃষ্ণকে কত যে কাকুতি করিয়াছেন রাধা, তাহার সংখ্যা হয় না ৷ কিন্তু কৃষ্ণ তাঁহাকে ফুলশরাঘাতে মারিয়া ফেলিয়াছেন ৷ যে বড়ায়ি রাধাকে বাণ মারিবার জন্য কৃষ্ণকে উত্তেজিত করিতেছিলেন, এখন রমণী-হত্যার জন্য সেই বড়ায়ি তাঁহাকে বাঁধিয়াছেন ৷ সখীগণ কত কটূক্তি করিয়াছেন ৷ শেষে রাধাকে কৃষ্ণ জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন ৷
লক্ষ্য করিবার বিষয় — শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আক্ষেপানুরাগের পদ আছে ৷ কিন্তু প্রেমবৈচিত্ত্য নাই ৷ আর সুদূর প্রবাসের পর যে সমৃদ্ধিমান সম্ভোগ রসশাস্ত্রসম্মত, চণ্ডীদাস এই বাণখণ্ডেই রাধার চেতনালাভের পর তাহার বর্ণনা দিয়াছেন৷
৩৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ঝুমুর গানের ধারায় রচিত ৷ সঙ্গীতদামোদরে ঝুমুরের সংজ্ঞা —
প্রায়ঃ শৃঙ্গারবহুলা মাধ্বীকমধুরা মৃদুঃ ৷
একৈব ঝুমরি র্লোকে বর্ণাদি নিয়মোজ্ঝিতা ৷৷
শৃঙ্গার রহবহুলতা, মধুজাত সুরার ন্যায় মৃদুতা এবং বর্ণাদির কোনো নিয়ম না থাকা ঝুমুরের লক্ষণ ৷ ‘বর্ণাদি নিয়ম নাই অনিবদ্ধ গীতে’৷ সুতরাং ঝুমুর অনিবদ্ধ গীত ৷ শ্রীমান্ রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁহার সঙ্গীতসমীক্ষা গ্রন্থে অনুমান করিয়াছেন প্রাচীন ঝোম্বড়াই এখন ঝুমুর নামে পরিচিত ৷ তিনি বলিয়াছেন প্রবন্ধ গানের তিন বিভাগ— সূড়, আলি, বিপ্রকীর্ণ ৷ শুদ্ধ সূড় হইতেছে আটটি ৷ সিংঘ ভূপাল ইহাদের মার্গসূড় বলিয়াছেন ৷ এইগুলি হইতেছে এলা, করণ, ঢেঙ্কী, বর্তনী, ঝোম্বড়া, লম্ভ, রাসক এবং একতালী ৷ ঝোম্বড়া প্রবন্ধে উদ্গ্রাহের প্রথমার্ধটি দুইবার ও উত্তরার্ধটি একবার গাওয়া হয় ৷ তাহার পর বিকল্পে গমক-সংযুক্ত প্রয়োগাত্মক মেলাপকের অনুষ্ঠান হয় ৷ অবশ্য এটি যে হইবেই এমন কোনো বাঁধাবাধি নিয়ম নাই ৷ কল্পিনাথ বলিয়াছেন, এটি একেবার অক্ষরবর্জিত প্রয়োগ হইবে এমন নহে ৷ কিছু বাচক পদযুক্ত হইতে পারে ৷ ইহার পরে দুইবার ধ্রুব অংশটি গাওয়া হয় ৷
ঝোম্বড়া প্রবন্ধে দশটি তাল প্রশস্ত ৷ কল্পিনাথ বলিয়াছেন, এই দশটির মধ্যে যে কোনো একটি অবলম্বন করিয়া গাওয়াই নিয়ম ৷ সবগুলি একত্র করিয়া ঝোম্বড়ার সংখ্যা হইল নব্বুই ৷ আরও কয়েকটি ভেদ যেমন মাতৃকা, শ্রীপতি, সোম, রুচিত ,সঙ্গত প্রভৃতি অপ্রসিদ্ধ হওয়ায় শার্ঙ্গদেব ইহাদের পরিচয় দেন নাই ৷
বিশেষ বিনিয়োগ অনুসারে এই নব্বুইটি ঝোম্বড়ার তেরটি করিয়া ভেদ হইতে পারে৷ যথা- ব্রহ্মা, চক্রেশ্বর, বিষ্ণু, চণ্ডিকেশ্বর,নরসিংহ, ভৈরব, হংস, সিংহ, সারঙ্গ, শেখর, পুষ্পসার, প্রচণ্ডাংশু ৷
উপমা, রূপক, শ্লেষ এই তিনটি অলঙ্কারে বদ্ধ ঝোম্বড়ার নাম ব্রহ্মা ৷ … সম্ভবত অধুনা প্রচলিত ঝুমুরের আদিরূপ এই ঝোম্বাড়া ৷ ইহারই একটি শ্রেণীর ক্রমে ঝুমুর নামে রূপান্তরিত হইয়োছে৷
