জন্ম ১২৪৪ সাল ৷ নাম ব্রজকিশোর রক্ষিত, পিতার নাম ভীমকিশোর রক্ষিত ৷ জাতি বারেন্দ্র কায়স্থ ৷ জন্মস্থান পাবনা জেলার উল্লাপাড়া স্টেশনের নিকটস্থ একটি গ্রামে ৷ শৈশবেই পিতা-মাতার মৃত্যু হওয়ায় এক বৈমাত্রেয় ভ্রাতা তাঁহাকে প্রতিপালন করেন ৷ বাঙ্গালা ও পার্সী ভাষায় সামান্য শিক্ষালাভপূর্বক স্থানীয় এক জমিদার-বাড়ীতে চাকুরী লইয়াছিলেন ৷ সেই সময়ে পাবনা জেলাতেই তাঁহার বিবাহ হয়; পত্নীর নাম ব্রজসুন্দরী ৷
এই সময়ে ব্রজকিশোর চাকুরী ছাড়িয়া এবং পত্নীকে ত্যাগ করিয়া কাটোয়ায় চলিয়া আসেন ৷ বৈষ্ণবধর্মের প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগবশতঃ কোন গোস্বামী-সন্তানের উপদেশে তিনি চৈতন্যচরিতামৃতপাঠে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ৷ পাঠ করেন, কিন্তু অর্থ বুঝিতে পারেন না ৷ কাটোয়ায় আসিয়া হরিনামামৃত-ব্যাকরণ পাঠের অভিপ্রায় প্রকাশ করিলে জনৈক আচার্য সন্তান তাঁহাকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষাদান করেন ৷ কেহ কেহ বলেন তিনি ভেকাশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, এই জন্যই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন হইয়াছিল ৷ যেজন্যই হউক দীক্ষাগ্রহণের পর ব্রজকিশোরের নাম হয় অদ্বৈতদাস ৷
ব্যাকরণপাঠ সমাপ্ত হইলে তিনি কাটোয়া হইতে শ্রীধাম-বৃন্দাবনে গমন করেন ৷ শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীরাধাকুণ্ডতীরে অবস্থানপূর্বক অদ্বৈতদাস কিছুদিন সাধনভজন করিয়াছিলেন ৷ শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীঅদ্বৈত কুলভূষণ প্রভুপাদ শ্রীনীলমণি গোস্বামী মহোদয়ের নিকট অদ্বৈতদাস শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন ৷ নীলমণি প্রভু সুগায়ক ছিলেন, লীলাকীর্তনে তাঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল ৷ অদ্বৈতদাস কীর্তন শিখিতে উৎসুক জানিয়া নীলমণি প্রভু তাঁহাকে রাঢ়দেশে পাঠাইয়া দেন ৷ অদ্বৈতদাস নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব, এইজন্য তাঁহার বাঙ্গালায় যাতায়াতের ব্যয়ভার নীলমণি প্রভুই বহন করিতেন ৷
সে সময়ে রাঢ়দেশে পাঁচথুপিতে স্বনামধন্য কীর্তনাচার্য কৃষ্ণদয়াল চন্দ বর্তমান ছিলেন । চন্দজীর অসাধারণ খ্যাতি ৷ শ্রীমদ্ভাগবত এবং উজ্জ্বল নীলমণি প্রভৃতি গ্রন্থে চন্দজীর বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল ৷ সে সময় লীলাকীর্তনের তিনি একজন স্বনামধন্য গায়ক এবং শিক্ষাদাতা ৷ অদ্বৈতদাস চন্দজীর নিকটেই কীর্তনগান শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷ কান্দীর খ্যাতনামা কীর্তনাচার্য দামোদর কুণ্ডুও তাঁহার অন্যতম শিক্ষাগুরু ৷ শুনিয়াছি৷ শুনিয়াছি, ময়নাডালের সুধাকৃষ্ণ মিত্র ঠাকুরও অদ্বৈতদাসকে সযত্নে কীর্তনগান শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷
অদ্বৈত দাস এক-একবার শ্রীবৃন্দাবন হইতে রাঢ়ে আসিতেন; কয়েকমাস থাকিয়া সঙ্গীত-শিক্ষাপূর্বক পুনরায় শ্রীধামে ফিরিয়া যাইতেন ৷ যে যে গান তিনি রাঢ়ে শিখিতেন, সেই সেই গান শ্রীধামে ফিরিয়া নীলমণি প্রভুকে শিখাইতেন ৷ রাঢ়দেশ হইতে একবার তিনি পুরীধামে গমন করিয়াছিলেন ৷ কীর্তনশিক্ষা সমাপ্ত হইলে দীক্ষাগুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর মন্দিরে কীর্তন গাহিবার অভিপ্রায়ে অদ্বৈতদাস কাটোয়ায় আসিলে পত্নী ব্রজসুন্দরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটে ৷ ব্রজসুন্দরী মাতা ও ভ্রাতা রামলাল গুণকে লইয়া পতির অনুসন্ধানে রাঢ়দেশে আসিয়াছিলেন ৷ রাঢ়ে দেখা না পাইলে তাঁহারা শ্রীবৃন্দাবন পর্যন্ত গমন করিতেন ৷ গুরুর আদেশে, কাটোয়ার বৈষ্ণবমণ্ডলীর অনুরোধে অদ্বৈতদাস পত্নীকে গ্রহণ করেন ৷
সস্ত্রীক অদ্বৈতদাস কাটোয়া হইতে নবদ্বীপে আসিয়া গোরাচান্দের আখড়ায় বাস করিতে থাকেন ৷ শ্রীবৃন্দাবনেই তাঁহার ‘পণ্ডিত বাবাজী’ নামে খ্যাতি রটিয়াছিল ৷ নবদ্বীপেও তাঁহার গুণমুগ্ধ ভক্তের অভাব ঘটিল না ৷ সুতরাং ব্রজসুন্দরী সন্তানসম্ভাবনা হইলে ভক্তবৃন্দ একখানি বাড়ি খরিদ করিয়া দিলেন ৷ অদ্বৈতদাস, স্ত্রী ও কয়েকমাসের কন্যা কৃষ্ণপ্রিয়াসহ সেই বাড়িতে আসিয়া স্থায়ীভাবে বাস করিতে থাকেন ৷ নবদ্বীপে থাকাকালে তিনি কীর্তনগান করিয়া দক্ষিণা গ্রহণ করিতেন ৷ নয় বৎসর বয়সে কন্যা কৃষ্ণপ্রিয়ার বিবাহ হয় ৷ কন্যার বিবাহের পর অদ্বৈতদাস কাশিমবাজারের বদান্য মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাহাদুরের কীর্তনের টোলে অধ্যাপক নিযুক্ত হন ৷ কয়েক বৎসর পরে পাবনার তাড়াসের জমিদার রাজর্ষি বনমালী রায় বাহাদুরের অনুরোধে তিনি শ্রীধাম বৃন্দাবনে গিয়া বাস করেন ৷ রাজর্ষির কুঞ্জে তিনি নিয়মিত কীর্তনগান করিতেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীগণকে শিক্ষাদানও চলিত ৷ ১৩২০ সালে পত্নী ব্রজসুন্দরী দেহ রক্ষা করেন ৷ ১৩২৮ সালে কন্যা কৃষ্ণপ্রিয়ার মৃত্যু হয় ৷ পত্নীর দেহত্যাগের পরে পণ্ডিত বাবাজী কন্যার নিকট আসিয়া নবদ্বীপে বাস করিয়াছিলেন ৷ কন্যা লোকান্তরিতা হইলে পুনরায় শ্রীবৃন্দাবনে ফিরিয়া যান ৷ ১৩৩৭ সালে এই স্বনামধন্য সুপণ্ডিত এবং রসজ্ঞ গায়ক নিত্যধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷ বহু ছাত্র তাঁহার নিকট শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগলাভে ধন্য হইয়াছিলেন ৷ স্বনামধন্য সাহিত্যসাধক ডক্টর ৺বিমানবিহারী মজুমদার পণ্ডিত বাবাজীর দৌহিত্র ৷