শ্রীচৈতন্যপার্ষদ শ্রীল গদাধর পণ্ডিতের চিহ্নিত সেবক মঙ্গল ঠাকুর, কবি জ্ঞানদাসের কান্দরায় আসিয়া বাস করেন ৷ পণ্ডিতজীউর অনুমতি লইয়া মঙ্গল ঠাকুর মাত্র তিনজনকে দীক্ষা দান করিয়াছিলেন ৷ প্রথম, কাঁকড়া হুসমপুরের একজন চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ ৷ দ্বিতীয়, নিকটবর্তী রাজুর গ্রামের নৃসিংহ মিত্র ৷ গুরুর কৃপালাভপূর্বক ‘মিত্র ঠাকুর’ নামে পরিচিত হইয়া তিনি বীরভূমে ময়নাডাল গ্রামে গিয়া বাস করেন ৷ তৃতীয়, ময়নাডাল-নিবাসী একজন অধিকারী ব্রাহ্মণ ৷ প্রত্যাদিষ্ট হইয়া পরে ইঁহারই কন্যাকে মঙ্গল ঠাকুর বিবাহ করিয়াছিলেন ৷
মঙ্গল ঠাকুরের তিন পুত্র ৷ প্রথম রাধিকাপ্রসাদ, দ্বিতীয় গোপীরমণ, তৃতীয় শ্যামকিশোর ৷ তিন পুত্রের বংশধরগম বড় বাড়ির ঠাকুর, মধ্যম বাড়ির ও ছোট বাড়ির ঠাকুর নামে পরিচিত ৷ বড় বাড়িতে শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র যুগলবিগ্রহ, মধ্যম বাড়িতে শ্রীরাধাকান্ত যুগল-বিগ্রহ ও ছোট বাড়িতে মঙ্গল ঠাকুরের কুলদেবতা শ্রীনৃসিংহ দেব শালগ্রাম, শ্রীগদাধর পণ্ডিতের কৃপাদত্ত শ্রীগৌরাঙ্গগোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন ৷
প্রবাদ আছে, নৃসিংহের মাতার মৃতবৎসা দোষ ছিল ৷ তিনি কাটোয়ায় গঙ্গাস্নানে গিয়া মঙ্গল ঠাকুরের দর্শনলাভ করেন ৷ ঠাকুরের নিকট পুত্র কামনা করিলে ঠাকুর চর্বিত তাম্বুল দিয়া বলেন— এবার তুমি পুত্রসন্তান লাভ করিবে এই সেই পুত্র দীর্ঘজীবী হইবে ৷ রমণী ভাবী পুত্রকে ঠাকুরের চরণে সেবকরূপে সমর্পণের সঙ্কল্প করিয়া গৃহে ফিরিয়া আসেন ৷ এক বৎসরের মধ্যেই তিনি পুত্র প্রাপ্ত হন, এই পুত্রই নৃসিংহ ৷ পুত্র হইল, কিন্তা বোবা ক্ষ্যাপা পুত্র ৷ কথা কহে না, যেখানে সেখানে ঘুরিয়া বেড়ায় ৷ কুলগুরু বলিলেন,— দীক্ষা দাও, সারিয়া যাইবে ৷ দীক্ষার দিন স্থির হইল ৷ দীক্ষার দিনে এগার বৎসরের বোবা পুত্র কথা কহিল ৷ “মা তুমি যে কাটোয়ায় গঙ্গাতীরে কথা দিয়া আসিয়াছ, আমাকে মঙ্গল ঠাকুরের পায়ে সঁপিয়া দিবে ৷ একজনকে কয়জনের নিকট দান করিবে ?” মা তো বোবা ছেলের কথা শুনিয়া অবাক্‌ ৷ তাহাও আবার কাটোয়ার ঘাটের গোপন মনের কথা ৷
এমন সময় খড়ম পায়ে মঙ্গল ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত ৷ তিনিই নৃসিংহকে দীক্ষা দান করিলেন ৷ কুলগুরুও আনন্দিত হইয়া গৃহে ফিরিয়া গেলেন ৷ নৃসিংহের সাধন-ভজন আরম্ভ হইল ৷ অতঃপর গুরুর আদেশে ময়নাডালে গিয়া অচিরকাল মধ্যেই তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন ৷ স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হইয়া তিনি ময়নাডালে শ্রীগৌরাঙ্গ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ এই বিগ্রহ আজিও নৃসিংহের বংশধরগণ-কর্তৃক পূজা প্রাপ্ত হইতেছেন ৷
