দ্বিজ চণ্ডীদাসের পরিচয় অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই ৷ কিন্তু তিনি যে শ্রীমান্‌ মহাপ্রভুর সমসাময়িক অথবা অব্যবহিত পরবর্তী সে বিষয়ে কোন সংশয় নাই৷ দ্বিজ চণ্ডীদাস একজন পৃথক্‌ কবি, তিনি বড়ু চণ্ডীদাস নহেন, দীন চণ্ডীদাসও নহেন ৷ দ্বিজ চণ্ডীদাস মহাকবি৷ শ্রীরাধার পূর্বরাগ হইতে আরম্ভ করিয়া — মাথুর বিরহ তথা বিরহান্ত মিলনে — সর্বত্রই একজন মহাকবির স্বাক্ষর সুস্পষ্ট ৷ ডক্টর শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় আমি যে চণ্ডীদাস-পদাবলী সম্পাদনা করিয়াছিলাম, তাহার মধ্যেই দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদগুলি সাজাইয়া দিয়াছিলাম৷ সেই পদসমূহ আলোচনা করিলেই বুঝিতে পারা যায়, সমস্ত পদ একজন কবিরই রচনা ৷ পদাবলীর মধ্যে কোথাও কোন অসামঞ্জস্য নাই৷
দ্বিজ চণ্ডীদাসকে আমি বাসুদেব সার্বভৌমের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া মনে করি ৷ বিশারদের চারি পুত্র —সার্বভৌম, বিদ্যাবাচস্পতি, কৃষ্ণানন্দ এবং চণ্ডীদাস ৷ আমার অনুমান, এই চণ্ডীদাসই দ্বিজ ভণিতার পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন ৷ ইনি মহাপ্রভুর সমকালীন ব্যক্তি ৷
‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ এই পদে শ্রীমান্‌ মহাপ্রভুর প্রভাব সুস্পষ্ট ৷ ‘কেমনে বা পাসরিব তারে’ ইহার মধ্যে বিদগ্ধ মাধবের ছায়া আছে ৷ ঐ এক ছত্রেই চণ্ডীদাসের শ্রীরাধাকে চিনিতে পারা যায় ৷
‘ঘরের বাহিরে দন্ডে শতবার তিলে তিলে আইসে যায়’ এই পদটি উজ্জ্বলনীলমণির নিম্নোক্ত শ্লোকের মর্মানুবাদ ৷
ত্বমুদবসিতান্নিষ্ক্রামন্তী পুনঃ প্রবিশন্ত্যসৌ
ঝটিতি ঘটিকামধ্যে বারান্‌ শতং ব্রজসীমনি ৷
অগণিত-গুরুত্রাসা শ্বাসান্‌ বিমুচ্য বিমুচ্য কিং
ক্ষিপসি বহুশো নীরারণ্যে কিশোরি দৃশোর্দ্বয়্‌ম ৷৷
(পূর্বরাগ)

কিশোরী কেন মুহূর্তমধ্যে শীঘ্র শীঘ্র শতবার গৃহ হইতে ব্রজসীমায় যাতায়াত করিতেছ ৷ কেনই বা গুরুজনের ভয়কে তুচ্ছ করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে করিতে কদম্বকাননে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছ :
‘রাধার কি হলো অন্তরে ব্যথা’ এই পদেরও মূল আছে উজ্জ্বলনীলমণির মধ্যে৷
আহারে বিরতিঃ সমস্তবিষয়গ্রামে নিবৃত্তিঃ পরা
নাসাগ্রে নয়নং তদেতদপরং যচ্চৈকতানং মনঃ৷
মৌনঞ্চেদমিদঞ্চ শূন্যমখিলং যদ্বিশ্বমাভাতি তে
তদ্‌ব্রূয়াঃ সখি যোগিনী কিমসি ভোঃ কিংবা বিয়োগিন্যসি৷৷
(ব্যভিচারিপ্রকরণ শ্লোক )
এই শ্লোকটি সাহিত্যদর্পণ ৪র্থ পরিচ্ছেদে আছে ৷ সুতরাং শ্লোকটি পুরানো ৷ বলিবার উপায় নাই যে দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদ পড়িয়া কেহ সেই ভাবের শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন ৷ সাহিত্যদর্পণে উদ্ধৃত থাকায় প্রমাণিত হইতেছে, দ্বিজ শ্লোকের অনুবাদেই পদ রচনা করেন ৷ ঘরের বাহিরে পদের মূল উজ্জ্বলনীলমণিতে থাকায় কবি যে পরবর্তী তাহাই প্রমাণিত হইল ৷ দ্বিজ চণ্ডীদাসের রাধা শ্রীকৃষ্ণের নাম শুনিয়াছেন, বংশী-সঙ্কেত শুনিয়াছেন, পরে সাক্ষাতেও দেখিয়াছেন ৷ কৃষ্ণকে ভাল না বাসিয়া তাহার উপায় ছিল না ৷ আর ভালবাসিয়াই তাহার সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে ৷ সংসার গিয়াছে, স্বজন গিয়াছে, লজ্জা ধৈর্য এমন কি দৈহিক চেতনাও গিয়াছে; আপনার বলিতে আর কিছুই নাই ৷ কিন্তু সব হারাইয়াও তাহার শান্তি নাই,সোয়াস্তি নাই ৷ লোকে তাহার শিরে কলঙ্কের পশরা তুলিয়া দিয়াছে; দিবারাত্রি যেখানে সেখানে তাহারই কলঙ্কের কাহিনী কহিয়া বেড়াইতেছে৷ এ দুঃখ রাখিবার স্থান নাই ৷ এ দুঃখ শুনাইবার লোক নাই ৷ এত বড় পৃথিবীতে এমন কেহ মরমী নাই যাহাকে এই দুঃখের কথা বলিয়া মনের ভার লাঘব করা যায় ৷ দ্বিজ চণ্ডীদাসের দুঃখ—
গোকুল নগরী মাঝে এতেক রমণী আছে
তাহে কোন না পড়িল বাধা ৷
নিরমল কুলখানি যতনে রেখেছি আমি
বাঁশী কেনে বলে রাধা রাধা ৷৷
গোকুলে তো অসংখ্য রমণী ৷ বাঁশী কি আর কাহারো নাম জানে না, নাম শোনে নাই; আর কাহাকেও ডাকিতে পারে না? নির্মল কুলশীল লইয়া আপন অন্তঃপুরে কেমন নিশ্চিত ছিলাম আমি, বাঁশী কেন আমারই নাম ধরিয়া ডাকিল ! কি আকুল আহ্বান তার, কি দুর্বার আকর্ষণ ! বাঁশী কি জানে না, অবরোধে বন্দিনী আমি ৷ একাকী সহায়হীনা অবলা আমি ৷ এই কঠোর পাষাণ-প্রাকারের বেষ্টনী ভাঙ্গিয়া পথে বাহির হওয়া আমার পক্ষে কত কঠিন ৷ আর পথ,—পথে বাহির হইয়াও তো পরিত্রাণ নাই, পৌঁছিতে হইবে তো লক্ষ্যস্থল বংশীবাদকের পদপ্রান্তে ৷ সে পথ কত কণ্টাকাকীর্ণ, কত কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল, কত বন্ধুর, কত দুর্গম ৷ এদিকে সংসার, স্বজন-পরিজন, কেহ তো আপনার নয়, কেহ তো আপনার হইল না ৷ আর নিজের ইন্দ্রিয় গ্রাম তাহারাই কি আমার আপনার? তাহারাই কি স্ববশে আছে ৷ শ্রীরাধা বলিতেছেন, —
এ পাপ নয়ন মোর ফিরানো না যায় ৷
আন পথে ধাই, পদ কানু পথে ধায় ৷৷
এ ছার রসনা মোর হইল কি বাম ৷
যার নাম না লইব লয় তার নাম ৷৷
এ ছার নাসিকা মুঞি যত করু বন্ধ ৷
তথাপি দারুণ নাসা পায় শ্যাম-গন্ধ ৷৷
যার কথা না শুনিব করি অনুমান ৷
পরসঙ্গ শুনিতে আপনি যায় কান ৷৷
ধিক্‌ রহু এ ছার ইন্দ্রিয় মোর সব ৷
সদা সে কালিয়া কানু হয় অনুভব ৷৷
চণ্ডীদাস বলে রাই ভাল ভাবে আছ ৷
মনের মরম কথা কার জানি পুছ ৷৷
তাই শ্রীরাধা সঙ্কল্প করিয়াছেন — এদেশে আর থাকিব না ৷ পাপ পিরীতির কথা যেখানে শুনিতে হইবে না সেই দেশে গিয়া বাস করিব ৷ কখনো বা মনে করিতেছেন, প্রিয়তমের তরে যোগিনী হইয়া দেশ হইতে দেশান্তরে ভ্রমণ করিবেন ৷ মনের সঙ্গেই প্রিয়তমের কথা কহিবেন৷ দৈবাৎ যদি কোন মরমী পাওয়া যায়, তাহাকেই মনে কথা বলিবেন; চণ্ডীদাস পরাধীন জীবনকে ধিক্কার দিয়াছেন ৷ কিন্তু তাহারও অধিক ধিক্‌, শত ধিক্কার দিয়াছেন পরবশ পিরীতিকে ৷ আক্ষেপানুরাগের প্রতি পদেই এই হাহাকার ৷ এই বুকভাঙ্গা আকুলতা ৷ কবি বড় দুঃখেই বলিয়াছেন, পিরীতি সুখের সরোবর দেখিয়া স্নান করিতে নামিয়াছিলাম৷ কিন্তু স্নান করিয়া উঠিয়া ফিরিয়া চাহিতেই কোথা হইতে দুঃখের বাতাস আসিয়া গায়ে লাগিল ৷ এই কবিই বলিয়াছেন —
