বীরভূম জেলায় ইলামবাজার গ্রাম ৷ পূর্বে গ্রামে নীলকুঠী ছিল; কুঠিয়াল সাহেবদের মন-তারিখ-ওয়ালা কবরখানায় কয়েকজনের নাম পাওয়া যায় ৷ ইলামবাজারের গালার কারবার এমন লোপ পাইয়াছে ৷ এক সময় এখানকার গালার খেলনা, গালার পান, আম, আতা, কলা আদি জামাই ঠকাইবার জন্য খুবই সমাদর ছিল ৷ জামাতা শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছেন সন্ধ্যায় ৷ জলযোগ করিয়া শ্যালিকা-ব্যূহমধ্যে বসিয়াছেন, একজন শ্যালিকা একখানি রেকাবে দুই খিলি পান আনিয়া দিল, সুন্দর লবঙ্গ-আঁটা খিলি ৷ জামাইবাবু তুলিতে গিয়া দেখে পান উঠে না, ভয়ানক শক্ত পান ৷ হাসির হর্‌রা উঠিল, হতভম্ব জামাতা বসিয়া রহিলেন— হংসিনীসমাজে বক ৷ বীরভূম হইতে লাক্ষার চাষ উঠিয়া গিয়াছে ৷ ইলামবাজারের নুরী জাতি, যাহারা গালার খেলনা আদি তৈয়ারী করিত, তাহারা নির্বংশ হইয়াছে ৷ নুরী -বংশের সবেধন নীলমণি শিবরাত্রির সলিতা গোপাল মাত্র বাঁচিয়া আছে৷ এই কুটিরশিল্পে কত লোকেরই না অন্নসংস্থান হইত৷
ইলামবাজারের লাগাও পশ্চিমে শ্রীপাট পায়ের, বীরভূমের অন্যতম সংস্কৃতি -কেন্দ্র ৷ এই গ্রামের কাশীশ্বর পরিবারভুক্ত গোস্বামীগণ বীরভূমের অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন ৷ বংশবৃদ্ধির সহিত গোস্বামীগণের পূর্বপুরুষ তিন ভ্রাতা পৃথক্‌ হইয়া বড়, মধ্যম ও ছোট বাড়ির গোস্বামী নামে পরিচিত হন ৷ বড়বাড়ি, মধ্যমবাড়ি ও ছোটবাড়ি এই তিন বাড়িতেই শ্রীরাধাকৃষ্ণ যুগল-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছেন ৷ শুধু পায়েরেই নহে, ইলামবাজারেও শ্রীগৌর-নিতাই বিগ্রহ আজিও পূজা প্রাপ্ত হইতেছে ৷ পায়ের গ্রামে মধ্ব-সম্প্রদায়ের একটি আখড়া আছে ৷ এই আখড়াতেও শ্রীগৌর, নিতাই, অদ্বৈত ও সীতা দেবীর বিগ্রহের পূজা হয় ৷ পায়েরের দুই শত বৎসরের ইতিহাস পাইয়াছি ৷ তাহারও বহু পূর্বে কাশীশ্বর পরিবারের গোস্বামীগণ পায়েরে আসিয়া বাস করিয়াছেন ৷ বড় বাড়ির শ্রীপরমানন্দ গোস্বামী ১১৫৫ সালের ৩১শে বৈশাখ তারিখে রাজনগরের রাজাসাহেবের নিকট একখানি দরখাস্ত দাখিল করিয়াছিলেন, তাহার অবিকল নকল তুলিয়া দিলাম ৷
“হুকুম শ্রীযুক্ত রাজা সাহেব জিউ —
