মুর্শিদাবাদ জেলায় ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তরে রামনগর বিখ্যাত গ্রাম ৷ নিকটবর্তী গ্রাম স্যাওড়ার সহিত যুক্ত করিয়া অন্য রামনগর হইতে পৃথক্ রাখিবার জন্য লোকে বলে রামনগর-স্যাওড়া ৷ নিকটেই ঝেলেরা গ্রাম ৷ এই গ্রামের গন্ধবণিক জাতীয় বহুবল্লভ সাধু এক স্বর্ণকার কন্যার প্রেমে পড়িয়া ভেকাশ্রয় গ্রহণপূর্বক বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বন করেন ৷ বহুবল্লভ সাধু বহুবল্লভ দাস-রূপে শ্রীধাম নবদ্বীপ হইতে ফিরিয়া বীরভূমের কান্দরকুলো গ্রামে আসিয়া বাস করেন ৷ বুহবল্লভ গান ও বাজনা দুই-ই জানিতেন ৷ কীর্তনগান ও খোলের বাজনায় অভিজ্ঞ ছিলেন বলিয়া কান্দরকুলোতে অচিরে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করিলেন ৷
কান্দরকুলো গ্রামের রাজারাম (জাতিতে সূত্রধর) চৈতন্যমঙ্গল গান করিতেন ৷ অখিল দাস রাজারামের পুত্র ৷ ১২৬০ সালে অখিলের জন্ম হয় ৷ অখিলের পাঁচ বৎসর বয়সে মাতা পরলোকগমন করিলে গ্রামের বিহারী মণ্ডলের মাতা অখিলকে পুত্রের মত যত্নে প্রতিপালন করেন ৷ সাত বৎসর বয়সে অখিল পিতৃহারা হন ৷ অখিল ও বিহারী সমবয়সী ৷ দুইজনের বয়স যখন দশ-বার বৎসর, তখন তাঁহারা ওস্তাদ বহুবল্লভের নিকট কীর্তন শিখিতে লাগিলেন ৷ অখিল খোলের বাজনাও শিখিয়াছিলেন ৷
নিকটবর্তী ঠিবা গ্রামের অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় বোলপুরে লেখাপড়া শিখিতে গিয়া ইলামবাজারের জটে কুঞ্জর ছাত্র রামশরণ বাইতির নিকট খোলের বাজনা শিখিয়া গৃহে ফিরিলেন ৷ লেখাপড়া আর অগ্রসর হইল না ৷ অবধূতের মামার বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় কেঁচুনে গ্রামে ৷ মামার নাম ভূষণ চক্রবর্তী ৷ তিনি একজন বিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক ছিলেন ৷ অবধূত বোলপুরে যাইবার পূর্বেই তাঁহার পিতা পরলোকগমন করেন ৷ মাতুল ভূষণ অভিভাবকরূপে ঠিবায় আগমন করিলেন ৷ মণিকাঞ্চন-সংযোগ ঘটিল ৷ বহুবল্লভ ও ভূষণের নিকট অবধূতের শিক্ষা সম্পূর্ণ হইল ৷ বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদে অবধূত বহু ছাত্রকে মৃদঙ্গ শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ তাঁহার বহু ছাত্র বিখ্যাত বাদকরূপে বর্তমানে সসম্মানে জীবিকানির্বাহ করিতেছেন ৷ অবধূত খোলের বাজনার নূতন নূতন ‘বোল’ সৃষ্টি করিয়াছিলেন ৷ ময়নাডালের নিকুঞ্জ মিত্র ঠাকুর, ইলামবাজারের বৈষ্ণব বাইতি, নিকুঞ্জ বাইতি, উমেশ বাইতি ও রামশরণ বাইতির পর অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়ই বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ মৃদঙ্গবাদক ছিলেন ৷ তাহার পর নিত্যলীলাপ্রবিষ্ট