মুর্শিদাবাদ জেলায় যজান গ্রাম ৷ এই গ্রামের চৈতন্য দাস শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গান করিতেন ৷ পুত্র অনুরাগী দাস মৃদঙ্গবাদক ছিলেন ৷ পদ্মাপারে গান করিতে গিয়া মূল গায়কের সঙ্গে তাঁহার মতান্তর হওয়ায় তিনি গ্রামে ফিরিয়া কীর্তন শিক্ষা করেন ৷ অনুরাগী দাস কীর্তনে খুব নাম করিয়াছিলেন ৷ তিনি দক্ষিণখণ্ডে বিবাহ করেন ৷ পত্নীর নাম ক্ষুদুমণি দাসী ৷ এক পুত্র ও দুই কন্যার জননী ক্ষুদ্রুমণি লোকান্তরিতা হইলে অনুরাগী স্বগ্রামে যজানেই পুনরায় বিবাহ করিয়াছিলেন ৷ অনুরাগীর প্রথম পক্ষের পুত্র রসিক দাস ৷ দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র রতন দাস ও গৌর দাস ৷ রতন দাস রসিক দাসের দলের শির দোহার ও দলের কর্তা ছিলেন ৷ গৌর দাস কলিকাতায় বাস করেন ৷ কলিকাতার বিখ্যাত কীর্তনীয়া ছিলেন গৌর দাস ৷ রসিক দাসের তিরোধানে গৌর দাস সম্প্রদায়-সহ দক্ষিণখণ্ডে গান করিতে আসেন ৷ রসিক দাস দক্ষিণখণ্ডে মাতুলালয়ে বাস করিয়াছিলেন ৷
অনুরাগী দাস রসিক দাসকে বিষদৃষ্টিতে দেখিতেন ৷ তিনি ছাত্রগণকে এবং রতন ও গৌরকে গান শিখাইতেন; কিন্তু রসিক সেখানে গেলে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন ৷ শ্রুতিধর বালক রসিক আড়ালে দাঁড়াইয়া গান শিখিত এবং দূর হইতে পিতাকে শুনাইয়া সেই গান গাহিত ৷ পিতা জ্বলিয়া উঠিতেন ৷ এই অবস্থা বেশীদিন চলিল না ৷ রসিকের মাতুল তাহাকে দক্ষিণখণ্ডে লইয়া আসিলেন এবং সোনারুন্দীর রাজবাড়ির কীর্তনগায়কের নিকট গান শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন ৷ অল্পদিনের মধ্যেই রসিক দাস কীর্তনের দল করিলেন, বয়স বোধ হয় তখন চৌদ্দ-পনর বৎসর ৷
রাঢ়দেশে কান্দরা গ্রাম ৷ মুর্শিদাবাদ জেলার কীরীটকোনার পালধি বংশীয় মঙ্গল ঠাকুর ভগবৎপ্রেমে আকুল হইয়া গৃহ ছাড়িয়া এ-গ্রামে সে-গ্রাম ঘুরিতে ঘুরিতে কান্দরায় আসিয়া বাস করেন ৷ তাঁহার সাধনায় আকৃষ্ট হইয়া শ্রীচৈতন্যপার্ষদ গদাধর পণ্ডিতজীউ তাঁহাকে দীক্ষা দান করিয়াছিলেন ৷ তাঁহারই স্মৃতিরক্ষাকল্পে আশ্বিনের নবম্যাদি কল্পারম্ভের দিন হইতে শুক্লা প্রতিপদ পর্যন্ত কান্দরায় একটি উৎসবের অনুষ্ঠান হয়, নাম সাঁজি উৎসব ৷ কৃষ্ণ নবমীতে সন্ধ্যায় অধিবাস, শুক্লা প্রতিপদে ধূলোট ৷ এই উৎসব উপলক্ষে কান্দরায় সেদিনে রাঢ়ের বহু প্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া গান করিতে আসিতেন ৷ উৎসবের দিন নিকট হইয়া আসিল, পনের বৎসরের কিশোর রসিক দাস দল লইয়া কীর্তন গাহিবার জন্য কান্দরায় উপস্থিত হইলেন ৷