ইজ্জত আগার আনন্দীরাম হাজরা সিকদার ও গোলাম সরকার সুচরিতেষু আগে পাএড়ের জাহির করিল যে মৌজে মজকুবের বাবুরায় আপন বাড়ি ঘর ও বাহির বাড়ি ও পুষ্করিণী দিগর এবং পুষ্করিণীতে গাছ আছে ইহা আমাকে লিখিয়া দিয়াছেন ৷ ইহার সনদ ১১৫৪ সালে আপন আহেলাতে দেওয়া গিয়াছে, তাহা খোয়া গিয়াছে ৷ এখন সনদ হুকুম হয় তবে আমি করি, ইহার যেমত হুকুম হয়। অতএব বাবুরায় আপন বাড়ীঘর ও বাহিরবাড়ী ও পুষ্করিণী দিগর ও গাছ দিগর দিয়াছে ইহার সনদ ১১৫৪ সাল আপন আহেলাতে দেওয়া গিয়াছে, তাহা খোয়া গিয়াছে। এসবের পুনশ্চ পরোয়ানা করিয়া দেওয়া গেল ৷ রায় মজুকুরের বাড়ীঘর পুষ্করিণী গাছ সকল ইহো ভোক করিবেন, তোমরা কেহ মোজাহেম না হবে ৷ ইতি সন ১১৫৫, ৩১ বৈশাখ ।”
নকলকারক সনন্দের বানান ঠিক রাখেন নাই ৷ পূর্ণচ্ছেদাদি চিহ্ন আমি ব্যবহার করিয়াছি ৷ পরমানন্দ গোস্বামীর পুত্র বিনোদচন্দ্র গোস্বামী ৷ ইনি ১১৬৫ সালের ৫ই মাঘ রাজনগরের রাজার নিকট নালিশ করেন যে, আমার খুড়া বাবুরায়ের বাড়িঘর আদির অংশ দাবি করিতেছেন ৷ রাজাসাহেব হুকুম দেন— “ঐ সমস্ত গাছ আদি যদি একত্র থাকিতে দেয় নাই, বুদা হইলে দিয়া থাকে, তবে মানা করিয়া দিও গাছের দাওয়া না করে ৷” বাবুরায় গোস্বামী বাড়ির শিষ্য ছিলেন, কিন্তু ঐ বংশের যদুরায় গাছপালা কাটিয়া লওয়ায় পুনরায় বিনোদচন্দ্র রাজনগর-দরবারে নালিশ করিতে বাধ্য হন ৷ তাহাতে দরবার হইতে হকুম হয়— “অতএব যদুরায়কে ডাঁটিয়া দিহ গোঁসাই মজকুরের পুষ্করিণীর বৃক্ষাদির তসরূপ না করে”৷ এই সনন্দের তারিখ ১১৭৩ সাল তাং ১০ জ্যৈষ্ঠ৷ প্রসঙ্গতঃ বলিয়া রাখি, পায়েরের বড় বাড়িতে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ জীউ, মধ্যম বাড়িতে শ্রীশ্রীমহাপ্রভু জীউ এবং ছোট বাড়িতে শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ জীউ বিগ্রহ বিরাজ করিতেছেন ৷ পায়েরের চট্টরাজ-বাড়িতে শ্রীশ্রীরাধাদামোদর এবং ষড়্‌ভুজ মহাপ্রভুর বিগ্রহ আছেন ৷
বিনোদচন্দ্র গোস্বামীর পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি আপন বংশের পতিতপাবনকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন৷ পোষ্যপুত্র -গ্রহণের দলিলখানিও প্রকাশ করিয়া দিলাম ৷

শ্রীশ্রী ৺শ্রীকৃষ্ণ সহায়
পিতা গোস্বামী—
সেবা যাত্রা মহোৎসবাদি স্বস্তি সকল মঙ্গলালয় শ্রীযুক্ত পতিতপাবন গোস্বামী বরাবরেষু —
কস্য পুষ্যপুত্র মিদং ১১৯৭ সাল লিখনং কার্যঞ্চাগে আমার পুত্র পৌত্রাদি কেহ নাই ৷ এ কারণ তোমাকে পুষ্যপুত্র রাখিয়া আপন গাদী সমর্পণ করিলাম ৷ আমার অংশ শ্রীশ্রী ৺সেবক পুষ্করিণী স্থাবর আদী এবং বৃক্ষাদি যে কিছু আছে সমস্ত তোমাকে দিলাম ৷ তুমিই গাদীতে থাকিয়া এবং আমাদের প্রতিপালন ও সেবাদি সমস্ত করিবে ৷ ইহার মধ্যে আমার শ্রীযুত আমার ২ ভগ্নিকে জমি ও