মুর্শিদাবাদ জেলায় ফতেসিংহ পরগণার মাণিক্যহার গ্রাম ৷ কীর্তনীয়া শচীনন্দন মাণিক্যহারের অধিবাসী ছিলেন ৷ এই গ্রাম প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে বীরভূমের অন্তভুর্ক্ত ছিল ৷ স্বনামধন্য মহারাজা নন্দকুমারের গুরুদেব সুবিখ্যাত পদকর্তা পদামৃতসমুদ্র গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা শ্রীল রাধামোহন ঠাকুরের দ্বিতীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম শ্রীভুবনমোহন ঠাকুর ৷ ভুবনমোহনের পুত্র কৃষ্ণরাও ঠাকুর গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য মালিহাটী হইতে আসিয়া মাণিক্যহারে বাস করেন ৷ মাণিক্যহারের প্রান্ত দিয়াই সুরধুনী আজিও প্রবাহিতা রহিয়াছেন ৷ মাণিক্যহারে সে সময় সিংহ উপাধিধারী কায়স্থ জমিদারগণের প্রাধান্য ছিল ৷ কৃষ্ণরাও গঙ্গস্নানে আসিলে জমিদারগণ তাঁহাকে বিশেষ সমাদরপূর্বক মাণিক্যহারে বাস করিতে অনুরোধ করেন ৷ সেই অবধি ভুবনমোহনের বংশধরগণ মাণিক্যহারেই বাস করিতেছেন ৷ কৃষ্ণরাও -এর পুত্র চৈতন্যহরি মাণিক্যহারে বহু ভূসম্পত্তি অর্জন করেন ৷ ইনি বাসের জন্য অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়াছিলেন ৷ একটি বাসগৃহে ১১৮৩ সাল খোদিত আছে ৷ চৈতন্যহরির পুত্র গৌরসুন্দর ৷ আবির্ভাব ১১৯৮ সাল; তিরোভাব ১২৩৯ সালের ২২শে চৈত্র শুক্লা চতুর্দশী ৷ গৌরপদ-তরঙ্গিণী গ্রন্থে ইঁহার রচিত পদ আছে ৷ শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোবর্ধন গিরিতটে ভজন করিতে গিয়া ইনি স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হন এবং তথা হইতে শ্রীকৃষ্ণের চরণাঙ্কিত শিলাখণ্ড লইয়া স্বগ্রামে ফিরিয়া আসেন ৷ তাঁহার প্রতিষ্ঠিত সেই শ্রীকৃষ্ণচরণচিহ্ন-যুক্ত শিলা আজিও মাণিক্যহারে পূজা প্রাপ্ত হইতেছেন ৷
সোনারুন্দী বনোয়ারীবাদের রাজপরিবার চৈতন্যহরির নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন ৷ ১৩০৮ সালে বনোয়ারীবাদের রাণী মনোমোহিনী মাণিক্যহারে শ্রীশ্রীরাধাশ্যাম যুগল-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠাপূর্বক সেবাপূজা পরিচালন জন্য কিছু দেবত্র সম্পত্তি দান করিয়াছেন ৷ গরিফার প্রসিদ্ধ সেন-বংশ গৌরসুন্দর ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য ৷ ইঁহাদের কেহ কেহ কলিকাতা কলুটোলায় আসিয়া বাস করেন ৷ স্বনামধন্য কেশবচন্দ্র সেন গরিফার সেন-বংশের সন্তান ৷ মাণিক্যহারের ঠাকুর মহাশয়গণ ১২০৮ সালে রাজসাহী জেলায় চাঁদপুর প্রভৃতি গ্রামের এবং ১২৩৭ সালে বীরভূমের বোলপুরের নিকট বাঁধগড়া বিনুরিয়া প্রভৃতি গ্রামের জমিদারী খরিদ করিয়াছিলেন ৷
গৌরসুন্দরের তিন পুত্র— প্রথম রাধাসুন্দর , দ্বিতীয় কৃষ্ণসুন্দর, তৃতীয় গিরিধারীলাল ৷ রাধাসুন্দর সংস্কৃতশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন ৷ কৃষ্ণসুন্দর সংস্কৃতশাস্ত্রে এবং সঙ্গীতশাস্ত্রে অসাধারণ অধিকার অর্জন করেন ৷ তাঁহার কণ্ঠস্বর বড় মধুর ছিল এবং তিনি কীর্তনগানে পারদর্শী ছিলেন ৷ শচীনন্দন কৃষ্ণসুন্দরের নিকটেই কীর্তনগান শিক্ষা করেন ৷ শচীনন্দনের পিতার নাম বনমালী দাস ৷ বনমালী মৃদঙ্গবাদ্যে সুদক্ষ ছিলেন ৷ বাছরা গ্রামের দীনবন্ধু দাস কীর্তনীয়ার দলে তিনি মৃদঙ্গ সঙ্গত করিতেন ৷ বনমালী পুত্র শচীনন্দনকেও অতি যত্নে শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ বনমালীর একমাত্র কন্যার বিবাহ হইয়াছিল বাছরা গ্রামে ৷ জামাতা রাধাবল্লভ দাসও কীর্তন গান করিতেন ৷ শচীনন্দন ভগিনীপতি রাধাবল্লভের দলে মৃদঙ্গ বাজাইতেন ৷
