চাঘন্দী গ্রামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, নাম গঙ্গাধর ভট্টাচার্য ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর সন্ন্যাস-গ্রহণে তিনি উন্মাদ হইয়া উঠেন ৷ মহাপ্রভুর সন্ন্যাস আশ্রমের নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ৷ এই চৈতন্য নাম তাঁহার জপমালা হইয়া উঠিল ৷ লোকে গঙ্গাধরের নাম দিল চৈতন্যদাস ৷ সাধারণে গঙ্গাধর নামটা প্রায় ভুলিয়াই গেল ৷
গঙ্গাধর বিবাহ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীখণ্ডের নিকটবর্তী যাজী গ্রামের বলরাম দেবশর্মার কন্যা শ্রীমতী লক্ষ্মীপ্রিয়াকে ৷ চৈতন্যদাস ও লক্ষ্মীপ্রিয়ার পুণ্য গীর্বাণবল্লীর অমৃত ফল আচার্য শ্রীনিবাস ৷
আচার্য উপাধি শ্রীনিবাসকে দিয়াছিলেন শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীপাদ জীব গোস্বামী ৷ প্রথম যৌবনেই শ্রীনিবাস শ্রীবৃন্দাবনে গমন করেন ৷ শ্রীগোপাল ভট্ট কৃপা করিয়া তাঁহাকে দীক্ষা দান করিয়াছিলেন ৷ শ্রীজীবের নিকট ব্যাকরণ, অলঙ্কার, দর্শনাদি অধ্যয়নের পর শ্রীনিবাস শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করেন শ্রীল ভট্ট রঘুনাথের নিকট ৷ ভট্ট রঘুনাথ শ্রীমদ্ভাগবতপাঠের যে ধারার প্রবর্তন করিয়াছিলেন, শ্রীনিবাসের কণ্ঠে তাহার সার্থক রূপায়ণ সমগ্র বঙ্গে এক নবভাবের প্লাবন আনিয়াছিল ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভু বলিয়াছিলেন—বেদান্ত দর্শন যাঁহার প্রণীত, তিনিই বেদান্তের অকৃত্রিম ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করিয়াছিলেন ৷ সুতরাং বাঙ্গালায় এই রহস্য গ্রন্থের প্রচারে সহায়ক হইয়া শ্রীনিবাস মহাপ্রভুর আদেশই প্রতিপালন করেন ৷
সমগ্র বঙ্গদেশে শ্রীনিবাস আচার্য্যের অতুলনীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্যতম কারণ মল্লভূমির অধীশ্বর রাঢ়ের স্বাধীন নরপতি শ্রীবীর হাম্বীর আচার্য শ্রীনিবাসের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন ৷ রাজা বীর হাম্বীর যাজীগ্রামেও আগমন করিয়াছিলেন ৷ অনেকে নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া অভিযোগ করেন, বিষ্ণুপুরের রাজা বৈষ্ণব-মন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ করিয়া যুদ্ধবিদ্যা ভুলিয়া গিয়াছিলেন, অর্থাৎ কাপুরুষে পরিণত হইয়াছিলেন ৷ তাঁহারা বিষ্ণুপুরের রাজসৈন্য কর্তৃক দুদ্ধর্ষ বর্গীদল দমনের কথা বিস্মৃত হইয়া থাকেন ৷ রাজ-সৈন্যের অমিত পরাক্রমে বর্গীরা বিতাড়িত হইয়াছিল ৷ বর্গীদের নৃশংস অত্যাচার হইতে অগণিত নরনারীকে রক্ষা করিয়াছিল বিষ্ণুপরের পরাক্রান্ত সৈন্যবাহিনী ৷ বিষ্ণুপুর-প্রসঙ্গে একটি উপাখ্যান আছে— শ্রীবৃন্দাবন হইতে বাঙ্গালায় বিবিধ গ্রন্থ পাঠাইয়াছিলেন শ্রীপাদ জীব গোস্বামী ৷ বহুমূল্য অলঙ্কার অথবা প্রচুর অর্থসম্ভার মনে করিয়া বীর হাম্বীর-প্রেরিত সৈন্যদল পেটিকাগুলি লুণ্ঠন করিয়াছিল ৷ আমরা এই কাহিনী বিশ্বাস করি না ৷ এই পেটিকার অনুসন্ধানে শ্রীনিবাস আচার্য যখন বীর হাম্বীরের রাজসভায় প্রবেশ করেন, তখন রাজসভার