বীরভূম জেলার বোলপুরের প্রায় তিন ক্রোশ উত্তর-পূর্বে বরা গ্রাম ৷ এই বরাকে লোকে অপর বরা হইএত চিহ্নিত করিয়াছে বরা-ডোংরা নামে ৷ লক্ষ্মণ সেনের শক্তিপুর তাম্রশাসনে দামর-বরার উল্লেখ আছে কাহারো কাহারো মতে দুনো-বরাই দামর-বরা ৷ আমার সন্দেহ হয় ডোংরা-বরাই দামর-বরা ৷ এই গ্রামের রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় চৈতন্যমঙ্গলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন ৷ রামলালের পিতাও রামায়ণ, চৈতন্যমঙ্গল এবং কীর্তনগান করিতেন ৷ রামলালের পুত্র অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় ১২৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ৷ অবধূতের জন্মের বৎসরেই রামলাল পরলোকগত হন ৷ বীরভূমের চাকটা গ্রাম-নিবাসী অবধূতের মাতুল বিপিনবিহারী ঠাকুর মহাশয় ভাগিনেয়কে নিজবাটীতে লইয়া গিয়া লালনপালন করেন ৷ অবধূতের বয়স তখন দশ বৎসর ৷ ঠাকুর মহাশয় তাঁহাকে কান্দী রাজবাটীতে নটবর গোস্বামী মহাশয়ের চতুষ্পাঠীতে ভর্তি করিয়া দেন ৷ সেই সময় কান্দীতে একজন বিখ্যাত কীর্তন গায়ক ছিলেন—দামোদর কুণ্ডু ৷ পাঁচথুপির কৃষ্ণদায়াল চন্দের মত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত না হইলেও মনোহরসাহী সুরের কীর্তন-গায়কগণের মধ্যে কুণ্ডু মহাশয় সেকালে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়করূপে পরিচিত ছিলেন ৷ অবধূত টোলে সংস্কৃত শিখিতেন, দমোদর কুণ্ডুর নিকট কীর্তনের শিক্ষা গ্রহণ করিতেন ৷ রাজবাটীর কুলদেবতা শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ বিগ্রহের মন্দিরে প্রসাদের ব্যবস্থা এবং বিনা বেতনে শিক্ষা লাভের সুযোগ থাকায় অবধূতকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইতে হয় নাই ৷ মাতুল বিপিনবিহারীও খ্যাতনামা কীর্তনগায়ক ছিলেন ৷ তিনিও অবসর সময়ে ভাগিনেয়কে শিক্ষাদান করিতেন ৷
ছয় বৎসর শিক্ষালাভের পর ১২৮৮ সালের মাঘ মাসে সর্বপ্রথম তিনি নবদ্বীপে গান করিতে আসেন ৷ সেই বয়সেই তাঁহার পাণ্ডিত্য, রসজ্ঞতা, তাঁহার সূর ও তালের সহজাত মাত্রাবোধ নবদ্বীপের বৈষ্ণব ও পণ্ডিত -সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷ কীর্তনীয়াগণের মধ্যে সেকালে লেখাপড়া জানা গায়কের সংখ্যা খুবই কম ছিল ৷ যাঁহারা বংশপরম্পরায় কীর্তন গাহিয়া আসিতেছিলেন, তাঁহার বাড়ির ছেলেদের জীবিকার্জনের অবলম্বনস্বরূপ হয় কীর্তন, না হয় খোলের বাজনা শিক্ষা দিতেন ৷ বংশগত ধারার প্রবণতা উত্তরাধিকারিগণকে আকৃষ্ট করিত ৷ কেহ শিখিত, ভালই শিখিত, কেহ বা অল্পস্বল্প শিখিয়া পূর্বপুরুষের গৌরবে তরিয়া যাইত ৷ আবার কাহারো কিছুই হইত না ৷ ইহারা লেখাপড়া প্রায় শিখিত না, কোনরকমে পদাবলীটা আবৃত্তি করিতে পারিলেই খুব শিক্ষা হইয়াছে মনে করিত এমন কীর্তনীয়াও দেখিয়াছি, ভাল গায়ক অথচ সমস্ত পদের অর্থ ভালরূপে জানে না ৷ লিপিকর-প্রমাদে একটা পুঁথিতে কোন পদের পাঠ বিকৃত ছিল, গায়ক সে পাঠই মুখস্থ করিয়াছে ৷ এখন শুদ্ধ পাঠ গ্রহণ করিতে বলিলে উত্তর করে, ‘আমার গুরুদেব এই পাঠই শিখাইয়াছেন; তিনি এই পদ এই পাঠ ধরিয়াই গান করিতেন, সুতরাং আপনার কথা মানিতে হইলে গুরুর অসম্মান করা হইবে, কি করিব বলুন’, ইত্যাদি ৷