নগদ তন্‌খা যে দিয়াছেন তাহা বহাল রাখিবে । নগদ তন্‌খার জায় আমার অংশ জায় তন্‌খা করিয়া সন বসন দিবে। এবং আমিই শ্রীযুক্ত প্যারীচরণ মুখোপাধ্যায়কে মন্ডল ঘাটের জমি এবং পরগণে গোপভূমের ভগবানপুরের জমি যে দিলাম তাহা জায় মাফিক বাহাল রাখিবে ৷ এই সকল বিষয় অন্যথা করিবে না এবং আমরা দুইজনে যদবধি বর্তমান থাকিব তদবধি আমরা এই সকল বৃক্ষাদি ইচ্ছাপূর্বক ভোগাদি এবং পুণ্যাদি কর্মন করিব ৷ আমরা দুইজন অবর্তমান হইলে এই সমস্ত তোমার থাকিবে ৷ ইহাতে ভাই ভায়াদ অন্য কেহ দাওয়া করে সে দাওয়া নাস্তি ৷ এতদর্থে পুষ্যপুত্র পত্র দিল ইনি সন সদর তারিখ ১৯ জ্যৈষ্ঠ ৷
শ্রীমাণিকচন্দ্র দেবশর্মন সাং পায়ের মোং মাধবপুর ৷
ব্রাহ্মণ শ্রীকাশীশ্বর ব্রহ্মচারী এবং শূদ্র শ্রীগোবিন্দ শ্রীপাদ ঈশ্বর পুরীর শিষ্য ছিলেন ৷ সুতরাং ইঁহারা শ্রীমান্‌ মহাপ্রভুর গুরুভ্রাতা ৷ গুরুদেবের তিরোধানের পর আদেশানুসারে পুরীধামে আসিয়া গোবিন্দ শ্রীমান্‌ মহাপ্রভুর পরিচর্যাভার গ্রহণ করেন ৷ তীর্থ-পর্যটনান্তে কিছু দিন পরে শ্রীকাশীশ্বরও পুরীধামে আসিয়া উপস্থিত হন৷ মহাপ্রভু অতি সমাদরেই তাঁহাকে আপনার নিকট রাখিয়াছিলেন ৷ কবিরাজ কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে লিখিয়াছেন,—মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথমন্দিরে যাইবার সময়—
অপরশ যান প্রভু মনুষ্য গহনে ৷
লোক ঠেলি পথ করে কাশী বলবানে ৷৷
সেকালের বহু সজ্জন কাশীশ্বরের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ এই শিষ্যগণ কাশীশ্বর পরিবার নামে পরিচিত ৷
পায়ের বড়বাড়ির পরমানন্দ গোস্বামীর দৌহিত্র নিমাই চক্রবর্তী বিখ্যাত কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ মাতামহের নিকট সংস্কৃত অধ্যয়ন ও কীর্তনগান শিক্ষা করিয়া তিনি সারা বাঙ্গালায় প্রসিদ্ধ হইয়া উঠেন ৷ ইলামবাজারের বৃদ্ধদের মুখে শুনিয়াছি—
নিমাই চাঁদের বাজলো খোল ৷
তাঁতি ভাতি চরকা তোল ৷৷
ইলামবাজার অঞ্চলে বহু তাঁতির বাস ছিল ৷ নিমাই চক্রবর্তী দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ইলামবাজারেরই একটি পাড়া ভগবতীবাজারে ৷ শ্বশুরালয়ের সম্পত্তি পাইয়া তিনি ভগবতীবাজারে আসিয়া বাস করেন ৷ নিমাই-এর প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র দীনদয়াল ৷ দীনদয়ালও কীর্তনগানে খ্যাতি অর্জন করেন ৷ দীনদয়ালের পুত্রের নাম মনোহর চক্রবর্তী ৷ কীর্তনগানের নৈপুণ্যে ইনি পিতা-পিতামহকেও অতিক্রম