রাজসাহী জেলায় রামপুর বোয়ালিয়ার ছয় ক্রোশ উত্তরে -পশ্চিমে পদ্মানদীর তীরে প্রেমস্থলী নামক স্থান ৷ প্রেমস্থলীর উত্তর-পূর্ব লাগাও খেতরী ৷ কৃষ্ণানন্দ দত্তের রাজধানী ছিল খেতরী ৷ সর্বসাধারণে তিনি রাজা বলিয়াই পরিচিত ছিলেন ৷ কৃষ্ণানন্দের পত্নীর নাম নারায়ণী ৷ এই রাজদম্পতীর পুত্র নরোত্তম ৷ বাল্য হইতেই নরোত্তম শ্রীগৌরাঙ্গের অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন৷ আদরের পুত্র হইলেও পিতা পুত্রের শিক্ষাদানে কার্পণ্য করেন নাই৷
নরোত্তমের বয়স প্রায় বিংশতি বৎসর ৷ পিতা রাজকার্যোপলক্ষে গৌড়দরবারে গমন করিয়াছেন ৷ সুযোগ বুঝিয়া নরোত্তম গৃহত্যাগ করেন এবং অতি কষ্টেই শ্রীবৃন্দাবনে উপস্থিত হন ৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের ব্রজভূমির মণ্ডলেশ্বর শ্রীপাদ জীব গোস্বামীর যত্নে নরোত্তম বৈষ্ণবশাস্ত্রে পারদর্শী হইয়া উঠিলেন ৷ আরো দুইজন বাঙ্গালী যুবক সে সময় শিক্ষালাভার্থ শ্রীবৃন্দাবনে উপস্থিত ছিলেন ৷ ইঁহাদের এক জন শ্রীনিবাস, অন্য জন শ্রীশ্যামানন্দ৷ তিনজনেই বন্ধুত্বের বন্ধন আবদ্ধ হইলেন ৷
শ্রীনিবাস শ্রীগৌরাঙ্গপার্ষদ ছয় গোস্বামীর অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ এই সময় শ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী শ্রীবৃন্দাবনে বাস করিতেছিলেন ৷ যশোহর জেলায় তাড়খড়ি গ্রামে পদ্মনাভ চক্রবর্তী নামে একজন ব্রাহ্মণ বাস করিতেন ৷ ইঁহার পত্নীর নাম সীতা ৷ পদ্মনাভ মাঝে মাঝে নবদ্বীপে সস্ত্রীক আসিয়াও থাকিতেন ৷ শ্রীপাদ মাধবেন্দ্র পুরীর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন, এই সূত্রেই পদ্মনাভ আচার্য শ্রীঅদ্বৈতের সঙ্গে পরিচিত হন ৷ এই সূত্র ধরিয়াই অদ্বৈত-পত্নী সীতাদেবীর সঙ্গে পদ্মনাভ-পত্নী সীতাদেবীর সখীত্ব স্থাপিত হয় ৷ শ্রীলোকনাথ এই পদ্মনাভ চক্রবর্তীর পুত্র ৷ মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিবেন জানিয়া তিনি শোকে অধীর হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং শ্রীবৃন্দাবনে গিয়া উপস্থিত হন ৷ মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক দাক্ষিণাত্যে গিয়াছেন শুনিয়া তিনি দক্ষিণদেশে যাত্রা করেন ৷ দক্ষিণে গিয়া শুনিলেন মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরিয়াছেন এবং তথা হইতে বৃন্দাবনে আসিয়াছেন ৷ লোকনাথ ব্রজধামে ফিরিলেন ৷ শুনিলেন তিনি কয়দিন পূর্বে বৃন্দাবন হইতে প্রয়োগে গিয়াছেন ৷ লোকনাথ প্রয়াগ-গমনে উদ্যত হইলে স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া সে সঙ্কল্প ত্যাগ করেন ৷ শ্রীমহাপ্রভুর সঙ্গে লোকনাথের আর সাক্ষাৎ হয় নাই ৷ ইঁহার প্রতিজ্ঞা ছিল জীবনে কাহাকেও দীক্ষা দান করিবেন না ৷ নরোত্তম সঙ্কল্প করিলেন ইঁহারই নিকট হইতে দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে ৷ লোকনাথের অলক্ষ্যে শৌচস্থান পরিষ্করণপূর্বক নরোত্তম ইঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ৷ নরোত্তমের দৈন্যে আকৃষ্ট হইয়া লোকনাথ কৃপাপূর্বক তাঁহাকে দীক্ষা দান করিয়াছিলেন ৷ কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত রচনার জন্য লোকনাথের অনুমতি প্রার্থনা করিলে লোকনাথ অনুমতি দিয়াছিলেন, কিন্তু গ্রন্থে তাঁহার বিষয়ে কোন কথা লিখিতে নিষেধ করিয়াছিলেন ৷ এইজন্য এই নিষ্কিঞ্চন ব্রহ্মচারীর কথা বিশেষ কিছু জানা যায় না ৷
