পিতা-মাতার দেওয়া নাম কৃষ্ণবন্ধু চৌধুরী ৷ শৈশবে মাতৃহীন হইলে পিসীমাতা তাঁহাকে রাজসাহী জেলার ব্যাঙ্গারী গ্রামে নিজের বাড়িতে লইয়া যান ৷ তিনিই ফটিক বলিয়া ডাকিতেন ৷ কৃষ্ণবন্ধু ফটিক নামেই পরিচিত ছিলেন ৷ কীর্তনীয়া ফটিক চৌধুরী বাঙ্গালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তনগায়ক ৷ পিতার নাম বিহারীলাল চৌধুরী ৷ জাতিতে মাহিষ্য ৷ নিবাস মুর্শিদাবাদ জেলার হাসানপুর, ডাকঘর দৌলতাবাদ ৷ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিপিনবন্ধু, তৃতীয় প্রাণবন্ধু, চতুর্থ জগবন্ধু— এই ভাইদের লইয়া মূলগায়ক সাজিয়া মধ্যম কৃষ্ণবন্ধু শৈশবে গান করিতেন—
সাপ খেলাইতে গিয়াছিলাম
তেঁতুলের বাজারে ৷
কেউ দিলে চালকলা কেউ ধরে মারে ৷৷
লাখইকে দংশিল রে
কাল নাগিনীতে ৷৷
এই গান গাহিয়া তাঁহার গ্রামের বাড়ি বাড়িও ঘুরিতেন ৷
ফটিকের জন্ম হইয়াছিল ১২৭৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে দশহরা গঙ্গাপূজার দিনে ৷
বিদ্যারম্ভ হইল রাজসাহীতে পাঠশালায় ৷ সেকালের ছাত্রবৃত্তি পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন ৷ সেইখানেই একজন বড় ওস্তাদের নিকট সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় ৷ সা রে গা মা সাধিয়া দুই-এক পদ ধ্রুপদ ও দুই-চারিটি খেয়াল গান শিখিয়াছিলেন৷ মোটামুটি অন্যান্য গানও কিছু কিছু আয়ত্ত করিয়াছিলেন ৷ পিতা ছোটখাট জমিদার ছিলেন, বাড়ির অবস্থা ভালই ছিল ৷ নানা স্থান হইতে বিবাহের সম্বন্ধ আসায় বাড়ি ফিরিতে হয় ৷ সতের আঠার বৎসর বয়সে বাড়ি ফেরেন ৷ ঊনিশ বৎসর বয়সে বগুড়া জেলার পার্বতীপুরের জমিদার বাড়িতে বিবাহ হয়৷
পিতা বৈঠকী গান পছন্দ করিতেন না, ভালভাসিতেন কীর্তন ৷ এইজন্য কীর্তন শিখিবার আগ্রহ হয় ৷ মুর্শিদাবাদ বরোঁয়া থানার কুঁকড়োজোল নিবাসী জীবনকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় একজন উঁচুদরের কথক ছিলেন ৷ তিনি উচ্চাঙ্গের কীর্তনও জানিতেন ৷ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় উলাসপুরে শ্রীমদ্ভাগবতের কথকতা করিতে আসেন ৷ সংবাদ পাইয়া ফটিক উলাসপুরে গিয়া উপস্থিত হন ৷ কথকতা একমাস চলিয়াছিল ৷ এই এক মাস ফটিক উলাসপুরে থাকিয়া কীর্তন শিখিলেন ৷ পদাবলীর ভাষা, ভাব ও সুরমাধুর্য তাঁহাকে মাতাইয়া তুলিল, তাঁহার নেশা জন্মিয়া গেল ৷ কথকতার শেষে চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বড়ি চলিয়া গেলন ৷ দুই-চারি দিন পরেই পত্নীর হাতের সোনার নারিকেল ফুল এগার টাকায় বন্ধক দিয়া ফটিক গৃহত্যাগ করিলেন ৷ ভোরে উঠিয়া একদিনে বাইশ ক্রোশ হাঁটিয়া উপস্থিত হইলেন কুঁকড়োজোলে ৷ ফটিকের শিখিবার আগ্রহ, একাগ্রতা এবং প্রতিভা দর্শনে চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের তাঁহার উপর একটা মমতা জন্মিয়াছিল ৷ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় সাদরে ফটিককে গ্রহণ করিলেন ৷ ফটিক চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেই রহিয়া গেলেন ৷ খাইতেন, গান শিখিতেন এবং গোরু চরাইতেন ৷ বাৎসরাধিক কাল কাটিয়া গেল, আরো কতদিন হয়তো কাটিত কে জানে ! পিতা চারিধারে তল্লাসী চালাইয়া না পাইয়া শেষে