নৃসিংহের একমাত্র পুত্র হরেকৃষ্ণ ৷ হরেকৃষ্ণের তিন পুত্র, রাজবল্লভ আনন্দ-বল্লভ ও ভুবনবল্লভ ৷ ময়নাডালে তিন পুত্রেরই বংশধর বর্তমান আছেন ৷ এই বংশে বহু খ্যাতনামা কীর্তনগায়ক ও মৃদঙ্গবাদক আবির্ভূত হইয়া বাঙ্গালার মুখ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন ৷ ময়নাডালে কীর্তনের চতুষ্পাঠী ছিল ৷ এই চতুষ্পাঠীতে শিক্ষালাভপূর্বক বহু ব্যক্তি মৃদঙ্গবাদনে ও কীর্তনগানে খ্যাতিলাভ করেন ৷ শিক্ষালাভপূর্বক বহু ব্যক্তি মৃদঙ্গবাদনে ও কীর্তনগানে খ্যাতিলাভ করেন ৷ এমন একদিন ছিল যেদিন ময়নাডালে না আসিলে কীর্তনগায়ক ও মৃদঙ্গবাদকের শিক্ষা সম্পূর্ণ হইত না ৷ পায়র গ্রামের স্বনামধন্য মৃদঙ্গবাদক জটে কুঞ্জদাসের ছাত্র ইলামবাজার-নিবাসী নিকুঞ্জ বাইতি ও ময়নাডালের নিকুঞ্জ মিত্র ঠাকুর সমসাময়িক মৃদঙ্গবাদক, উভয়েই মৃদঙ্গবাদ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করিয়াছিলেন ৷ রসিকানন্দ মিত্র ঠাকুর, বৈকুণ্ঠ মিত্র ঠাকুর প্রভৃতির নাম আজিও কীর্তনগায়কগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করিয়া থাকেন ৷ এই সেদিনও কিশোরী মিত্র ঠাকুর, রাসবিহারী মিত্র ঠাকুর ময়নাডালের মুখ রক্ষা করিয়া গিয়াছেন ৷
১২৭৫ সালের ২৪সে অগ্রহায়ণ রাসবিহারী মিত্র ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ৷ সুধাকৃষ্ণ মিত্র ঠাকুর ইঁহার কীর্তন শিক্ষার আদি গুরু ৷ কিছুদিন বহরমপুরে রামনারায়ণ বিদ্যারত্নের বাড়িতে থাকিয়া ইনি সুপ্রসিদ্ধ কীর্তনগায়ক বৈষ্ণবচরণ ব্রজবাসী মহারাজের নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করেন ৷ কয়েকবার শ্রীধাম বৃন্দাবনে গিয়াও পণ্ডিত বাবাজী প্রভৃতির নিকট শিক্ষালাভ করিয়া আসেন ৷ নৃসিংহ মিত্র ঠাকুর হইতে রাসবিহারী একাদশ অধস্তন পুরুষ ৷ বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ কীর্তনগায়কগণের মধ্যে ইঁহাকে অন্যতমরূপে গণনা করা হইত ৷ ১৩৫৪ সনের ৬ই ফাল্গুন ইনি সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷ পুত্র শ্রীনবগোপাল মিত্র ঠাকুর গীতিসুধাকর ও শ্রীগোবিন্দগোপাল মিত্র ঠাকুর সুধাকন্ঠ কলিকাতায় থাকিয়া পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণপূর্বক ময়নাডালের ধারা রক্ষা করিতেছেন ৷ ময়নাডালের অন্য দুইজন সুগায়কের নাম শ্রীনদীয়ানন্দ ও শ্রীমাণিক মিত্র ঠাকুর ৷