কৃষ্ণদয়াল চন্দ — আবির্ভাব ১২০১ সাল, তিরোধান ১২৮৮ সাল ৷ মুর্শিদাবাদ জেলার সমৃদ্ধ জনপদ পাঁচথুপি ৷ বহু সাধু, ভক্ত, পণ্ডিত এবং ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি আপন আপন কীর্তি-গৌরবে রাঢ়ে এই জনপদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন ৷ কৃষ্ণদয়াল চন্দ এই পাঁচথুপির অন্যতম অলঙ্কার ৷ জাতিতে সুবর্ণবণিক, পিতার নাম দীনবন্ধু চন্দ ৷ কৃষ্ণদয়াল সাধারণের নিকট চান্দজী নামে পরিচিত ছিলেন ৷ ভক্তরা বলিতেন চান্দজী মহাশয় ৷
অপরাপর বালকের সঙ্গে পাঁচথুপির পাঠশালাতেই চান্দজী মহাশয়ের হাতেখড়ি হয় ৷ পরে কৈশোরে তিনি নিকটস্থ মুনিয়াডিহির স্বনামখ্যাত পণ্ডিত রামকৃষ্ণ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের চতুষ্পাঠীতে প্রবিষ্ট হন ৷ এই উদার ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়ালকে অকপটে শিক্ষা দান করেন৷ কৃষ্ণদয়াল ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কারে কৃতিত্ব অর্জনপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করিতে থাকেন ৷ অধ্যয়ন শেষে রাঢ়ের পণ্ডিতসমাজে তিনি একজন পণ্ডিত ও শ্রীমদ্ভাগবতের বিশেষজ্ঞরূপে সুপরিচিত হন ৷ বীরভূমের দুনোবড়া গ্রামে সেকালে একজন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত ছিলেন— নাম রামসুন্দর তর্কবাগীশ ৷ এই দুর্ধর্ষ পণ্ডিত কৃষ্ণ দয়ালের বিদ্যাবত্তায় আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে বন্ধু বলিয়া গ্রহণ করেন ৷
শ্রীমন্ মহাপ্রভুর সমকালেই রাঢ়দেশ পদাবলী-কীর্তনে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল ৷ রাঢ়দেশেই কীর্তনের মনোহরসাহী সুরের সৃষ্টি হইয়াছিল ৷ শ্রীখণ্ড, কান্দরা ও ময়নাডালের নাম মনোহরসাহী সুরের সঙ্গে অমর হইয়া আছে৷ পরবর্তী কালে বীরভূমের ইলামবাজার, মুলক প্রভৃতি গ্রাম মনোহরসাহী কীর্তনের জন্য প্রসিদ্ধ হইয়া ওঠে ৷ পাঁচথুপির কৃষ্ণহরি হাজরা মনোহরসাহী সুরের একজন সুবিখ্যাত কীর্তনগায়ক ছিলেন ৷ কৃষ্ণহরির কীর্তনের দল ছিল না ৷ ইনি ছাত্রগণকে শিক্ষা দিতেন ৷ কৃষ্ণদয়াল কৃষ্ণহরির নিকট কীর্তন শিক্ষা করেন ৷ বিষয়ী সজ্জনগণের এবং বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে চান্দজী যেমন শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করিতেন, তেমনই কীর্তন গানও করিতেন ৷ চান্দজী মনোহরসাহী সুরের একজন দেশবিখ্যাত কীর্তনীয়ারূপে ধনী দবিদ্র, পণ্ডিত মূর্খ আচণ্ডাল নরনারীর শ্রদ্ধা অর্জন করেন ৷ দেশ-বিদেশের বহু বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ এবং অপরাপর জাতির শিক্ষার্থীরা তাঁহার নিকট কীর্তন শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷
অদ্বৈত-বংশাবতংস প্রভুপাদ শ্রীল নীলমণি গোস্বামী শ্রীধাম বৃন্দাবনে বাস করিয়াছিলেন৷ শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁহার অনন্যসাধারণ অধিকার ছিল ৷ সুপণ্ডিত , রসিক , ভাবুক এবং শ্রীমদ্ভাগবতের মর্ম ব্যাখ্যাতারূপে ব্রজবাসী বৈষ্ণবগণ তাঁহাকে পরম আদরে বরণ করিয়া লইয়াছিলেন ৷ অদ্বৈত দাস বৃন্দাবনে গমন করিলে নীলমণি প্রভু তাঁহাকে কীর্তন শিখিবার জন্য রাঢ়দেশে পাঁচথুপিতে কৃষ্ণদয়াল চন্দের নিকট পাঠাইয়া দেন ৷ অদ্বৈত দাস কয়েকবারই পাঁচথুপিতে আসিয়াছেন এবং এক একবার মাসাবধি কাল থাকিয়া কীর্তন শিক্ষা করিয়া গিয়াছেন ৷ নীলমণি প্রভু সুকবি এবং সুগায়ক ছিলেন ৷ তিনি অদ্বৈত দাসের নিকট কীর্তন শিক্ষা করিতেন ৷ শ্রীমদ্ভাগবতপাঠের পূর্বে তিনি স্বরচিত সংস্কৃত পদ গান পাঠ আরম্ভ করিতেন ৷ পাঠের মাঝে মাঝে দুই একটা বাঙ্গালা ও সংস্কৃত পদও গাহিতেন ৷
একদিন শ্রীধাম বৃন্দাবনে শ্রীল নীলমণি প্রভু শ্রীগোবিন্দজীউর মন্দিরে শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করিতেছেন ৷ শ্রীমতীর শ্রীকৃষ্ণানুরাগের পরিচয়-প্রসঙ্গে তিনি এই পদটি গান করিলেন—
রূপে ভরল দিঠি স্মওরি পরশ মিঠি
পুলক না তেজই অঙ্গ৷
মধুর মুরলীরবে শ্রুতি পরিপুরল
না শুনে আন পরসঙ্গ ৷৷
পাঠশেষে একজন প্রবীণ বৈষ্ণব নীলমণি প্রভুর পাদবন্দনাপূর্বক বলিলেন— “প্রভু আমি মূর্খ, আপনার শ্রীমুখনিঃসৃত শ্রীরাধাকৃষ্ণলীলা বর্ণনার কথা কি বলিব, জীবন ধন্য হইয়া গেল ৷ আর এইপদাবলী গান” — নীলমণি প্রভু বৈষ্ণবকে কোন কথা বলিতে না দিয়া উল্লাসে বলিযা উঠিলেন— “মহাশয়, এ আমাদের চান্দজীর ঘরের গান”৷ বৈষ্ণব পুনরায় পাদবন্দনাপূর্বক অত্যন্ত দীনভাবে স-সঙ্কোচে নিবেদন করিলেন— এই অধমের নাম কৃষ্ণদয়াল চন্দ ৷ নীলমণি প্রভু ব্যাসাসন হইতে নামিয়া সসম্ভ্রমে চান্দজীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করিলেন ৷ চান্দজী শ্রীবৃন্দাবনে আসিয়াছেন মাত্র সেই দিন ৷ কাহাকেও কোন পরিচয় দেন নাই ৷ আর দৈবক্রমে পণ্ডিত বাবাজী সে সময় শ্রীধামে উপস্থিত ছিলেন না ৷ বলা বাহুল্য, চান্দজীকে শ্রীগোবিন্দ, শ্রীগোপীনাথ ও শ্রীমদনমোহন -মন্দিরে শ্রীমদ্ভাগবত-পাঠ ও লীলাকীর্তন শুনাইতে হইয়াছিল ৷
কৃষ্ণদয়াল চন্দ আপন চরিত্র-গৌরব এবং বৈষ্ণবোচিত আচার ব্যবহারে ও বহু সৎকার্যের অনুষ্ঠানে রাঢ়দেশে এক নবভাবের জোয়ার আনিয়াছিলেন ৷ বহু ছাত্র তাঁহার নিকট কীর্তন শিখিয়া জীবিকার সংস্থান ও সুযশ লাভ করিয়া গিয়াছেন ৷ তাঁহার অন্যতম প্রধান ছাত্র অদ্বৈত দাস পণ্ডিত বাবাজী ৷ পণ্ডিত বাবাজীর নিকট কীর্তন শিখিয়া যাঁহারা চান্দজীর ধারা অব্যাহত রাখিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে নীলমণি প্রভুর সুযোগ্য পুত্র প্রভুপাদ গৌরগোপাল ভাগবত ভূষণ, শ্রীল গদাধর দাস বাবাজী, শ্রীত্রিভঙ্গ দাস ও শ্রীভক্তিভূষণ দাস বাবাজী এবং শ্রীনবদ্বীপ ব্রজবাসীর নাম উল্লেখযোগ্য ৷ ইঁহারা সকলেই সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