আমার অনুমান শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ‘ব্রহ্মা’ ঝোম্বড়ার অন্তর্ভুক্ত ৷ পদাবলীতে আছে — ‘ঝুমুরী গাহিছে শ্যাম বাঁশী বাজাইয়া’ ৷ ‘ঝুমরী দাদুরি বোল’ ইত্যাদি ৷ ঝুমুর গানের আর একটি লক্ষণ— সম্পর্ক পাতাইয়া দুই দলে গান আরম্ভ করা হয় ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে প্রথম দিকে যেমন রাধিকা মামী হইয়া ভাগিনের কৃষ্ণকে চাপান দিয়াছেন — দ্বিতীয় দিকে তেমনই কৃষ্ণ ভাগিনেয় হইয়া মাতুলানী রাধাকে চাপান দিয়াছেন৷ মঙ্গলকাব্যে চাঁদ সদাগর মনসাদেবীকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়াছেন৷ চণ্ডীমঙ্গলে ধনপতি সদাগর চণ্ডীকে যাহা মুখে আসিয়াছে তাহাই বলিতে সঙ্কোচবোধ করেন নাই ৷ শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তনের বৈশিষ্ট্য— রাধা এবং কৃষ্ণ উভয়েই উভয়কে যাহা খুশি বলিয়াছেন ৷ ইহাই ঝুমুরের সম্পর্ক পাতানোর উদাহরণ ৷ পদের মধ্যেও ঝুমুর গানের ধারা অতি সুস্পষ্ট ৷
যশোদার পোঅ আহ্মে হাথে ধরী বাঁশী ৷
তোমাকে দেখিল রাধা অধিক রূপসী ৷৷ দানখণ্ড ৷
যশোদার পোঅ আহ্মে নাম গোবিন্দ ৷
তোর রূপ দেখিঞা চক্ষুত নাইসে নিন্দ ৷৷ দানখণ্ড ৷
এই যে বিনা কারণে নিজের পরিচয় দিয়া রাধাকে তাহার রূপের কথা বলা, আপন মনের অবস্থা জানানো — ইহা ঝুমুর গানের বিশিষ্ট লক্ষণ ৷ বাণখণ্ডে—
তিরি বধিয়া কাহ্নাঞি ল
কাহ্নাঞি মোরে নাহি ছো ৷
মোরে নাহি ছো কাহ্নাঞি বারানসী য ৷
অঘোর পাপে তোর বেয়াপিল গা ৷
ইহা ঝুমুরের নাচের ছন্দ ৷
বড়ায়ির নিকটে রাধার সমস্ত পরিচয় জানিয়াও কৃষ্ণ রাধাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তুমি কে, কোথায় যাইতেছ ? রাধা উত্তর দিতেছেন৷ (দানখণ্ড) রাধা বড়ায়িকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, বাঁশী কেমন, কৃষ্ণ কেমনে করিয়া বাঁশী বাজায়৷ বড়ায়ি উত্তর দিয়াছেন৷ (বংশীখণ্ড) বাঁশীর গান শুনিয়া রাধা রন্ধনে বিষম গোলমাল করিয়া ফেলিয়াছেন, বড়ায়িকে এই কথা বলিলে বড়ায়ি বলিলেন, এক রাঁধিতে গিয়া অন্য রাধিয়াছ বলিতেছ, সেটা কি রকম তাহার তালিকাটা শোনাও, রাধা অমনি বলিতে আরম্ভ করিলেন— অম্বলে বেশর দিয়াছি ইত্যাদি, এ সমস্তই ঝুমুর গানের ধারা ৷ বৃন্দাবনখণ্ডে কৃষ্ণ ফুলের সঙ্গে রাধার দেহটিকে মিলাইয়াছেন ৷ বাণখণ্ডে রাধা স্বর্গের দেবতাদের ধরিয়া নিজের দেহরক্ষা করাইয়াছেন ৷ লক্ষ্য সাধারণ শ্রোতা ৷