থানায় খবর দিয়া হুলিয়া করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া আনাইলেন ৷ ফটিক কিছুদিন গৃহে থাকিয়া পিতার সম্মতি লইয়া এবার বীরভূম জেলার ময়নাডালে গান শিখিতে গেলেন ৷ ময়নাডাল রাঢ়ের অন্যতম বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ ৷ সেখানে কীর্তন ও মৃদঙ্গ-শিক্ষার চতুষ্পাঠী ছিল ৷ বহু ছাত্র সেই চতুষ্পাঠী হইতে কীর্তন ও মৃদঙ্গ কৃতবিদ্য হইয়াছেন ৷ ময়নাডালের মিত্রঠাকুরগণ বিদ্যাদানের মত অন্নদানেও অকৃপণ ছিলেন ৷ শ্রীমহাপ্রভুর কৃপায় ময়নাডালের ভাণ্ডার চিরপূর্ণ ছিল ৷
ফটিকের গান শুনিয়া শ্রীল সুধাকৃষ্ণ মিত্রঠাকুর তাঁহাকে সাদরে গ্রহণ করিলেন এবং অতি যত্নে শিক্ষা দিতে লাগলেন ৷ ধনীর দুলাল ফটিক এমনই নিরভিমান ছিলেন যে, তাঁহার আচারে ব্যবহারে চালচলনে ঘুণাক্ষরেও কেহ কোনদিন সন্দেহ করিতে পারেন নাই তিনি অবস্থাপন্ন গৃহস্থের সন্তান ৷ তিনি কুঁকড়োজোলে গোরু চরাইতেন ৷ ময়নাডালেও দুই ক্রোশ দূরবর্তী দুবরাজপুরের হাট হইতে শ্রীমহাপ্রভু ভোগের তরিতরকারী কিনিয়া মাথায় তুলিয়া বহিয়া আনিতেন ৷ ময়নাডালে ফটিক বৎসারাধিক কাল ছিলেন ৷ সুধাকৃষ্ণ মিত্রঠাকুর একবার ফটিকের নিমন্ত্রণে হাসনপুর গিয়াছিলেন ৷ বাড়ির অবস্থা দেখিয়া ফটিকের বাজার-হাট এবং মাথায় তরকারীর বোঝা বহনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলেন ৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যেষ্ঠা কন্যা অপর্ণা দেবী একবার রাঢ়দেশের কয়েকজন কীর্তনীয়াকে কলিকাতায় আনাইয়াছিলেন; সেইবার মহামহোপাধ্যায় শ্রীল প্রমথনাথ তর্কভূষণ এবং শ্রীখণ্ডের শ্রীল রাখালানন্দ ঠাকুরের নেতৃত্বে তাঁহাদিগকে গুণানুসারে উপাধিও বিতরণ করিয়াছিলেন ৷ দেখিলাম ময়নাডালের বিখ্যাত কীর্তনীয়া রাসবিহারী মিত্রঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে ফটিক চৌধুরী আলাপ করিতেছেন ৷ শুনিলাম, রাসবিহারী বলিতেছেন ৷ আমার হাতে কত মার খেয়েছিস্ মনে আছে? ফটিক উত্তর করিতেছেন, — তা আর মনে নেই! কীর্তনীয়া হলে কি হয় তোদের সব খোলপিটানো শক্ত হাত ৷ তোর কিলে আমার পিঠে এখনো ব্যথা ধরে আছে ৷ তবে কি জানিস্, আমারো জোর কম ছিল না ৷ কিন্তু কি জানি গুরুগোষ্ঠী বেশী মারলে যদি অপরাধ হয়, তাই অল্পেই রেহাই দিতাম ৷
রাসবিহারী— সেই রোদে কাঁকরের পথে দুবরাজপুরের হাটে যাওয়া? ফটিক— সে তো ভাই তোদের জন্যে নয়, শ্রীমহাপ্রভুর ভোগের জন্যে তরিতরকারী আনতে যাওয়া, তাতে আর দুঃখ কি? রাসবিহারীর সঙ্গে ফটিকের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব প্রৌঢ় বয়সেও অটুট ছিল ৷
সুধাকর মিত্র ঠাকুর মহাশয় পুনরায় ফটিককে ময়নাডালে যাইতে অনুরোধ করেন ৷ কিন্তু আর তাঁহার যাওয়া ঘটে নাই ৷ বাড়িতে থাকিয়াই গ্রামের ছেলেদের লইয়া তিনি প্রতি সন্ধ্যায় কীতর্ন গান গাহিতেন ৷ সংবাদ পাইলে বিভিন্ন স্থানে ভক্তদের বাড়িতে গান গাহিতে যাইতেন ৷ মুর্শিদাবাদ শ্রীরামপুরের ভক্তপ্রবর দেবকীনন্দন সেন ফটিকের গান শুনিয়া তাঁহাকে কীর্তনের দল করিতে আদেশ দেন ৷ পিতা দ্বিতীয়বার বিবাহ করিয়া ফটিককে পৃথক্ করিয়া দিয়াছিলেন ৷
