নদীয়া জেলায় ধাওয়াপাড়া গ্রাম ৷ এই গ্রামের নয়নানন্দ দাসের পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের নবাব-দরবার হইতে মণ্ডল উপাধি প্রাপ্ত হন ৷ নয়নের (পুত্রের নাম আনন্দ) পৌত্র শালগ্রাম বাল্যে বড় দুর্দান্ত ছিলেন ৷ লোকের গাছে চড়িয়া ফল পাড়িয়া আনিতেন, পাখির ছানা ধরিতেন ৷ আবার মাঝে মাঝে গাছের ডালে বসিয়াই গলা ছাড়িয়া গান করিতেন ৷ একদিন এক সন্ন্যাসী দূর হইতে তাহার গান শুনিয়া তাহাকে আপন আশ্রমে লইয়া যান ৷ দূরে বনের মধ্যে সন্ন্যাসীর আশ্রম ছিল ৷ তিনি আশ্রমে শালগ্রামকে কিছুদিন রাখিয়া লীলাকীর্তনের রূপ, গোষ্ঠ, দান, কলহান্তরিতা ও মাথুর এই পাঁচপালা গান শিক্ষা দেন ৷ এদিকে বাড়িতে মহা দুর্ভাবনা ৷ ধাওয়াপাড়ার চারিদিকেই নিবিড় জঙ্গল ছিল, আর জঙ্গলে বাঘের ভয় ছিল ৷ নানাস্থানে খোঁজ করিয়া সকলেই যখন আশা ছাড়িয়া দিয়াছে, এমনি সময় একদিন বাড়ি ফিরিয়া শালগ্রাম সকলকে জানাইলেন— আমি কীর্তন শিখিয়া আসিয়াছি ৷ সন্ধ্যায় সকলকেই গান শুনাইলেন এবং দুই-চারিদিনের মধ্যেই তিনি একটি কীর্তনের দল বাঁধিয়া ফেলিলেন ৷ দল চলিতে লাগিল, একদিন বারুইপাড়ায় শালগ্রাম বিশ্বাসের পিতার শ্রাদ্ধে গান করিতে গিয়া উভয়ের একই নাম বলিয়া তাঁহার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাইয়া আসিলেন ৷ এই ঘটনার কিছুদিন পরে জ্ঞাতিবিরোধে বিভক্ত হইয়া শালগ্রামের পিতা আনন্দরাম তাঁহার পুত্রের বন্ধু উক্ত শালগ্রাম বিশ্বাসের নিকট গিয়া বাসবাড়ির বন্দোবস্ত করেন এবং বারুইপাড়ায় উঠিয়া যান ৷ তদবধি তাঁহারা বারুইপাড়ার অধিবাসী ৷
শালগ্রামের পাঁচ পুত্র ৷ জ্যেষ্ঠ কানাই গান শিখিয়া মূল গায়ক হন ৷ তৃতীয় শ্রীদাম শির দোহার ও চতুর্থ সুবল মৃদঙ্গবাদক হইয়া দল গঠন করেন ৷ সুবলের পুত্র মহেশ ৷ মহেশ প্রথমে বাজনা শিখিয়া পরে গান শেখেন এবং মূল গায়ক হইয়া দল চালাইতে থাকেন ৷ মহেশের পুত্র গণেশ দাস ৷ ১২৬৭ সালে ৬ই অগ্রহায়ণ গণেশ দাস ভূমিষ্ঠ হন ৷
বাছারা গ্রামের দীনবন্ধু দাস একজন নামকরা কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ গণেশ এই দলে দোহারি করিতেন ৷ সাত-আট বৎসরের বালক গণেশ গ্রামের যাত্রার দলে গান শিখিত ৷ পরে পিতার নিকট দুই-একটি কীর্তনের গানও শিখিয়াছিলেন ৷ দীনবন্ধুর দলে খোল বাজাইতেন মাণিক্যহারের বনমালী দাস ৷ কীর্তনের দলে দোহার বাজিয়েদের এক পোয়া, দেড়টা, পাঁচটা এই রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ অংশ নির্দিষ্ট আছে ৷ দক্ষিণার টাকার এইরূপ একটা অংশ মূল গায়ককেও লইতে হয় ৷ দীনবন্ধু আপন পুত্রকে অধিক অংশ দিলে বনমালী দাস প্রতিবাদ করেন ৷ তিনি দীনবন্ধুকে বলেন, তোমার পুত্র অপেক্ষা গণেশের গলা ভাল, গণেশ পরিশ্রম করে খুব, সুতরাং তোমার পুত্রের অপেক্ষা গণেশের বেশী অংশ প্রাপ্য ৷ দীনবন্ধু এই প্রস্তাবে অস্বীকৃত হইলে বনমালী দল ত্যাগ করেন এবং গণেশকে নিজ বাড়িতে লইয়া আসেন ৷ পুত্র শচীনন্দনের সঙ্গে অতি যত্নেই তিনি গণেশকে কীর্তন শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ গণেশ কিছুদিন শচীনন্দনের দলে দোহারি করিয়াছিলেন ৷ কোন গ্রামে শচীনন্দন গান করিতে গেল শচীনন্দন ও গণেশকে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়া গান শুনাইয়া আসিতে হইত ৷ ১২৭৯ সালে ১০ই চৈত্র গণেশের মাতা পরলোকগমন করেন ৷ ১২৮১ সালে গুরু বনমালী দাসের গোলোকপ্রাপ্তি ঘটে ৷ গণেশ বাড়ি ফিরিয়া কীর্তনের দল গঠনে উদ্যোগী হন ৷