নবদ্বীপ ব্রজবাসীর নাম করিতে হয় ৷ বহুবল্লভের নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া অখিল দক্ষিণখণ্ডে রসিক দাসের নিকটে গান শিখিতে যান ৷ রসিক পরম যত্নে তাঁহাকে শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ কিছুদিন শিক্ষাদানের পর রসিক দাস অখিলকে কীর্তনের দল করিতে উপদেশ দেন ৷ গুরুর উপদেশ শিরোধার্য করিয়া অখিল কান্দরকুলো গ্রামে ফিরিয়া দল তৈয়ারী করিলেন ৷ ভূষণ চক্রবর্তী ডাহিনের মৃদঙ্গবাদক, সোদরপ্রতিম বন্ধু বিহারী মণ্ডল ডাহিনের দোহার ৷ এই সুগঠিত দল লইয়া অখিল দাস কীর্তন গাহিতে বাহির হইলেন ৷ অল্পদিনের মধ্যেই অখিলের নাম হইয়া গেল ৷ খ্যাতনামা কীর্তন-গায়করূপে তিনি সারা বাঙ্গালায় খ্যাতি অর্জন করিলেন ৷ খ্যাতনামা কীর্তন-গায়করূপে তিনি সারা বাঙ্গালায় খ্যাতি অর্জন করিলেন ৷ অখিলের পরবর্তী নামকরা দোহার দ্বারিকা দাস,— নিবাস মুর্শিদাবাদ জেলার গড্ডাসিংড়ি ৷ ভূষণ চক্রবর্তীর নিকট বাজনা শিখিয়া দত্তবকতোড়-নিবাসী হরেকৃষ্ণ দাস পরে অখিলের দলে খোল বাজাইয়া খুব নাম কিনিয়াছিলেন৷
বীরভূমের বহু স্থানে চব্বিশ প্রহর এবং নবরাত্র নাম-সংকীর্তনের ব্যবস্থা ছিল ৷ কোথাও কোথাও সে ব্যবস্থা এখনো বজায় আছে ৷ উদাহরণস্বরূপ দুবরাজপুরের নাম করিতে পারি ৷ গৌরদাস মোহান্ত, ফুলচাঁদ কবিরাজ এবং রামকল্প মোদী এই তিনজন নেতা দুবরাজপুরের নামসঙ্কীর্তনের আসর বহুদিন সুশৃঙ্খলে পরিচালন করিয়াছিলেন ৷ আরম্ভ হইত চব্বিশ প্রহর; তাহার পর বাহির হইতেন গৌরদাস মোহান্ত ৷ এই নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব ধনীদরিদ্র-নির্বিশেষে সকলের এমনই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন যে, কোন গৃহে দোকানে বা গদিতে তাঁহার পদধূলি পড়িলেই লোকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া তাঁহাকে যথাসাধ্য দান করিত ৷ কোন ধনী মহাজন একদিনের সমগ্র খরচই নির্বাহ করিতেন ৷ এইরূপ নামসংকীর্তনের আসরে একজন, দুইজন, তিনজন, এমনকি চারিজন পর্যন্ত লীলাকীর্তন-গায়ক আমন্ত্রিত হইতেন ৷ এই শ্রেণীর আসরে অখিল দাস প্রায়ই উপস্থিত থাকিতেন ৷ অনেক স্থানে তাঁহার বাঁধা আসর ছিল ৷ দুবরাজপুরে আমি বহুবার অখিল দাসের গান শুনিয়াছি ৷ অন্যান্য আসরেও তেমনই দেখিয়াছি; অখিলের গান শুনিয়া নরনারী মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন ৷ ১৩৩৩ সালে ৬ই আষাঢ় অখিল সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷ অখিলের জ্যেষ্ঠ পুত্র নিতাইপদ একজন বিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক৷ কনিষ্ঠ পুত্র হরিপদ দাস কলিকাতা বাগবাজারে শ্রীমদনমোহন মন্দিরের কীর্তনগায়ক৷