করিয়াছিলেন ৷ ১২২৫ সালে মনোহরের জন্ম হয় ৷ মনোহর পিতার নিকট শিক্ষা শুরু করিয়া কান্দারার ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন ৷ সেকালের বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ মৃদঙ্গবাদক জটেকুঞ্জ মনোহর চক্রবর্তীর ডাহিনের বাদক ছিলেন ৷ কীর্তনীয়া গণেশ দাস কৈশোরে মনোহরের কীর্তন শুনিয়াছিলেন ৷ মনোহর দেখিতে সুপুরুষ ছিলেন, তাঁহার রূপার করতাল ছিল, তাহাতে পাঁচরঙ্গের রেশমের থোপনা ঝুলিত ৷ উত্তরীয় চাদরখানি তিনি কোমরে বাঁধিতেন না ৷ চাদর তাঁহার বক্ষের উপর ঢেঁড়ার চিহ্ন আঁকিয়া দুই স্কন্ধ বাহিয়া পৃষ্ঠের দিকে ঝুলিয়া থাকিত ৷ মেরেলা কোঙারপুরের হারাধন সূত্রধর প্রভৃতি প্রধান কীর্তনীয়াগণ মনোহরকে শ্রদ্ধা করিতেন এবং রাসিকদাস বেণীদাস প্রভৃতি তরুণেরা তাঁহাকে সম্ভ্রমের চক্ষে দেখিতেন ৷
দীনদয়ালের সহোদর ভ্রাতা আনন্দচাঁদ ও বেণীমাধব সুগায়ক ছিলেন ৷ আনন্দচাঁদও বেণীমাধব দীনদয়ালের দোহারী করিতেন ৷ নিমাই-এর দ্বিতয় পক্ষের সন্তান দীনদয়ালের বৈমাত্রেয় ভ্রাতার নাম উদয়চান্দ ৷ উদয়চান্দ পৃথক সম্প্রদায় গঠনপূর্বক কীর্তনগানে প্রায় পিতার মতই খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন ৷ শুনিয়াছি দীনদয়াল অপেক্ষাও তাহার গানের খ্যাতি ছিল ৷ উদয়চান্দের পুত্র অখিল ৷ অখিলেরও কীর্তনের প্রশংসা শুনিয়াছি, তবে মনোহরের সুযশের প্রভায় অখিলের নাম ঢাকা পড়িয়াছিল ৷ মনোহরের জীবদ্দশাতেই অখিলের লোকান্তরপ্রাপ্তি ঘটে ৷ মনোহরের সন্তানাদি ছিল না ৷ তিনি অখিলের পুত্র নবীনকে যত্নপূর্বক গান শিক্ষা দিয়েছিলেন ৷ মনোহরের তিরোধানের অল্পদিন পরেই নবীন পরলোক গমন করেন ৷ তিনি অধিক দিন দল চালাইতে পারেন নাই ৷ নবীনের দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ গৌর, কনিষ্ঠ কেশব ৷ জটেকুঞ্জের শিষ্য খ্যাতনামা মৃদঙ্গবাদক নিকুঞ্জ বাইতি কেশবকে কীর্তন-শিক্ষা দিয়া দল গঠন করেন ৷ বড় বংশের সন্তান বলিয়া সকলেই কেশবকে প্রীতির চক্ষে দেখিতেন ৷ ইঁহারা পুরুষানুক্রমে জয়দেব কেন্দুবিল্বের মেলায় পৌষ সংক্রান্তি হইতে তিন দিন শ্রীরাধাবিনোদের আঙ্গিনায় লীলাকীর্তন গাহিতেন ৷ ধুলোটের দিন মোহান্ত আসিয়া মূল গায়ককে একখণ্ড উণীবস্ত্র মাথার বান্ধিয়া দিয়া আশীর্বাদ করিতেন ৷ কেশব পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল ৷ কেশব কুড়মিঠা গ্রামে বিবাহ করিয়াছিলেন ৷ বিবাহের অল্পদিন পরেই কেশবের পরলোকপ্রাপ্তি ঘটে ৷