দীক্ষালাভ এবং বৈষ্ণবশাস্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আজন্ম সঙ্গীতানুরাগী নরোত্তম সঙ্গীতশিক্ষায় মনোনিবেশ করিলেন ৷ তাঁহার সৌভাগ্যক্রমে ভারতের অদ্বিতীয় গীতপারঙ্গম সুপ্রসিদ্ধ শ্রীহরিদাস স্বামী সে সময় ব্রজধামে বাস করিতেছিলেন ৷
মুলতানের অন্তর্গত উছা গ্রাম হরিদাসের জন্মভূমি ৷ শ্রীবৃন্দাবনের পার্শ্বস্থিত রায়পুর গ্রামের গঙ্গাধর নামক এক ব্রাহ্মণের কন্যাকে বিবাহপূর্বক হরিদাস শ্রীবৃন্দাবনে আসিয়া বাস করেন ৷ কিছুদিন পরে পূর্বজন্মের সুকৃতিবশে কৃষ্ণদত্ত গন্ধর্ব নামক এক সিদ্ধ গায়কের নিকট তিনি নাদবিদ্যা প্রাপ্ত হন ৷ নাদবিদ্যায় সিদ্ধিলাভে জীবনে তাঁহার বৈরাগ্যের উদয় হয় ৷ এই সময়েই বিশাখাকুণ্ড হইতে তিনি শ্রীবঙ্কিমরায় বিগ্রহ (বাঁকে বিহারিজী) প্রাপ্ত হইয়াছিলেন ৷ শ্রীবিগ্রহ লইয়া বৃন্দাবনের অদূরে মানস সরোবরের তীরে তিনি ভজন করিতে থাকেন ৷ দিল্লীর ধনকুবের দয়াল দাস ক্ষেত্রী শ্রীবঙ্কিমরায়ের শ্রীমন্দির নির্মাণ ও সেবাপূজার ব্যবস্থা করিয়া দেন ৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বৃন্দাবনে শুভাগমন করিলে হরিদাস স্বামী বৃন্দাবনে আসিয়া বাস করেন ৷ সম্রাট্ আকবরের বিখ্যাত সভাগায়ক তানসেন হরিদাস স্বামীর অন্যতম ছাত্র ৷ দ্বিতীয় ছাত্র শ্রীনরোত্তম ঠাকুর ৷ একজন ধ্রুপদের ধারাকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন, অন্যজন বাঙ্গালার কীর্তনে বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে রূপান্তর আনিয়াছেন ৷
কৃষ্ণানন্দের অগ্রজের নাম পুরুষোত্তম দত্ত ৷ পুরুষোত্তমের পুত্রের নাম সন্তোষ ৷ নরোত্তম খেতরীতে ফিরিয়া সন্তোষের হস্তেই রাজ্যভার অর্পণ করেন ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর জন্মতিথি ফাল্গুন পৌর্ণমাসীতে নরোত্তম খেতরীতে শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীবল্লবীকান্ত, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীব্রজমোহন, শ্রীরাধামোহন ও শ্রীরাধাকান্ত এই ছয়টি শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন ৷ এই উপলক্ষে খেতরীতে বাঙ্গালার বৈষ্ণব-সম্প্রদায় আমন্ত্রিত হন ৷ সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় আচার্যগণ,বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের জ্ঞানী গুণী গায়ক বাদক বহু ব্যক্তি এই উপলক্ষে খেতরীতে উপস্থিত হইয়াছিলেন ৷ বৈষ্ণবসাহিত্যে এই উৎসব খেতরীর মহোৎসব নামে পরিচিত ৷ নরোত্তমের ভ্রাতুষ্পুত্র রাজা সন্তোষ এই উৎসবের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলেন ৷ এই উৎসবেই নরোত্তম কীর্তনের যে ধারায় গান করিয়াছিলেন, সেই ধারার নাম গড়ের হাটী বা গড়ানহাটীর ধারা ৷ প্রথমে তদুচিত গৌরচন্দ্র গান করিয়া পরে শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাবিলাস -গানের পদ্ধতি খেতরীর মহোৎসবেই প্রবর্তিত হয় ৷