বাঙ্গালার স্বনামধন্য কীর্তনীয়া পণ্ডিত বাবাজীর (অদ্বৈত দাসের) ছাত্র রাধারমণ দাস ১২৯০ সালের আশ্বিন মাসে শুক্লা ত্রয়োদশীর দিন জন্মগ্রহণ করেন ৷ জন্মস্থান বর্ধমান জেলায় অজয় নদের তীরবর্তী লাখুরিযা গ্রামে ৷ পিতার নাম রসিক দাস, জাতিতে বৈষ্ণব ৷ রসিকের দুইজন জ্যেষ্ঠ ও একজন কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন ৷ ইঁহারা বা ইঁহাদের পূর্বপুরুষ কেহ কীর্তনগান জানিতেন না; কেহ কেহ বেহালা, কেহ বা সারঙ্গ বাজাইতে পারিতেন ৷ রাধারমণের কণ্ঠ বড় মধুর ছিল, তিনি কীর্তন শিখিবার চেষ্টা করেন ৷
বর্ধমান জেলার নিরোল গ্রামের রাম-হৃষী নাম বিখ্যাত রামানন্দ ও হৃষীকেশ দুই ভাই-এর কীর্তনগানের তখন খুব চলতি৷ দুই ভাই-ই সুকণ্ঠ ছিলেন ৷ দুই ভাই একত্রে দল করিয়াছিলেন; এক সঙ্গেই গাহিতেন এবং জাত গানই গাহিতেন ৷ রাধারমণ প্রথম যৌবনে এই দুই ভাইয়ের নিকটেই গান শিক্ষা করিয়াছিলেন৷
রাধারমণ গান শিখিলেন, দলও করিলেন ৷ আশ-পাশের গ্রামে গাহিয়া কিছু কিছু যশ এবং অর্থও পাইতে লাগিলেন ৷ রাধারমণদের জোতজমা ছিল ৷ বর্ষায় চাষের সময় বাবা-জ্যেঠার সঙ্গে মাঠে খাটিতেও হইত ৷ একবার বর্ষায় চাষে খাটিয়া গায়ে কাদা মাখিয়া ঘরে ফিরিতেছেন, পথে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা ৷ রাধারমণ কিছুদিন পূর্বেই সেই গ্রামে গান করিয়া আসিয়াছেন ৷ ভদ্রলোক বলিলেন, “কি মূল গায়েন, গায়ে এত কাদা কেন?” যুবক রাধারমণে মনে বড় লজ্জা হইল ৷ তিনি গ্রাম ছাড়িলেন, কলিকাতায় পলাইয়া আসিলেন ৷ কলিকাতায় তখন কীর্তনগায়ক কোথায়? কে শিক্ষা দিবে? রাধারমণের সংবাদ পাইলেন— মুর্শিদাবাদ জেলার খর গ্রামের বিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক অখিল দাস গোয়াবাগানে বাসা করিয়া আছেন ৷ তিনি কীর্তনও জানিতেন ৷ গান জানিতেন, কিন্তু বিখ্যাত কীর্তনওয়ালী পান্না দাসীকে হালকা সুরের ঢপ কীর্তন শিখাইতে গিয়া মনোহরসাহী ধারার গান, দাগী গান, চর্চার অভাবে প্রায় ভুলিয়াই বসিয়াছিলেন ৷ যাহা হউক, রাধারমণ তাঁহার নিকট গান শিখিলেন ৷ কিন্তু কলিকাতায় উপার্জন হয় কই? অর্থ না হইলে নিজের গ্রাসাচ্ছাদন চলিবে কিরূপে? পিতা দরিদ্র, এক পয়সাও সাহায্য করিতে পারেন না ৷ রাধারমণ বিবাহ করিয়াছেন, অথচ উপার্জন নাই ৷ পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য দেখা দিল ৷ রাধারমণ শ্রীমহাপ্রভুকে স্মরণ করিয়া একদিন শ্রীধাম বৃন্দাবনে গিয়া উপস্থিত হইলেন ৷
পাবনা তারাসের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায় শ্রীধামবৃন্দাবনে কীর্তন শিক্ষাদানের জন্য একটি চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করিয়া দিয়াছিলেন ৷ আপন ধর্মানুরাগ ও চরিত্র-মাধুর্যে এই ধনকুবের জনসাধারণের নিকট রাজর্ষি খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন ৷ কীর্তনের টোলের অধ্যাপক অধ্যাপক ছিলেন পণ্ডিত বাবাজী ৷ ছাত্রদের বৃত্তি ছিল মাসিক ছয় টাকা ৷ তখনকার দিনে তাহাতে একজন মানুষের বেশ চলিত ৷ রাধারমণ পণ্ডিত বাবাজীর শরণ লইলেন ৷ তিনিও রাধারমণের কণ্ঠমাধুর্যে প্রীত হইয়া তাঁহাকে টোলে ভর্তি করিলেন ৷ কয়েকদিন মধ্যে রাধারমণের নিকট সমস্ত শুনিয়া তিনি লাখুরিয়ায় রসিক দাসকে সংবাদ দিলেন, এমন কি কিছুদিন পরে রাধারমণকে গৃহে পাঠাইয়া তাঁহার তরুণী পত্নীকেও শ্রীধাম আনাইলেন ৷