গণেশ দাস শ্রীধাম নবদ্বীপের বড় আখড়ায় গান করিতে আসিলেন ৷ কলিকাতার মাধব দত্তের প্রবর্তিত গানের ব্যবস্থা তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে ৷ ভাগ্যকুলের কুণ্ডুবাবুরা বড় আখড়ার গানের ব্যয়ভার বহন করিতেছেন ৷ বড় আখড়ার মোহান্ত কমল দাসের সহিত মনান্তর হওয়ায় কীর্তনীয়া বেণী দাস বড় আখড়া ছাড়িয়া লছমন দাসের আখড়ায় শ্রীবাসঅঙ্গনে গান করিতে গিয়াছেন ৷ এইজন্যই বড় আখড়ায় গণেশের বায়না হইয়াছে ৷ মান্দার বাটীর বিপিন দাস, ইলামবাজারের মনোহর চক্রবর্তী, সোনারুন্দীর চাঁদ বনোয়ারী, মানকরের নন্দ দাস, নবদ্বীপের হরিদাস, তাঁতিপাড়ার নিতাই দাস, দক্ষিণখণ্ডের রসিক দাস, বাসুদেবপুরের বেণী দাস প্রভৃতি কীর্তনীয়াগণের নবদ্বীপে তখন খুব নাম ৷ গণেশ গান করিলেন, শ্রোতৃগণের নিকট প্রশংসা হইল ৷ নবদ্বীপে গণেশের বাঁধা আসর হইয়া গেল ৷ নবদ্বীপেই রসিক দাস গণেশকে ধর্মপুত্ররূপে গ্রহণ করেন ৷ গণেশের বয়স যখন ঊনিশ বৎসর, সেই সময় তাঁহার পিতৃবিয়োগ ঘটে ৷ পিতৃবিয়োগের পর গণেশ নবদ্বীপে গান করিতে আসিলেন ৷ তাঁহার গান শুনিয়া বেণী দাস তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন ৷ রসিকের সহিত গণেশের ধর্মপিতাপুত্র সম্বন্ধ শুনিয়া বেণী দাসও তাঁহাকে পুত্ররূপেই গ্রহণ করিলেন ৷ পিতা নাই, শিক্ষার পথ বন্ধ হইয়াছে, অতএব এখন দল ভাঙ্গিয়া দিয়া কিছুদিন গান শিক্ষা করিব, গণেশ এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিলে বেণী দাস নিষেধ করিলেন ৷ গণেশ বেণী দাসের গান শুনিতে গিয়া আসরে বসিয়াই গান শিখিয়া আসিতেন ৷ মাঝে মাঝে তিনি দক্ষিণখণ্ডে রসিকের বাড়িতে গিয়াও গান শিখিতেন ৷ তিনি কিছুদিন পণ্ডিত বাবাজীর নিকটেও শিক্ষাগ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীধাম বৃন্দাবন, গয়াধাম, কাশীধাম, প্রয়াগ, পুরী, সুদূর মণিপুর প্রভৃতি দেশবিদেশের নানা স্থানে গণেশ গান করিয়াছেন ৷ অগণিত নরনারী তাঁহার কণ্ঠে শ্রীরাধাগোবিন্দলীলাকীর্তন শুনিয়া পরম পরিতৃপ্ত হইয়াছেন ৷ গণেশের কন্ঠ বড় মধুর ছিল ৷ কিন্তু মাত্র মধুর ছিল বলিলেই সব কথা বলা হইল না ৷ বিশেষ বড় তালের গান গণেশের কাছে শুনি নাই ৷ সাধারণতঃ সাদাসিধা গানই গণেশ গাহিতেন ৷ কিন্তু তাঁহার স্বরমাধুর্য একটা অনাস্বাদিতপূর্ব চমৎকারিতার সৃষ্টি করিত ৷ যে শুনিত, সে-ই মুগ্ধ হইত ৷ কীর্তনীয়া প্রেম দাসের কণ্ঠও সুমিষ্ট ছিল ৷ কিন্তু সে মিষ্টতা পৃথক্‌ জাতের, এই জাতিভেদ ভাষায় বুঝানো যায় না ৷
কলিকাতা হইতে ৺পুরীধামে যাইবার পূর্বে প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গণেশের গান শুনিয়া আশীর্বাদ করিয়া যান ৷ প্রভুপাদের তিরোভাব উৎসবে কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী গণেশের কীর্তনের ব্যবস্থা করেন ৷ মনীষী বিপিনচন্দ্র ও স্বনামধন্য চিত্তরঞ্জন সেই উৎসবে গণেশের গান শুনিয়াছিলেন ৷ চিত্তরঞ্জন গণেশ দাসকে রসা রোডের বাড়ীতে লইয়া গিয়া প্রায় একমাস তাঁহার গান শুনিয়োছিলেন ৷ বিলাত-ফেরত ব্যারিষ্টার এবং আই. সি. এস.-গণ কেহ কেহ অতঃপর চিত্তরঞ্জনের অনুসরণে কীর্তনগান এবং পদাবলী -সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন ৷ বলিতে গেলে গণেশের গানই কীর্তনকে কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে ৷ খালি ‘গা’ দেখিয়া দেশীয় মেমসাহেবরা যে মূর্ছা যান না, রসা রোডের আসরে সেটা প্রমাণিত হইয়া গেল ৷
১৩৪৪ সালে ৩১শে আশ্বিন রাত্রি আট ঘটিকায় এই মধুকণ্ঠ গায়ক নিত্যধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