শ্রীবৃন্দবনের বনবীথি ৷ অতি প্রত্যূষেই প্রাতঃকৃত্য সমাপনপূর্বক যুবক বনপরিক্রমায় বাহির হইয়াছেন ৷ কিন্তু ব্রজে বনপথমধ্যে ও কি? মণিভূষিত সর্প কি কুণ্ডলী রচিয়া পড়িয়া আছে ৷ কুড়াইয়া লইয়া দেখিলেন একগাছি মণিময় নূপুর ৷ কিন্তু এত সুরভি কেন ? কোথা হইতে আসিতেছে ? সুবর্ণে সৌগন্ধ, রত্নে সৌরভ— এ তো অবিশ্বাস্য কথা ৷ যুবক নূপুর পাইয়া নত হইয়া ললাটে স্পর্শ করাইলেন ৷ জানিতেও পারিলেন না যে, ললাটের লালটিকা নূপুরাকৃতি ধারণ করিল ৷ পরে নূপুর বক্ষোদেশে রাখিয়া চাপিয়া ধরিলেন ৷ উত্তরীয়াবৃত বক্ষ-সন্নদ্ধ দুটি কর ৷ সহসা মনে হইল এক অতি স্নিগ্ধ চলমান আলোকপুঞ্জ যেন তাঁহারই দিকে প্রবাহ রচনা করিয়াছে ৷ বিস্ময়ের পর বিস্ময়, আজ অদৃষ্টপূর্ব যত অলৌকিক ঘটনা কি পথে তাঁহারই জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল ৷ এ কি চিন্ময়ধাম ব্রজবনের ভূমিদর্পমে প্রতিবিম্বিত শশধরবিম্ব, না নবোদিত তরুণ অরুণের ব্রজরেণু-স্পর্শ-কুতূহলী কিঞ্জল্কমালা ৷ সহসা সে দ্যুতিমণ্ডল হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এক লাবণ্যময়ী প্রতিমা ৷ কিশোরীর পথলগ্ন যুগল খঞ্জন নয়ন কি যেন অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে ৷ ভদ্রে, আপনি কি কিছু অনুসন্ধান করিতেছেন? যুবকের প্রশ্নে বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণীর সংক্ষিপ্ত উত্তর—একগাছি নূপুর ৷ নৃত্য-পরিশ্রান্তা সখীর পথচারেণ ক্লান্ত শ্লথ চরণ হতে স্খলিত হইয়া পড়িয়াছে ৷ ‘এই কি?’ যুবক নূপুরগাছি বক্ষতল হইতে বাহির করিয়াছেন ৷ কিশোরী ত্র্যস্ত ব্যস্ত হস্তে যেন কাড়িয়াই লইলেন ৷ কিন্তু কোথায় কিশোরী, এ কি কাহার অদৃশ্য হস্তের ইন্দ্রজাল, না দৃষ্টিভ্রম ? যুবক মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন৷ যখন চৈতন্য হইল, দেখিলেন শ্রীপাদ জীব গোস্বামীর কোরে পড়িয়া আছেন ৷ শ্রীজীব বলিলেন, ভাগ্যবান তুমি, শ্রীমতীর চরণভূষণ মণিমঞ্জীররে স্পর্শ পাইয়াছ ৷ সখী ললিতা তোমায় কৃপা করিয়া দর্শন দিয়া নূপুর লইয়া গিয়াছেন ৷ ললাটে তোমার সেই পূণ্য-রেখাঙ্কণে চিহ্নিত হইয়া গিয়াছে ৷ ঐ নূপুরাকৃতি তিলক আজি হইতে তোমার ললাটভূষণ হউক ৷ তুমি রাধাশ্যামের আনন্দবর্ধন করিয়াছ ৷ তোমার নাম রাখিলাম শ্যামানন্দ ৷