চণ্ডীদাস বাণী শুন বিনোদিনী
সুখ দুখ দুটি ভাই৷
সুখলাভ তরে পিরীতি যে করে
দুখ যায় তার ঠাঁই৷৷
মাথুর বিরহে ঐ একই সুর—
ওপারে বন্ধুর ঘর বৈসে গুণনিধি ৷
পাখী হইয়া উড়ি যাও পাখা না দেয় বিধি ৷৷
কোন অপার সাগরের পরপারে তোমার ঘর বন্ধু ৷ গৃহ-কারাগারে অবরুদ্ধা ক্ষুদ্রা রমণী আমি, আমার পাখা নাই যে উড়িয়া গিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব ৷
কবি যেখানে পরাধীন জীবন ও পরবশ প্রেমকে ধিক্কার দিয়াছেন সেখানে বলিয়াছেন, শীতল বলিয়া যদি পাষাণকে আলিঙ্গন করি, পিরীতি-অনলতাপে পাষাণ গলিয়া যায় ৷ ছায়া দেখিয়া যদি তরুলতার বনে গিয়া বসি, লতাপাতা-সনে তরু জ্বলিয়া যায়, যমুনার জলে ঝাঁপ দিলে প্রাণ জুড়ায় না, আরো উত্তপ্ত হইয়া উঠে ৷
আর, এখানে বলিতেছেন—আগুনেতে ঝাঁপ দিই, আগুন নিভিয়া যায়, তরুতলে গিয়া ছায়া পাই না ৷ পাষাণকে কোল দিয়া দেখি, (বক্ষে পাষাণ চাপাইতে চাই) পাষাণ মিলাইয়া যায় (অন্তর্হিত হয়)৷ যমুনায় ঝাঁপ দিব কি, সাঁতার জানি না তো, ওপারে পৌঁছিব কিরূপে ?
পুনর্মিলনেও সেই একই সুর ৷ ‘বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে ৷ দেখা না হইত পরাণ গেলে ৷’ এলে বন্ধু,বহুদিন পর এলে, ভাগ্যে দেহে প্রাণ ছিল, তাই দেখা হইল ৷ প্রাণ গেলে তো দেখিতে পাইতাম না ৷ কোন অনুযোগ নাই, তিরস্কার নাই৷ বলিতেছেন—
দুখিনীর দিন দুখেতে গেল ৷
মথুরা নগরে ছিলে তো ভাল ৷৷
আমি তো চিরদুখিনী, দুখিনীর দিন দুঃখেই অতিবাহিত হইবে ৷ এ আর বেশী কথা কি? কিন্তু তুমি তো কুশলে ছিলে বন্ধু? এ সব দুঃখ আর মনে পড়িতেছে না, গণনার মধ্যেই আনি না অতীত দুঃখ ৷ এমন তোমার কুশলেই কুশল মানিতেছি ৷
পদাবলীর এই চিত্রেই দ্বিজ চণ্ডীদাসের প্রকৃত পরিচয় ৷
স্বর্গত শিবরতন মিত্র একজন দ্বিজ চণ্ডীদাসের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন ৷

আছিল প্রপিতাম দ্বিজ চণ্ডীদাস ৷৷
তাহার নন্দন হয় দ্বিজ রত্নেশর ৷
ঠাকুর জয়ন্তী নাম তাহার কোঙর ৷৷
জয়ন্তী নন্দন সদানন্দ ভণে পায় ৷
সমাপ্ত ভগবদ্‌গীতা অষ্টাদশাধ্যায় ৷৷
* * * *
দ্বিজ চণ্ডীদাস মহেশ পুত ৷ রত্নেশ্বর দ্বিজ চণ্ডীদাস সুত ৷৷

সদানন্দ ভগবদ্‌গীতার অনুবাদ করিয়াছিলেন ৷ পুঁথির লিপিকাল ১২১২ সাল ৷ চারি পুরুষে একশত কুড়ি বৎসর ধরিয়া ১০৯২ সালে চণ্ডীদাসকে পাইতেছি ৷ আমার মনে হয় সদানন্দ নিজেদের দ্বিজত্ব প্রতিপাদন জন্যই ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’, ‘দ্বিজ রত্নেশ্বর’ ইত্যাদি পরিচয় দিয়াছেন৷ এই দ্বিজ চণ্ডীদাস যে কবি ছিলেন, তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ৷ কবি কাশীরাম দাসের পিতা কমলাকান্তের এক সহোজর ছিলেন চণ্ডীদাস ৷ ইঁহাকেই দীন চণ্ডীদাস বলিয়া মনে হয় ৷ অনেক পদে দেব চণ্ডীদাস ভণিতাও পাওয়া যায় ৷ এই বংশে অনেকেই কবি ছিলেন৷ কিন্তু দীন চণ্ডীদাস বিষয়ে সুনিশ্চিত হইবার উপায় নাই ৷