কান্দরায় দেশবিখ্যাত কীর্তনীয়াগণ উপস্থিত হইয়াছেন ৷ মানকর হইতে নন্দ দাস আসিয়াছেন ৷ বীরভূম তাঁতিপাড়ার নিতাই দাস, ইলামবাজারের মনোহর চক্রবর্তী ও ময়নাডালের বৈকুণ্ঠ মিত্র ঠাকুর আসিয়াছেন ৷ গঙ্গা নাপিত, কালহৃদয় ও জামাই হৃদয় আসিয়াছেন ৷ আর আসিয়াছেন বন্দীপুরের আখুরে গোপালের ভাগিনেয়, হুগলী-বাসুদেবপুরের তরুণ গায়ক বেণী দাস ৷ অনুরাগী দাসও আসিয়াছেন ৷ কান্দরার মঙ্গল ঠাকুরের বংশধর বনমালী ঠাকুর তখন যুবক, তিনিও তরুণ বয়সেই কীর্তনগানে খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন ৷ সকলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া বনমালী ঠাকুর অনুরাগী দাসের পরেই রসিকের আসর নির্দিষ্ট করিলেন ৷ তখনকার দিনে একই আসরে বড় বড় কীর্তনীয়াগণের গান হইলে শ্রীমতীর পূর্বরাগ হইতে আরম্ভ করিয়া রসপর্যায় অনুসারে গান চলিত ৷ কোন কোন কীর্তনীয়া পরবর্তী কীর্তনীয়াকে অপ্রস্তুত করিবার জন্য এমন অবস্থায় গান রাখিতেন, যাহার গৌরচন্দ্র গান স্থির করাই একটা সমস্যা হইয়া দাঁড়াইত ৷ শ্রীমতীর পূর্বরাগের স্বপ্নদর্শন, বংশীধ্বনি-শ্রবণ, নাম-শ্রবণ, চিত্রপটদর্শন প্রভৃতি নানা প্রকার ভেদ অছে ৷ এই ধরনের আসরেই কীর্তনীয়াগণের রসজ্ঞতার পরীক্ষা হইত ৷ এই সমস্ত গানে হঠাৎ কেহ মিলন গাহিতে পারিতেন না ৷ দুই পংক্তি পয়ার গাহিয়া গান রাখিতে হইত, ইহার নাম ছিল ঝুমুর ৷
অনুরাগী দাস কিছু জানিতে পারিয়াছিলেন কি-না শ্রীমহাপ্রভুই জানেন, তিনি এমন অবস্থায় গানের বিরাম দিলেন যাহার গৌরচন্দ্র স্থির করিতে অভিজ্ঞ কীর্তনীয়াকেই ধান্ধায় পড়িতে হয় ৷ বড় বড় কীর্তনীয়া সকলেই আসরে আসিয়া বসিলেন ৷ বনমালী ঠাকুর এবং বেণী দাস উৎসাহ দিতেছেন, রসিক গান আরম্ভ করিলেন ৷ রসিকের তদুচিত গৌরচন্দ্র, রসপর্যায়-নিদিষ্ট পালাগান, ভাবপূর্ণ সুমিষ্ট কণ্ঠ এবং বিশুদ্ধ তান-লয়ে যেমন অভিজ্ঞ কীর্তনীয়াগণ , তেমনই সাধারণ নর-নারীও অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন ৷ অনুরাগী দাসও আড়ালে দাঁড়াইয়া গান শুনিতেছিলেন ৷ তিনি ছুটিয়া আসিয়া পুত্রকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন ৷ পিতাপুত্রের চোখের জলে বহুদিনের ব্যবধান ভাসিয়া গেল ৷ উভয়েরই হৃদয় বিষাদমুক্ত হইল ৷ পিতাপুত্রের মিলনে সকলেই পরম পরিতৃপ্ত হইলেন ৷
বীরভূম ইলামবাজারের নিকটবর্তী পায়র গ্রাম ৷ এই গ্রামে শ্রীনিত্যানন্দ বংশোদ্ভব এবং শ্রীকাশীশ্বর পরিবারভুক্ত বহু আচার্য সন্তানের বাস ছিল ৷ এতদ্ভিন্ন রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণের সংখ্যাও কম ছিল না ৷ বিভিন্ন জাতির সম্পন্ন গৃহস্থও অনেক ছিলেন ৷ গোস্বামিগণের গৃহে, অপর ব্রাহ্মণ ও গৃহস্থ -গৃহে বহু বিগ্রহ ও শালগ্রাম শিলার সেবা-পূজা হইত ৷ গ্রামে মৃদঙ্গবাদ্য ও কীর্তনগানের চতুষ্পাঠী ও সংস্কৃত-শিক্ষার চতুষ্পাঠীতে বহু ছাত্র শিক্ষালাভ করিত ৷ পায়রে কুঞ্জ দাস নামে একজন দেশবিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক ছিলেন ৷ মস্তকে জটা ছিল, এইজন্য সকলেই তাঁহাকে জটে কুঞ্জ দাস বলিত ৷ তিনি একজন ভালো কীর্তন গায়কও ছিলেন, কিন্তু কীর্তন গাহিতেন না ; কীর্তনের দলে মৃদঙ্গ বাজাইতেন এবং ছাত্রগণকে মৃদঙ্গবাদ্যই শিক্ষা দিতেন ৷ কাটোয়ার