মেদিনীপুর জেলায় ধারোন্দা বাহাদুরপুর গ্রাম ৷ পিতার নাম শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল, মাতার নাম দুরিকা ৷ বহু পুত্র ও কন্যা জন্মিয়াই ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিল ৷ তাই জনক-জননী নাম রাখিয়াছিলেন দুঃখী ৷ এই দুঃখীই শ্যামানন্দ নামে পরিচিত হন ৷ শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল পরে দণ্ডেশ্বরে আসিয়া বাস করেন ৷ পিতা-মাতার অনুমতি লইয়া দুঃখী কালনায় আসেন এবং হৃদয়ানন্দের নিকট দীক্ষা গ্রহণপূর্বক শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের সেবাকার্যে আত্মনিয়োগ করেন ৷ হৃদয়ানন্দ তাঁহার নাম রাখিয়াছিলেন কৃষ্ণদাস ৷ কিছু দিন পরে হৃদয়ানন্দের সম্মতিক্রমে শ্রীজীবরে নিকট শিক্ষালাভার্থ কৃষ্ণদাস বৃন্দাবন গিয়া উপস্থিত হন ৷ বৃন্দাবনেই তিনি আচার্য শ্রীনিবাস ও ঠাকুর নরোত্তমের সঙ্গে সৌহৃদ্যে আবদ্ধ হইয়াছিলেন । শ্রীরাধার নূপুরপ্রাপ্তির কথাপূর্বেই উল্লখ করিয় ৷
শিক্ষা সমাপনান্তে শ্যামানন্দ কালনায় ফিরিলেন ৷ বৈষ্ণবগণের বহু শাখাপ্রতিশাখায় তিলকচিহ্নের বৈশিষ্ট্য আছে ৷ শ্রীনিবাসাচার্য-সম্প্রদায়ের তিলকের আকার বংশপত্রের মত ৷ নরোত্তম শাখার তিলক যেন চম্পক-কলিকা, আর শ্যামানন্দ হইতে এই সম্প্রদায়ের তিলক হইয়াছে নূপুরাকৃতি ৷ হৃদয়ানন্দ শ্যামানন্দের নূপুরাকৃতি তিলক দেখিয়া বিস্মিত হইলেন এবং গুরুর আদেশ লঙ্ঘনে— গুরু-নির্দেশিত তিলকের অপহ্নব-সাধনে শ্যামানন্দকে আশ্রম হইতে বাহির করিয়া দিলেন ৷ শ্যামানন্দ মনের দুঃখে গঙ্গাতীরে গিয়া পড়িয়া রহিলেন ৷ ত্রিরাত্র গত হইলে হৃদয়ানন্দ স্বপ্ন দেখিলেন, শ্রীগৌরনিত্যানন্দ অভুক্ত রহিয়াছেন ৷ কারণ জিজ্ঞাসায় জানিলেন— শ্রীমতী ললিতাজীর কৃপাপ্রাপ্ত শ্রীমতী রাধারাণীর চিহ্নিত সেবক শ্যামানন্দ আজ তিন দিন তিন রাত্রি উপবাসী আছেন ৷ হৃদয়ানন্দ নিজে গিয়া গঙ্গাতীর হইতে শ্যামানন্দকে বুকে তুলিয়া লইলেন ৷ গুরু-শিষ্যের মিলন ঘটিল ৷
শ্যামানন্দ জাতিতে ছিলেন সদ্গোপ ৷ বহু ব্রাহ্মণ তাঁহার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ শ্যামানন্দ গোপীবল্লভপুরে শ্রীরাধাগোবিন্দ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ শেষ জীবনে তিনি উড়িষ্যার নৃসিংহপুরে বাস করিয়াছিলেন ৷ শ্রীপাদ বলদেব বিদ্যাভূষণ শ্রীশ্যামানন্দ শাখাভুক্ত৷ শ্যামানন্দের শিষ্যগণ মধ্যে রসিক মুরারিই সর্বপ্রধান ৷ অন্যান্য প্রধানগণের নাম—
রাধানন্দ শ্রীপুরুষোত্তম মনোহর ৷
চিন্তামণি বলভদ্র শ্রীজগদীশ্বর ৷৷
উদ্ধব অক্রূর মধুবন শ্রীগোবিন্দ ৷
জগন্নাথ গদাধর শ্রীআনন্দানন্দ ৷৷
শ্রীরাধামোহন আদি শিষ্যগণ সঙ্গে ৷
সদাভাসে সঙ্কীর্তন সুখের তরঙ্গে ৷ (ভক্তিরত্নাকর)