পণ্ডিত ব্যাসাচার্য সেখানে শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করিতেছিলেন ৷ রাজা ভাগবত কথা শ্রবণ করিতেছেন, অথচ দুস্যুবৃত্তি করিয়া থাকেন, এ কথা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না ৷ এরূপ কপটাচার বীর হাম্বীরের ছিল না ৷ তিনি ক্ষত্রিয়োচিত রাজমর্যাদাতেই প্রজাপালন করিতেন ৷ তাঁহার রাজ্যে দস্যুতার স্থান ছিল না ৷ কথিত হয়, প্রেরিত গ্রন্থরাজির মধ্যে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতও ছিল ৷ গ্রন্থ চুরির সংবাদ শ্রীবৃন্দাবনে পৌঁছিলে কবিরাজ গোস্বামী শোকে যমুনায় ঝাঁপ দিয়া আত্মহত্যা করিয়াছিলেন ৷ কোন্ পাষণ্ড কোন্ উদ্দেশ্যে এই জঘন্য অলীক আষাঢ়ে গল্প রচনা করিয়াছিল জানি না ৷ নিত্যসিদ্ধ শ্রীকৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত রচনার পরও দীর্ঘদীন মর্ত্যধামে বর্তমান ছিলেন ৷ তাঁহার পক্ষে কোন কারণেই আত্মহত্যা সম্ভবপর ছিল না৷ ‘কর্ণানন্দ’ নামে একখানি জাল পুস্তক আমি দেখিয়াছি ৷ এই ধরনের জাল পুস্তক কয়েকখানি বাজারে চলিতেছে ৷ রামচন্দ্র কবিরাজের মহিমা-প্রচারের উদ্দেশ্যেই কর্ণানন্দ রচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় ৷
শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন ৷ তিনি আচার্য শ্রীনিবাসের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ রামচন্দ্রের অনুরোধেই স্বনামধন্য পদকর্তা গোবিন্দ কবিরাজও শ্রীনিবাসের নিকট দীক্ষিত হইয়াছিলেন ৷ আজিকালিকার তথাকথিত সন্ন্যাসী গুরুগণের অনেকেই কাহাকেও বা শক্তি-মন্ত্রে কাহাকেও বা বৈষ্ণব-মন্ত্রে দীক্ষাদান করেন ৷ ইহা অশাস্ত্রীয় বিধি ৷ পঞ্চকূট শেখরভূমির রাজা হরিনারায়ণ শ্রীনিবাসের নিকট রামমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণের প্রার্থনা নিবেদন করিলে আচার্যদেব দাক্ষিণাত্য হইতে শ্রীগোপাল ভট্টের ভ্রাতুষ্পুত্রকে বাঙ্গালায় আনাইয়াছিলেন ৷ গোপাল ভট্টের ভ্রাতুষ্পুত্রই রাজা হরিনারায়ণকে রামমন্ত্রে দীক্ষাদান করিয়াছিলেন ৷ এই একটি মাত্র ঘটনা হইতে শ্রীনিবাসের ঔদার্য ও নির্লোভতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ শেখরভূমির রাজাকে শিষ্যরূপে পাইলে তাঁহার প্রতিপত্তি আকাশস্পর্শী হইত, আর্থিক সঙ্গতি সর্বোচ্চ শিখরে উঠিত ৷ সে লোভ শ্রীনিবাস অনায়াসে দমন করিয়াছিলেন ৷
শ্রীনিবাসের বংশে বহু সাধক, ভক্ত, সুপণ্ডিত, কবি আবির্ভূত হইয়া বাঙ্গালা দেশকে ধন্য করিয়াছিলেন ৷ শ্রীনিবাসের শিষ্যপরম্পরা বাঙ্গালার আদর্শ গৃহস্থরূপে লোক কল্যাণসাধনায় ব্রতী ছিলেন ৷ শ্রীনিবাস আচার্যের বংশধরগণ আজিও বাঙ্গালায় বর্তমান আছেন ৷ বৈষ্ণব-সমাজের নেতৃস্থানীয় বহু ব্যক্তি এই বংশে আবির্ভূত হইয়াছিলেন ৷ ইঁহাদের মধ্যে পদামৃতসমুদ্রের সঙ্কলয়িতা শ্রীল রাধামোহন ঠাকুরের নাম চিরস্মরণীয় ৷ বাঙ্গালার গভর্নমেন্ট,বাঙ্গালার বৈষ্ণবগণ, বাঙ্গালার সাহিত্যিকগণ সকলেরই কর্তব্য এই পুণ্যশ্লোক আচার্যের পদাঙ্কপূত যাজীগ্রামে কোনরূপ স্মারকচিহ্ন স্থাপন করা ও যাজী গ্রামের উন্নতি সাধন করা ৷