অদ্বৈত দাস বাবাজীকে যিনি খরচপত্র দিয়া রাঢ়দেশে কীর্তন শিখাইতে পাঠাইতেন এবং অদ্বৈত দাস শ্রীধাম ফিরিলে তাঁহার নিকট সেইসব গান শিখিতেন, তিনি বাঙ্গালীকুলতিলক অদ্বৈত বংশবিভূষণ সাধকশিরোমণি প্রভুপাদ শ্রীনীলমণি গোস্বামী মহোদয় ৷ প্রভুপাদের মুখে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করিয়া এবং তাঁহার রসজ্ঞাতায় ও পাণ্ডিত্য মুগ্ধ হইয়া মধ্যভারতের ছতরপুরাধিপতি বিশ্বনাথ সিংহ বাহাদুর তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ৷ জন্মার্জিত সুকৃতির বলে রাধারমণ শ্রীনীলমণি প্রভুর কৃপা প্রাপ্ত হন ৷ রাধারমণ পণ্ডিত বাবাজীর নিকট হরিনামামৃত ব্যাকরণ ও কীর্তন শিক্ষা করিতেন এবং শ্রীনীলমণি প্রভুর নিকট শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলারহস্যের গূঢ়মর্ম অবগত হইতেন ৷ দীর্ঘ আঠার বৎসর শিক্ষালাভের পর রাধারমন কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন৷
রাধারমণ কলিকাতায় আসিয়া রায় বাহাদুর রসময় মিত্রের সুনজরে পড়েন ৷ মিত্র মহাশয় কীর্তন গাহিতেন এবং কীর্তন ভাল জানিতেন ৷ তাঁহারই সুপারিসে রাধারমণ রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জীউর গায়করূপে নিযুক্ত হইয়াছিলেন ৷ কিন্তু রাধারমণের সঙ্গে সঙ্গত করিবে কে? অনেক খুঁজিয়া-পাতিয়া মুর্শিদাবাদ জেলার কয়শ-নিবাসী কোপা হরিদাসকে পাওয়া যায় ৷ তিনি দেহরক্ষা করিলে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দীর গোষ্ঠ দাস রাধারমণের সঙ্গে সঙ্গত করিতেন ৷ হরিদাস জাতিতে ছিলেন সূত্রধর, আর গোষ্ঠ ছিলেন বাইতি ৷ পাথুরিয়াঘাটা রাজবাটির বাঁধা গায়ক বলিয়া ইনি অপর কোন স্থানে কীর্তন গাহিবার সুযোগ পান নাই ৷ তাই বাঙ্গালার পল্লীর লোক ইঁহার নাম জানে না ৷ পাথুরিয়াঘাটার স্বর্গত ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষ মহাশয় নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেসনে একাধিকবার রাধারমণকে কীর্তন গানের সুযোগ দিয়াছিলেন ৷ বাঙ্গালা ১৩৫৩ সালে (ইং ১৯৪৭ খ্রীঃ) মিনার্ভা থিয়েটারে যে সঙ্গীত -সম্মেলন হয় আমি সেইখানে প্রথম তাঁহার গান শুনি ৷ তাঁহার শেষ গান শুনিয়াছি ১৩৬০ সালে বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে ৷ এই দইবারই তিনি প্রশংসা অর্জন করিয়াছিলেন ৷ বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে তাঁহার কণ্ঠের “উজোর হার উর পীত বসন ধর” গান আজিও আমি ভুলিতে পারি নাই ৷
রাধারমণের একটি পুত্র ছিল, তিনি পিতার জীবদ্দশাতেই লোকান্তরিত হইয়াছিলেন ৷ দুইটি কন্যা বর্তমান আছেন৷ গত ১৩৩৬ সালের ১১ই চৈত্র এই সুগায়ক সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