কীর্তনীয়াগণের মধ্যে খেসব মাড়গাঁয়ের রাধিকা সরকার মহাশয় পণ্ডিত ছিলেন ৷ পায়র গ্রাম-নিবাসী অক্ষয় দাস পরিণত বয়সে ঘুড়িসার মহামহোপাধ্যায় রামব্রহ্ম ন্যায়তীর্থ মহাশয়ের নিকট অধ্যয়নপূর্বক উজ্জ্বলনীলমণি আদি অধিগত করিয়াছিলেন ৷ ন্যায়তীর্থ মহাশয় প্রাচীনপন্থী পণ্ডিত ছিলেন, শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁহার অসাধারণ অধিকার ছিল ৷ অক্ষয় দাসকে তিনি অতি যত্নে শ্রীশ্রীরাসপঞ্চাধ্যায় পাঠ করাইয়াছিলেন ৷ উজ্জ্বলনীলমণি ও ভক্তিরসামৃত-সিন্ধুর অনেক শ্লোক অক্ষয় দাস মুখস্থ বলিতে পারিতেন ৷ অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় অল্প বয়সেই দল করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন ৷ কিন্তু তাঁহার শিক্ষার আগ্রহ ছিল প্রচুর ৷ তিনি নিজের চেষ্টায় শ্রীমদ্ভাগবত ও উজ্জ্বল নীলমণি প্রভৃতি শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়াছিলেন ৷ তাঁহার কোনরূপ গোঁড়ামি ছিল না ৷ তাঁহার জ্ঞানস্পৃহা এতই বলবতী ছিল, জানিবার কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসুা এতই প্রবল ছিল যে, পদের বিশুদ্ধ পাঠ অথবা প্রকৃত অর্থগ্রহণে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠার দিনে পরিণত বয়সেও তিনি কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করিতেন না ৷ তাঁহার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিও পরিমার্জিত এবং উচ্চস্তরের ছিল ৷
বিদ্যাপতির একটি পদের প্রচলিত পাঠ— ‘কবরী ভয়ে চমরী গেয় গিরিকন্দরে মুখ ভয়ে চান্দ আকাশে’, শ্রীখণ্ডের শ্রীল নরহরি সরকার ঠাকুর মহাশয়ের তিরোভাব-উৎসবে বড়ডাঙ্গার মেলায় তিনি গান করিতে আসিয়াছেন ৷ শ্রীগৌরগুণানন্দ ঠাকুরের ছাউনীতে বসিয়া তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিতেছি ৷ কথায় কথায় বলিলাম— পদের চমরী পাঠ ভুল ৷ এলো চুলের সঙ্গে চমরীর চামরের তুলনা চলিতে পারে ৷ কিন্তু কবরী তো খোঁপা ৷ তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলিলেন, ভুলই তো, প্রকৃত পাঠ— শিখি গেয় গিরিকন্দরে, কলাপীর কলাপের সঙ্গেই বিচিত্র মণিরত্ন-খচিত খোঁপার তুলনা হয় ৷ বলিলাম, ‘ও ধনী কে কহ বটে ৷ গোরাচনা গোরী নবীনা কিশোরী নাহিতে দেখিনু ঘাটে’৷ এই পদটি চণ্ডীদাসের নামে চলিতেছে, আমার কিন্তু সন্দেহ হয় ৷ তিনি বলিলেন, ও পদ চণ্ডীদাসের নয় ৷ জগন্নাথ দাসের ও লোচন দাসের দুইটি পদকে একসঙ্গে জুড়িয়া চণ্ডীদাসের নামে চালানো হইয়াছে ৷ তিনি আমাকে শ্রীখণ্ডের গ্রামের মধ্যে তাঁহার বাসায় লইয়া গেলেন এবং একটি পুঁথির মধ্যে জগন্নাথ দাসের ও লোচন দাসের পদ দুইটি দেখাইয়া দিলেন ৷ একটি পদ-সংগ্রহের পুঁথি তিনি সর্বদাই সঙ্গে রাখিতেন ৷ এই পুঁথিখানিতে বহু পদের