কবি জয়দেব শ্রীগীতগোবিন্দের অধিষ্ঠানভূমি প্রস্তুত করিয়াছেন — শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং ভগবান্ এই মহাসত্যের উপরে ৷ তাহার পরও মাঝে মাঝে সর্গান্ত শ্লোকে অথবা সর্গের মধ্যে কিংবা সর্গারম্ভে বার বার আমাদিগকে সে কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন৷ চণ্ডীদাসও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের জন্মখণ্ডে কৃষ্ণাবতারের কারণ বর্ণনা করিয়াছেন ৷ কৃষ্ণের সম্ভোগ জন্য লক্ষ্মীদেবীই দেবগণের প্রার্থনায় রাধারূপে অবতীর্ণা হইয়াছেন সে কথাও বলিতে বিস্মৃত হন নাই ৷ তাহার পর শ্রীকৃষ্ণ পুনঃ পুনঃ শ্রীরাধাকে আপন পরিচয় দিয়াছেন ৷
আমিই বেদ উদ্ধার করিয়াছি মীনরূপে ৷ বরাহরূপে ধরণীর উদ্ধারসাধন করিয়াছি, রামরূপে রাবণের হন্তারক আমি, কতবারই তো বলিয়াছেন ৷ কিন্তু রাধা একটিবারও কৃষ্ণের কথা বিশ্বাস করেন নাই৷ শ্লেষের সঙ্গে কটুবাক্য বলিয়া বার বার সে কথায় উপেক্ষা করিয়াছেন ৷ রাধা বলিলেন —
বল না কর মোরে কাহ্নাইল
আল বচন আহ্মার শুন ৷
দেবধরম কি সহিব তোরে
এহাত হৃদয়ে গুণ ৷৷
শ্রীকৃষ্ণ উত্তর দিলেন — (পাঠককে সর্বদাই এই উত্তর মনেরাখিতে হইবে ৷)
তবেসিঁ ধরমের ভয় রাধা ল
আল যদি মোএঁ হরোঁ পর নারী ৷
আপন অঙ্গের লখিমী হইআঁ
তোহ্মে না চিহ্নসি অনন্ত মুরারী ৷৷
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দুই একটি ভিন্ন বাকি সমস্ত পালাগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ৷ এই ধরনের প্রত্যেক পালাতেই এমন সব উত্তর-প্রত্যুত্তর আছে যেন ইহার পূর্বে রাধা-কৃষ্ণের পরস্পর পরিচয় ছিল না, কিংবা তাহাদের মধ্যে মিলন ঘটে নাই ৷ যমুনাখণ্ডে কবি নিজেই বলিয়া দিয়াছেন যেন পরিচয় নাই, পরিহাসরসে দেব দামোদর সেইভাবেই রাধার সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন ৷ রাধাও সঙ্গে সঙ্গে যথাযোগ্য উত্তর দিয়া চলিলেন ৷ প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সংস্কৃত শ্লোকগুলি কবির স্বরচিত ৷ শ্লোকগুলির মধ্যে কবিত্বের পরিচয় আছে ৷
বৃন্দাবনখণ্ডে শ্রীরাধার আত্মনিবেদন চরম উৎকর্ষের শেষ প্রান্তে পরম সার্থকতা লাভ করিয়াছে ৷ গোপীগণকে কোন্ উপায়ে ভুলাইতে হইবে, শ্রীরাধাই কৃষ্ণকে তাহা বলিয়া দিয়াছেন ৷ কিন্তু রাধার পরামর্শ অনুসারে গোপীগণকে সন্তুষ্ট করিয়া কৃষ্ণ যখন রাধা-সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন, তখন রাধাই তাঁহাকে তিরস্কার করিয়া ফিরাইয়া দিলেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ ‘যদি কিছু বোল বোলসি’ — জয়দেবের ‘বদসি যদি’ গান করিয়া রাধার মান ভাঙ্গাইতে না পারিয়া রসান্তরের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন ৷ বৃন্দাবনে ফুলের ডাল ভাঙ্গিয়া গাছ নষ্ট করিবার অপবাদ দিলেন ৷ রাধার অন্তরে অভিমানের পরিবর্তে ক্রোধ আসিয়া দেখা দিল ৷ সুযোগ বুঝিয়া কৃষ্ণ পুনরায় রাধার স্তুতি করিতে লাগিলেন ৷ রাধার অন্তর হইতে ক্রোধ গেল, বলিলেন—
তোমার আহ্মার দুই মনে ৷
এক করি গান্থিল মদনে ৷৷
তার অনুরূপ বৃন্দাবনে ৷