নিকটবর্তী বিরাহিমপুর বা বিরমপুরে সেকালে প্রতি বৎসরই লীলা-কীর্তনের নবরাত্র উৎসব হইত ৷ দেশ-বিদেশের কীর্তনীয়াগণ আসিয়া পর্যায়ক্রমে লীলাকীর্তন গান করিতেন ৷ এক বৎসর এইরূপ সম্মেলনে নবরাত্র-শেষে মোহান্ত বিদায় গান হইতেছে ৷ মাত্র মূল গায়কগণই গান করিতেছেন ৷ মনোহর চক্রবর্তীর দলে ছিলেন জটে কুঞ্জ দাস ৷ তিনিই ছিলেন প্রধান বাদক ৷ গায়কগণকে সুযোগ দিয়া মনোহর চক্রবর্তী কুঞ্জ দাসকে ইঙ্গিত করিলেন ৷ কুঞ্জ দাস লহর আরম্ভ করিলে তাঁহার সঙ্গতের সমতালে সঙ্গীতে লয় দিতে অসমর্থ হইয়া প্রায় সকল মূল গায়কই পিছাইয়া পড়িলেন ৷ একমাত্র রসিক দাসই কিছুক্ষণ সঙ্গতি রক্ষা করিয়াছিলেন ৷ বাজনার শেষে কুঞ্জ দাস রসিককে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, কালে তুমি বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক হইবে ৷ মনোহর চক্রবর্তী প্রভৃতির তিরোধানের পর কুঞ্জ দাসের আশীর্বাণী সত্য হইয়াছিল ৷ রসিকের সমকালে তিনিই বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন ৷
দীর্ঘায়তদেহের এই গায়কের কণ্ঠস্বর উচ্চ, মধুর ও গম্ভীর ছিল ৷ বড় তালের গানে তাঁহার দক্ষতা ছিল অসাধারণ ৷ এই সমস্ত গুণ এবং গানের পরিবেশ-ভঙ্গী ও আখরের পারিপাট্য তাঁহাকে ‘বড় মূল গায়েন’ নামে পরিচিত করিয়াছিল ৷ কীর্তনের ‘কাটাধরা’ তাল রসিকের সৃষ্ট ৷ সেকালে রসিকের গানের দক্ষিণা ছিল প্রতি পালায় একশত এক টাকা ৷ তখনকার দিনে ট্রেন ছিল না ৷ তিনি প্রায়ই পাল্কিতে যাতায়াত করিতেন ৷ মঙ্গলডিহির ঠাকুরবাড়িতে এবং নিকটবর্তী বাতিকার গ্রামের জমিদার বাড়িতে আমি বহুবার তাঁহার গান শুনিয়াছি ৷ রসিক স্থায়িভাবে দক্ষিণখণ্ডেই বাস করিয়াছিলেন ৷ রসিকের পুত্র নন্দ দাস ও রাধাশ্যাম দাসও কীর্তন-গানে সুযশ অর্জন করিয়াছিলেন ৷ ১৩২০ সালের ১০ই চৈত্র মহাবারুণীর দিন বাঙ্গালার সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই সুরসিক গায়ক নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হইয়াছেন ৷
বর্ধমান জেলায় বহরান স্টেশনের নিকট ঝামটপুর গ্রাম ৷ এই গ্রামে বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের নিত্য পাঠ্যগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-প্রণেতা পূজ্যপাদ শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ আবির্ভূত হইয়াছিলেন ৷ আশ্বিনের দুর্গোৎসবের পর শারদ শুক্লা একাদশী তিথি কবিরাজ গোস্বামীর তিরোভাব তিথি ৷ রসিক দাস এই তিথিতে ঝামটপুরে উৎসবের প্রবর্তন করেন ৷ তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন নিজে স্বদলে ঝামটপুরে উপস্থিত হইয়া লীলাকীর্তন গান করিতেন ৷ তাঁহার নির্দেশে বহু কীর্তনীয়া ঐ উৎসবে গান করিতে আসিতেন ৷ আজিও এই উৎসব অনুষ্ঠিত হইতেছে ৷ বাঙ্গালার শ্রীনন্দকিশোর দাস প্রমুখ কীর্তনীয়াগণ রসিক দাসের প্রবর্তিত ধারা অব্যাহত রাখিয়াছেন ৷