রাধাবল্লভ দাস স্বগ্রাম বাছরায় কীর্তন গাহিবেন ৷ শ্যালক শচীনন্দনকে সংবাদ পাঠাইয়াছেন, ঐ সঙ্গে শ্বশুর মহাশয়কেও গান শুনিবার আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন ৷ গান খুব জমিয়াছে, কিশোর শচীনন্দনের খোলের বাজনা শুনিয়া আনন্দিত হইয়া একজন শ্রোতা শচীনন্দনের হাতে একটি টাকা দিলেন ৷ রাধাবল্লভের পিতা আসরে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এখনো আসরে কিছু পড়ল না— আগে ভাগে ডোমের পরব ৷” বনমালী দাস তখন আর বৈবাহিককে কিছু বলিলেন না ৷ কীর্তন-শেষে বলিলেন, “দলের দোহার বাদক যে জনই পুরস্কৃত হউক তাহাতে মূল গায়কেরই গৌরব ৷ শচীনন্দন ছেলেমানুষ, সে রাধাবল্লভের আত্মীয়; তাহাকে যদি দয়া করিয়া কেহ কিছু দিয়াই থাকে, তাহাতে ক্ষতি কি হইয়াছে এবং আপনার এত ক্রোধের কারণই বা কি ঘটিয়াছে ৷” এই কথা শুনিয়া রাধাবল্লভের পিতা ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন এবং বনমালীকে কটূক্তি করেন ৷ বনমালী আর কিছু না বলিয়া শচীনন্দনের খোলখানি ভাঙ্গিয়া দিয়া বলেন, “শচীনন্দন জীবনে আর খোল ধরিবে না ৷ তাহাকে যদি কীর্তনীয়া তৈয়ার করিতে পারি, তবেই সে লোকসমাজে মুখ দেখাইবে, অন্যথায় সে আর বাড়ির বাহির হইবে না ৷” বাড়ি ফিরিয়া বনমালী শচীনন্দকে মাণিক্যহারের শ্রীল কৃষ্ণসুন্দর ঠাকুরের হাতে সঁপিয়া দেন ৷
কৃষ্ণসুন্দর ঠাকুর মহাশয় অতি যত্নে শচীনন্দনকে কীর্তন শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ মনোহরশাহী গীতি-পদ্ধতির সহিত বিশুদ্ধ রসপর্যায় এবং বিবিধ পদ ও উহাদের উপযোগী আখর প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানে তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নাই ৷ ঠাকুর মহাশয়ের নিকটে যে -সমস্ত গান শচীনন্দন শিখিয়া আসিতেন, বনমালী দাস সেই গানগুলি নিজে সঙ্গত করিয়া পুত্রের অনুশীলনে পুনঃ পুনঃ সাহায্য করিতেন ৷ কিছুদিনের মধ্যেই শচীনন্দনের শিক্ষা সমাপ্ত হইল এবং পিতার সাহায্যে উপযুক্ত দোহারবাদক সংগ্রহপূর্বক তিনি একটি সম্প্রদায় গঠন করিলেন ৷ বনমালী দাস বহুদিন পুত্রের দলে মৃদঙ্গ বাজাইয়াছিলেন ৷ পরে সুপ্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া নন্দকিশোর দাসের পিতা রাধাকৃষ্ণদাস শচীনন্দনের মৃদঙ্গবাদক নিযুক্ত হন ৷
বনমালী যখন বাছারার দীনবন্ধু দাসের খোল বাজাইতেন, সেই সময় কিশোর গণেশ দাস দীনবন্ধুর দলে দোহারি করিতেন ৷ গণেশের উপর অবিচার হওয়ায় বনমালী তাঁহাকে দীনবন্ধুর দল হইতে লইয়া আসেন এবং নিজের বাড়িতে রাখিয়া পুত্রের মত যত্নে শচীনন্দনের সঙ্গে কীর্তনশিক্ষা দান করেন ৷ গণেশকে দীনবন্ধুর দল হইতে ছাড়াইয়া লইবার সময় বনমালী নিজেও দীনবন্ধুর দল ত্যাগ করিয়াছিলেন ৷
১২৬৩ সালের কার্ত্তিক মাসে শচীনন্দনের জন্ম হয় ৷ ১৩৩৩ সালে বৈশাখ মাসে ষট্‌পঞ্চমীর দিন তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন ৷ শচীনন্দন সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিবার পর তাঁহার পত্নী যতদিন জীবিত ছিলেন গণেশ দাস প্রতি মাসে তাঁহার নিকট কয়েকটি টাকা প্রণামীস্বরূপ পাঠাইয়া দিতেন ৷ গণেশ দাস কিছুদিন শচীনন্দনের দলেও দোহারি করিয়াছিলেন ৷ বাঙ্গালার বিখ্যাত কীর্তনগায়কগণের মধ্যে শচীনন্দন অন্যতম ৷ অনেকেই তাঁহাকে বড় মূল গায়ক রসিক দাসের পরেই স্থান দিতেন ৷ আমি সর্বপ্রথম কাশিমবাজার গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মেলনে তাঁহার গান শুনি ৷ তাহার পর কয়েকবার মাত্র তাঁহার গান শুনিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল ৷ আমার প্রিয় গায়কগণের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন ৷