অন্য কোন বিদ্যা জানা নাই ৷ কতকটা জীবিকার জন্যও ফটিক সেন মহাশয়ের আদেশ মাথা পাতিয়া লইলেন ৷ সেন মহাশয়ের আশীর্বাদ সম্বল করিয়া ফটিক কীর্তনের দল গঠন করিলেন ৷ সদলে প্রথম গান করিতে গেলেন গ্রামের নিকটবর্তী ছুটিপুরে হরি মণ্ডলের বাড়িতে ৷ গান শুনিয়া সকলেই প্রশংসা করিলেন ৷ ফটিক প্রবল উৎসাহে দল চালাইতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন ৷ ফটিকের দল চলিতে লাগিল ৷ সুনামও বাড়িতে লাগিল ৷ তাঁহার অর্থাগমের পথও প্রশস্ত হইতে ক্রমে প্রশস্ততর হইয়া উঠিল ৷ সালটা মনে নাই ৷ শ্রীখণ্ডের বড়ডাঙ্গার উৎসবে গিয়াছি ৷ সঙ্গে আছেন শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৷ বলিলাম, চলুন একটু কীর্তন শুনিয়া আসি, ফটিকে চৌধুরীর গান হইতেছে ৷ ইতিপূর্বে আমি কাশিমবাজারে বৈষ্ণব সম্মেলনে ফটিকের ও মান্দারবাটীর বিপিন দাসের গান শুনিয়াছিলাম ৷ আমরা আসরের দিকে অগ্রসর হইতেছি৷ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় দাঁড়াইয়া পড়িলেন ৷ বলিলেন, এখানে কোন ফটোগ্রাফার নাই? জিজ্ঞাসা করিলাম কেন? তিনি বললেন— এই কীর্তনদলের একটা ছবি তুলিয়া লইত ৷ ফটিক চৌধুরী গান করিতেছেন, “বিমল হেম জিনি তনু অনুপাম রে তাহে শোভে বিন্দু বিন্দু ঘাম”৷ তাঁহার ডাহিনে বাজাইতেছেন বিখ্যাত বাদক ফণী মণ্ডল ৷ বামে বাজাইতেছেন চণ্ডীচরণ নান ও লক্ষ্মীনারায়ণ চক্রবর্তী ৷ ডাহিনে দোহারী করিতেছেন রজনীকান্ত রাণু ও বিজয়কৃষ্ণ দাস, বামে আছেন হরিদাস বাবাজী ৷ সমগ্র দল গানের তালে হেলিতেছে, দুলিতেছে, নাচিতেছে ৷ সারা আসরে যেন বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলিতেছে ৷ সুর মূর্ত, চক্ষের সম্মুখে ভাসিয়া উঠিতেছে — “বিমল হেম জিমি তনু অনুপাম রে” —কান প্রাণ ভরিয়া গেল ৷ আজিও সে সুর ভুলিতে পারি নাই, সে ছবি ভুলিতে পারি নাই৷ কলিকাতায় আসিয়া অপর্ণা দেবীর নিকট শ্রীখণ্ডের গানের গল্প করিলাম ৷ বৎসর দুই পরে অপর্ণা দেবী ফটিক চৌধুরীকে কলিকাতায় আনাইলেন ৷ সে-যাত্রায় তিনি মাসাবধি কাল কলিকাতায় ছিলেন ৷ গান শুনিয়া কলিকাতার শ্রোতৃমণ্ডলী একবাক্যে ফটিকের প্রশংসা করিয়াছিলেন । অপর্ণা দেবীর উপাধিদানের আসরেও ফটিক উপস্থিত হইয়াছিলেন ৷ বোধ হয় সেই শেষবার তাঁহার গান শুনিয়াছি ৷
ফটিক গানে আখর খুব কমই দিতেন ৷ গানের ব্যাকরণে তাঁহার প্রচুর পাণ্ডিত্য ছিল ৷ রাগালাপে, সুরমূর্ছনায়, আবৃত্তির মাধুর্যে তিনি সমগ্র আসর মাতাইয়া রাখিতেন ৷ গানের ধারা মনোহরসাহীর সঙ্গে রেণেটী মিশানো ৷ ভঙ্গীটি নতুন বলিয়াই মনে হইত ৷ ‘ধনী— চলিল রে’ অভিসারের এই পদটির সুর ফটিক চৌধুরীর নিকট হইতেই অপর্ণা দেবী শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷ বাদক ফণী মণ্ডল এখন নন্দকিশোরের দলে সঙ্গত করিতেছেন ৷ এই গান তিনি নন্দকিশোরকেও শিখাইয়াছেন ৷ “না যাইও যমুনাজলে তরুয়া কদম্বতলে চিকণ কালা করিয়াছে থানা” ৷ এই গান ফটিক চৌধুরীর মুখে যেমন শুনিয়াছিলাম তেমনটি আর কোথাও শুনিলাম না ৷ বহুবার শুনিয়াছি এমন গানও তাঁহার কণ্ঠে নূতন বলিয়া মনে হইয়াছিল ৷ ১৩৪৪ সালের ৫ই ফাল্গুন খাগড়ায় গঙ্গাতীরে আপন জামতার গৃহে রাত্রি বারটা ত্রিশ মিনিটের সময় শ্রীরাধাগোবিন্দলীলা স্মরণ করিতে করিতে এই শ্রীগৌরাঙ্গভক্ত গায়ক সজ্ঞানে সাধনোচিত ধামে প্রয়াণ করিয়াছেন ৷