বিশুদ্ধ পাঠ ও রসপর্যায়-গ্রথিত গানের পালা সাজানো ছিল ৷ তাঁহার লোকান্তরের পর তাঁহার পুত্র সুধাকরের নিকট হইতে এই পুঁথিখানি কোন তথাকথিত ধনী-সন্তানের দালাল মিথ্যা প্রলোভন দেখাইয়া লইয়া গিয়াছে ৷ আর ফেরত দিতেছে না ৷ অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পুঁথিখানি ছাপাইবার সঙ্কল্প ছিল ৷ তাঁহার নিত্যধামে গমনের পর তাঁহার কৃতী ছাত্র বাঙ্গালার বিখ্যাত কীর্তনীয়া শ্রীমান্ নন্দকিশোর দাস গুরুর স্মৃতিরক্ষাকল্পে এই পুঁথিখানি ছাপাইতে প্রস্তুত আছেন ৷ কিন্তু পুঁথিখানি ফেরত পাওয়া যাইতেছে না ৷
অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় রসিক দাসের নিকটেও গান শিখিয়ছিলেন ৷ এই জন্য রসিকের পুত্র রাধাশ্যামকে তিনি বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন ৷ কথায় কথায় রসিক দসের ঋণ স্বীকার করিতেন ৷ কথা দিয়া কথা রক্ষার জন্য তিনি সাধ্যেরও অতিরিক্ত প্রয়াস পাইতেন ৷ কাটোয়ার নিকটস্থ এক বৈষ্ণবের আখড়া তাঁহার বার্ষিক গানের ব্যবস্থা ছিল ৷ এক বৎসর গানের বায়না লইয়া তিনি সাত আট ক্রোশ দূরে এক গ্রামে গিয়াছিলেন ৷ রাত্রি ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি সুরু হইয়াছে ৷ ঘরের বাহির হওয়া দুঃসাধ্য ৷ তিনি কিন্তু সেই দুর্যোগেই সদলে পায়ে হাঁটিয়া বাহির হইয়া পড়িলেন ৷ মধ্যাহ্নে যথাস্থানে উপস্থিত হইয়া তিনি দেখিলেন কোন আয়োজন নাই ৷ আখড়াধারী বৈষ্ণব কি করিয়া জানিবেন যে এই দুর্যোগে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের মত একজন খ্যাতনামা কীর্তনীয়া এই বিনা দক্ষিণার গানের জন্য এত কষ্ট স্বীকার করিবেন ৷ সেদিন প্রসাদ গ্রহণ করিতে অপরাহ্ন হইয়া গিয়াছিল ৷ কুড়মিঠা গ্রামে বীরভূম সাহিত্য-সম্মেলনে আমি তাঁহাকে আমন্ত্রণ করিয়াছিলাম ৷ তিনি যথাসময়ে সদলে উপস্থিত হইয়া রূপানুরাগ গানে সকলকেই আনন্দ দান করিয়াছিলেন ৷ যত্রসামান্য পাথেয় ভিন্ন এক কপর্দকও তিনি গ্রহণ করেন নাই ৷
বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের গানে রস যেন মূর্ত হইয়া উঠিত ৷ বাঙ্গালার বহু বৈষ্ণব, বহু পণ্ডিত, বহু নরনারী তাঁহার একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন ৷ রসজ্ঞ শ্রোতৃসমাজে তাঁহার অসাধারণ প্রতিষ্ঠা ছিল ৷ এই সদালাপী নিরভিমান রসজ্ঞ ও ভাবুক গায়ক বাঙ্গালার অলঙ্কার ছিলেন ৷ বহু দিন হইতে চাকটা ত্যাগ করিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় শক্তিপুরে গঙ্গীতীরে বাস করিতেছিলেন ৷ বহু ছাত্র শক্তিপুরে তাঁহার নিকট কীর্তন শিক্ষা করিয়া সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন ৷ ১৩৫১সালের ২৩শে বৈশাখ শ্রীনৃসিংহ-চতুর্দশীর দিনে এই বহুজনপূজ্য গায়ক নিত্যলীলায় প্রবেশ করিয়াছেন ৷ বাঙ্গালার স্বনামপ্রসিদ্ধ গায়ক শ্রীমান্ নন্দকিশোর দাস তাঁহার স্মৃতিরক্ষা করিতেছেন ৷ অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের ধারা নন্দকিশোর অব্যাহত রাখিয়াছেন ৷