বাঙ্গালার এক সময় মঙ্গল-গানের খুব সমাদর ছিল ৷ মঙ্গলচণ্ডীর গান, মনসামঙ্গল গান, ধর্মমঙ্গল গান এবং শিবের গান খুব পুরানো ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্ব হইতেই এই সমস্ত গান জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল ৷ কবি জয়দেবের শ্রীগীতগোবিন্দও মঙ্গলগান ৷ বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন তো ঝুমুরের ধারায় রচিত মঙ্গলগানের পুঁথি ৷ কৃষ্ণকীর্তন একেবারে যাহাকে বলে খাঁটী মঙ্গলকাব্য ৷ বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীমহাপ্রভুর পূর্ববর্তী কবি ৷ মহাপ্রভুর পূর্ববর্তী আর একজন কবি মালাধর বসু, যাঁহার উপাধি ছিল গুণরাজ খান ৷ কবির রচিত শ্রীকৃষ্ণবিজয় ও কৃষ্ণমঙ্গল; গায়কেরা শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের পদ গান করিতেন ৷ কৃত্তিবাস পণ্ডিতের রামায়ণও রামমঙ্গল-গান ৷ শ্রীমহাপ্রভুর সমসাময়িক কবি মাধবাচার্য শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল রচনা করেন৷ কৃষ্ণমঙ্গল গান করিতেন গায়কগণ ৷ মাধবের উপাধি ছিল কবিবল্লভ ৷ শ্রীমহাপ্রভুর তিরোধানের পর মহাপ্রভুর জীবন-কথা লইয়া শ্রীচৈতন্য ভাগবত রচনা করেন শ্রীবৃন্দাবন দাস ইহার পরেই কবি লোচন দাস শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচনা করেন ৷ লোচনের নিবাস ছিল মঙ্গলকোটের সন্নিহিত কোগ্রাম ৷ লোচন শ্রীখণ্ডের শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য ৷ এক সময় চৈতন্যমঙ্গল গনের বহুল প্রচলন ছিল ৷ চৈতন্যমঙ্গলের সিদ্ধ গায়ক ছিলেন অবধৌত দাস ৷ আমি বহুবার তাঁহার গান শুনিয়াছি ৷ সংক্ষেপে তাঁহার জীবনকথা বলিতেছি ৷
বীরভূম জেলায় কীর্নাহারের নিকট মধুডাঙ্গা গ্রাম ৷ এই গ্রামে ১২৬৬ সালে অবধৌত দাসের আবির্ভাব ৷ পিতার নাম নীলকমল দাস ৷ ইঁহারা পুরুষানুক্রমে কেহ বা চৈতন্যমঙ্গল গান করিতেন, কেহ বা মৃদঙ্গবাদক ছিলেন ৷ অবধৌত প্রথম যৌবনেই বীরভূমের কীর্তন ও মৃদঙ্গের শিক্ষাকেন্দ্র ময়নাডাল গ্রামে গিয়া তদানীন্তন স্বনামধন্য মৃদঙ্গচার্য শ্রীনিকুঞ্জবিহারী মিত্রঠাকুরের নিকট মৃদঙ্গ শিক্ষা করেন ৷ শিক্ষা সমাপ্তির পর বিখ্যাত গায়ক রসিক দাসের দলে কয়েক বৎসর এবং পরে রাধিকাপ্রসাদ সরকারের দলে কিছুদিন মৃদঙ্গ সঙ্গত করিয়া অবধৌত যখন একজন গণনীয় বাদকরূপে সুযশ অর্জন করিতেছেন, সেই সময় অকস্মাৎ তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন ৷ বয়স তখন ত্রিশ বৎসর অতীত হইয়াছে ৷ বহুবিধ চিকিৎসায় ফল না পাইয়া নিকটবর্তী জুবুটিয়া গ্রামে জম্পেশ্বর শিবের মন্দিরে গিয়া তিনি ধরনা দেন ৷ জীবনের কোন আশা নাই মনে করিয়া আত্মীয়স্বজনের অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া শিব-মন্দিরেই অবধৌত পড়িয়া রহিলেন ৷ অনাহারে অনিদ্রায় সপ্তম দিনের রাত্রিশেষে স্বপ্ন দেখিলেন, দেবাদিদেব মহাদেব কৃপাপূর্বক সদয় হইয়া বলিতেছেন, “কোন ভয় নাই ৷ তুমি রোগমুক্ত হইয়াছ ৷ গৃহে গিয়া শ্রীচৈতন্যমঙ্গল গান শিক্ষা কর, শ্রীচৈতন্যগুণগানই তোমার এই ব্যাধির একমাত্র মহৌষধ ৷ এই গানই তোমার জীবিকার অবলম্বন হইবে এবং এই গানেই তুমি সিদ্ধিলাভ করিবে ৷” শিববাক্য ব্যর্থ হয় নাই ৷ প্রায় নিরক্ষর অবধৌত চৈতন্যমঙ্গল গানে খ্যাতি ও অর্থের সঙ্গে বহুগুণী জ্ঞানী ও ভক্তের কৃপাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন ৷ শ্রীচৈতন্য-মহিমায় তাঁহার সাধনা সার্থক হইয়াছিল ৷ তাঁহার গান শুনিয়া একদিকে যেমন সেকালের বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তন-গায়ক রসিক দাস, স্বনামধন্য গায়ক গণেশ দাস, অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রভূত প্রশংসা করিয়াছেন, অন্যদিকে ভগবদ্ভক্ত শ্রীল রামদাস বাবাজী মহারাজ, বাবাজী মহারাজের শিষ্য ত্রিভঙ্গ দাস বাবাজী, শ্রীখণ্ডের শ্রীল রাখালানন্দ ঠাকুর শাস্ত্রী, কীর্তনাচার্য শ্রীগৌরগুণানন্দ ঠাকুর প্রভৃতিও তেমনই তাঁহার গানে প্রীত হইয়াছেন ৷ প্রবাদ আছে, ময়নাডালে শ্রীমহাপ্রভুর সম্মুখে মহাপ্রভুর বিবাহোৎসব গানের সময় শ্রীবিগ্রহের অঙ্গে ঘর্মবিন্দু দেখা দিয়াছিল ৷ শ্রীবিগ্রহের উত্তরীয় সিক্ত হইয়াছিল ৷ শ্রীধাম নবদ্বীপ, কাটোয়া, শ্রীখণ্ড, কান্দরা প্রভৃতি বৈষ্ণবতীর্থের সর্বত্রই তিনি সমাদৃত হইয়াছেন, ভক্তগণের কৃপা লাভ করিয়াছেন ৷
তিরাশি বৎসর বয়সে সজ্ঞানে ইষ্টনাম জপ করিতে করিতে ১৩৪৯ সালের গোষ্ঠাষ্টমীর মাত্র চারিদিন পূর্বে এই ভক্ত গায়ক নিত্যধামে গমন করেন ৷ শ্রীগোপালপুরে শ্রীবৃন্দাবন চন্দ্রের প্রাঙ্গণে গান করিয়া গৃহে ফিরিবার পথে একটি ক্ষ্যাপা কুকুর তাঁহাকে দংশন করে ৷ এই দংশনজনিত জ্বর লইয়া গৃহে ফিরিয়া তিনি শয্যা গ্রহণ করেন ৷ ইহার পর মাত্র তিনটি দিন তিনি ইহধামে ছিলেন ৷ কিন্তু এই কয়দিন ক্ষণেকের তরেও তাঁহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হয় নাই ৷