তোর বোল না করিব নেহে ৷
একই পরাণ এক দেহে ৷৷
সে নেহ তিয়জ নাহি সহে ৷
সে পুনি আহ্মার দোষ নহে ৷৷
বিশ্বের প্রেমিকা নায়িকাগণের কণ্ঠে দেশে দেশে যুগে যুগে এই বাণীই উচ্চারিত হইয়াছে৷ চণ্ডীদাস এই শাশ্বত বাণীরই গীতি-কবি৷ ডক্টর শ্রীমান সুকুমার সেন বলিয়াছেন, ”পাত্র-পাত্রী ইহাতে তিনটি মাত্র —কৃষ্ণ, বড়ায়ি, রাধা ৷ তিনটি চরিত্রই নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে; তন্মধ্যে রাধা-চরিত্রের বিকাশে ও পরিণতিতে কবি দক্ষতা ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়াছেন তাহা পুরানো বাঙ্গালা সাহিত্যে দ্বিতীয়-রহিত ৷ তাম্বুলখণ্ডে যে চন্দ্রাবলী রাহীর সহিত আমাদের প্রথম পরিচয় হইল সে সংসার অনভিজ্ঞা রূঢ় অথচ সত্যভাষিণী অশিক্ষিতা গোপবালিকা ৷ কিন্তু কবি প্রত্যেক ঘটনায় অসামান্য কৌশলে এই মূঢ় বালিকাচিত্তের উন্মেষ ও জাগরণ দেখাইয়া যখন পাঠককে শেষ পালায় লইয়া আসিলেন তখন দেখি সেই গোপকন্যা কখন যে শাশ্বতরসিকচিত্ত-বলভীর প্রৌঢ় পারাবতী শ্রীরাধায় পরিণত হইয়াছেন, তাহা জানিতে পারি নাই ৷”
ডক্টর সেনকে আমি এজন্য অজস্র আশীর্বাদ জানাইয়াছি ৷ কিন্তু আমার মতে চণ্ডীদাসের রাধা মূঢ়া গোপবালিকা নহেন ৷ তিনি রসশাস্ত্রসম্মত সর্বগুণান্বিতা নায়িকা ৷ বাহু তুলিলে কেশবন্ধন ছলে প্রভৃতি কৃষ্ণের উক্তির তিনি যে তীক্ষ্ণ সরস উত্তর দিয়াছেন, তাহা হইতেই আমার কথার সত্য প্রমাণিত হইবে ৷ অনেকে আবার কৃষ্ণচরিত্রের কোনো মহিমাই বুঝিতে পারেন না ৷ এই ত্রিদশের নাথ দেবরাজকে দেখিতে জানিলে এবং মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুসরণ করিতে পারিলে, তাঁহারা দেখিতেন যে মহাকবির হাতে ভক্তের ভগবান যথাযথরূপেই উজ্জ্বলবর্ণে চিত্রিত হইয়াছেন ৷ দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড হইতে ভারখণ্ড ছত্রখণ্ড প্রভৃতি খণ্ডেই ইহার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাইবে ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধাবিরহের চাতুর্মাস্য আছে, আবার বাঁশী শুনিয়া রাধার চারি প্রহর রাত্রির ও স্বপ্নদর্শনে চারি প্রহর রাত্রির আকুলতার পরিচয় আছে ৷ ছন্দের দর্পিত গতি এবং ভাষার পারিপাট্যও লক্ষণীয় ৷ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কবিত্বপূর্ণ একখানি গীতিকবিতার সম্পুট ৷
কেতুগ্রাম পালরাজত্বের সময়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল ৷ নগেন্দ্রনাথ বসু বর্ধমান সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনকালে কেতুগ্রাম হইতে একটি চামুণ্ডা মূর্তি লইয়া গিয়াছিলেন৷ মূর্তিটি সাহিত্য পরিষৎ মন্দিরে আছে ৷ কেতুগ্রামের স্তূপগুলির প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি ৷