শ্রীপাদ নিত্যানন্দ সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু যোগপট্ট গ্রহণ না করায় স্বরূপ আখ্যায় অভিহিত হইতেন ৷ নিত্যানন্দজীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ স্বীকার— শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর আদেশে দারপরিগ্রহ ৷ সন্ন্যাসী গৃহী হইলে লোকে তাহাকে বান্তাশী বলে ৷ কুকুর যেমন বমিত দ্রব্য ভক্ষণ করে, সেইরূপ যিনি বিরজা হোম করিয়া নিজের পিণ্ড নিজে দিয়া সন্ন্যাসী হইয়াছেন, সমাজের চক্ষে তিনি মৃত ৷ এহেন সন্ন্যাসী গৃহী হইলে লোকে স্বভাবতঃই তাহাকে বান্তাশী বলিবে ৷ এই অপবাদ শিরে ধারণপূর্বক সম্প্রদায়-রক্ষার জন্যই শ্রীমহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রীনিত্যানন্দ গৃহী হইয়াছিলেন ৷
সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা, বসুধা ও জাহ্নবী ৷ নিত্যানন্দ এই দুইজনকে বিবাহ করেন ৷ জাহ্নবী দেবীর সন্তান হয় নাই ৷ বসুধার পুত্র শ্রীবীরচন্দ্র প্রভু ৷ বসুধার একটি কন্যাও হইয়াছিল, নাম গঙ্গাদেবী ৷ শ্রীবীরচন্দ্র জাহ্নবী দেবীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের পরবর্তী বৈষ্ণব-সমাজের সর্বজনমান্য নেতা শ্রীবীরচন্দ্র ৷ শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ বীরচন্দ্র প্রভুর আদেশ নতশিরে গ্রহণ করিতেন ৷ পিতার মত বীরচন্দ্রও বৈষ্ণবধর্ম-প্রচারে জীবন অতিবাহিত করিয়া গিয়াছেন ৷ সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধি রক্ষার বিষয়ে সদাসতর্ক দৃষ্টি এই প্রেমোদ্দাম আচার্য সারা বাঙ্গালায় এবং বাঙ্গালার বাহিরে অকুণ্ঠ কণ্ঠে শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর প্রেমমন্ত্র প্রচার করিয়া বেড়াইয়াছেন ৷
মাধব আচার্যের সঙ্গে গঙ্গাদেবীর বিবাহ হয় ৷ বীরচন্দ্র প্রভুর দুই পত্নী শ্রীমতী ও নারায়ণী ৷ বীরচন্দ্রের তিন পুত্র— গোপীজনবল্লভ, রামকৃষ্ণ ও রামচন্দ্র ৷ কন্যার নাম ভুবনমোহিনী ৷ পার্বতীনাথ ফুলিয়ার মুখুটী ভাবনমোহিনীকে বিবাহ করেন ৷
কান্দরার জয়গোপাল দাস নামক একজন কায়স্থকে বীরচন্দ্র বর্জন করিয়াছিলেন ৷ ভক্তিরত্নাকরে বীরচন্দ্রের সেই আদেশপত্রের প্রতিলিপি পাওয়া যায়৷
নামসঙ্কীর্তন ও লীলাকীর্তন-প্রচারে শ্রীবীরচন্দ্র প্রভুর অক্লান্ত প্রয়াস বৈষ্ণব ইতিহাসের বিষয়ীভূত হইয়া আছে ৷ লীলাকীর্তনে ইঁহার আবেগের কথা শ্রীনরোত্তমবিলাসে অতি সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে ৷ নরোত্তম লীলাকীর্তন আরম্ভ করিয়াছেন —
চারি দিকে বৈষ্ণব মণ্ডলী মনোহর ৷
মধ্যে প্রভু বীরচন্দ্র শোভায় সুন্দর ৷৷
* * * *
* * * *
সুচারু বদনে হরি হরিবোল বলে ৷
ভাসয়ে দীঘল দুটি নয়নের জলে ৷৷
* * * *
* * * *
ভুবনমোহন নৃত্য করয়ে কীর্ত্তনে ৷
হরিষে কুসুম বরিষয়ে দেবেগণে ৷৷
* * * *
* * * *
মহাসিংহনাদ প্রভু করে বারে বারে ৷
নরোত্তম কোলে করি ছাড়িতে না পারে ৷৷
শ্রীদেবীদাসের কর লইয়া ধরে বক্ষে ৷
কি অপূর্ব বাক্য কহি ধারা বহে চক্ষে ৷৷
গোকুলের বদনে শ্রীহস্ত বুলাইয়া ৷
কহিলা কতেক তারে অধের্য্য হইয়া ৷৷
শ্রীগোবিন্দ কবিরাজের দুইট করে ধরি ৷
কহে তুয়া কাব্যের বালাই লৈয়া মরি ৷৷
তুমি সে জানহ নিত্যানন্দের মহিমা ৷
আচার্য্যের অনুগ্রহ তার এই সীমা ৷৷
এত কহি গোকুলে কহয়ে বারে বার ৷
গাও গাও ওহে প্রাণ জুড়াও আমার ৷৷
শুনিয়া গোকুল গায় হৈয়া উল্লসিত ৷
কিবা সে অপূর্ব কবিরাজকৃত গীত ৷৷
কথিত আছে, শ্রীবীরচন্দ্র প্রভু ‘বার শত ন্যাড়া ও তের শত নেড়ী’ নামে বিকৃত বৌদ্ধধর্মের অনুষ্ঠাতা একটি বৃহত্তর দলকে বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ ইহারা বাহিরে গৌর-নিতাই-এর উপাসনা করে, কিন্তু নিজেদের পূর্ব প্রথা রমণীসাধনা আজিও পরিত্যাগ করে নাই ৷ অনেকের মতে আউল, বাউল, সাঁই ও দরবেশ এই সম্প্রদায় হইতে উদ্ভূত হইয়াছেন ৷