সেই যে ভিষকবর কবিরাজ গঙ্গাধর
শমন সভয়ে যাঁরে ছিল কৃতাঞ্জলি ৷
ভারতে সুখ্যাতি যাঁর চরকের টীকাকার
সে আমার সুখ-স্বপ্ন প্রিয়পুত্র বলি ৷

সে আজ বহুদিনের কথা ৷ যশোহরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে গিয়াছিলাম ৷ শুনিলাম মহাকবি মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্রী শ্রীযুক্তা মানকুমারী বসু যশোহর-প্রশস্তি পাঠ করিতেছেন ৷ তাহারই দুই ছত্র আজও মনে আছে, উদ্ধৃত করিয়া দিলাম ৷ ধন্বন্তরীর দ্বিতীয় অবতার ঋষিকল্প কবিরাজ, গঙ্গাধর যশোহর হইতে বহরমপুরে আসিয়া বাস করেন ৷ ইঁহার কৃতী ছাত্রদিগের অন্যতম ছিলেন মুর্শিদাবাদ পারুলিয়ার বিখ্যাত কবিরাজ গয়ানাথ সেন৷ ইনি বীরভুম রামপুরহাটে থাকিয়া চিকিৎসা করিতেন৷ গয়ানাথের তিন পুত্র-কেদারনাথ, সীতানাথ ও রমানাথ ৷ ন্যায়শাস্ত্র পাঠ না করিলে ‘চরক’ অধিগত হয় না ৷ চক্রদত্ত-কৃত চরকের টীকা পাওয়া যায় না ৷ চরকের গঙ্গাধরকৃত টীকার নাম ‘জল্প কল্পতরু’৷ জল্প কল্পতরু বুঝিবার জন্যই নব্যন্যায় অধ্যয়ন আবশ্যক ৷ গয়ানাথের তিন পুত্রই বিদ্বান্‌ ছিলেন, তবে রমানাথের পাণ্ডিত্যের প্রসিদ্ধি অধ্যাপক বাহ্মণ পণ্ডিতগণকেও বিস্মিত করে। রমানাথ এই চোঙ্গাধারী বাবাজীর কৃপা লাভ করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু প্রাণায়ামের প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ঘটায় রমানাথ মূর্ছারোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন ৷ রমানাথের নিকটেই বাবাজীর মহিমার কথা শুনিয়াছিলাম ৷ বাবাজী মহারাজ শ্রীপাদ নিত্যানন্দের আবির্ভাবভূমি একচক্রায় আসিয়া বাস করেন ৷
রমানাথ বলিতেন, বাবাজী মহোদয়ের পূর্বনিবাস শান্তিপুর, তিনি আচার্য অদ্বৈতের বংশধর ৷ কেহ কেহ বলিতেন, রাজসাহী জেলার কোন গ্রামে এক ব্রাহ্মণের গৃহে তিনি আবির্ভূত হইয়াছিলেন ৷ বাবাজী টাকা-পয়সা স্পর্শ করিতেন না, এমন কি কোন ধাতুপাত্রও ব্যবহার করিতেন না ৷ একটি বাঁশের চোঙ্গা সর্বদা তাঁহার সঙ্গে থাকিত ৷ তাই নাম হইয়াছিল চোঙ্গাধারী ৷ ব্রাহ্মমুহূর্তে গাত্রোত্থানপূর্বক পুষ্করিণীর যে ঘাটে সাধারণে স্নান করেন না তিনি সে পুষ্করিণীর আঘাটা স্নান সারিয়া এক চোঙ্গা লইয়া আসিতেন ৷ কোথাও ভিক্ষায় বাহির হইতেন না; কাহারও নিকট কিছু প্রার্থনা করিতেন না, অযাচিতভাবে যাহা পাওয়া যাইত তাহাই অভীষ্টদেবকে নিবেদনপূর্বক প্রসাদ পাইতেন ৷ রন্ধন করিতেন মৃৎপাত্রে এবং সেই রান্না হইত সমস্ত দ্রব্য একসঙ্গে ‘এক পাকে’৷ অতিথি অভ্যাগত এবং প্রার্থীকে প্রসাদ বিতরণ করিবেন ৷ প্রসাদ যাঁহারা গ্রহণ করিতেন, বলিতেন সে এক অপূর্ব বস্তু, অনাস্বাদিত স্বাদু৷
তিনি বিশ্বাস করিতেন, জতুগৃহদাহের পর পাণ্ডবগণ এই একচক্রায় আসিয়াছিলেন ৷ একটি স্থানকে তিনি ‘পাণ্ডবতলা’ নামে অভিহিত করেন ৷ পাণ্ডবতলায় একটি নিমগাছের তলায় তিনি শ্রীগিরিধারী মূর্তি পাইয়াছিলেন ৷ বাবাজী, মহারাজ এই গিরিধারীর সেবা এবং পূজা করিতেন ৷ গিরিধারী প্রাপ্তির পূর্বে তাঁহার সেব্য কোন শালগ্রামাদির সংবাদ পাওয়া যায় না ৷ প্রতিদিন বৈকালে তিনি গিরিধারী জীউকে একটি দোলার রাখিয়া দোলাইতেন ৷ কেহ কখনো তাঁহাকে কাহারো বাড়ি যাইতে দেখেন নাই ৷ দিনের বেলায় তিনি পাণ্ডবতলাতেই সাধন-ভজন করিতেন ৷ সন্ধ্যার পর অদূরবর্তী গর্ভবাসের আশ্রম-কুটীরে গিয়া উপস্থিত হইতেন, কিন্তু রাত্রিতে নিদ্রা যাইতেন না ৷ সারারাত্রি তাঁহার সাধন-ভজনেই অতিবাহিত হইত ৷ তাঁহার বিগ্রহপূজার কিংবা সাধন-ভজনের কোন আড়ম্বর ছিল না ৷ রমানাথ বলিয়াছিলেন, বাবাজী নাকি শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের এক ভাগিনেয়ের বিবাহে বরযাত্রী গিয়াছিলেন ৷ বাবাজীর বয়স কেহ অনুমান করিতে পারিতেন না ৷ তিনি সুদীর্ঘজীবী ছিলেন ৷ বরযাত্রী যাইবার প্রসঙ্গেই রাজসাহী জেলায় তাঁহার জন্মের কথা উঠে ৷
একচক্রার সীমানা পূর্বে বহুবিস্তৃত ছিল ৷ মৌড়েশ্বর কোটাসুর প্রভৃতি স্থান পূর্বে একচক্রার নামেই পরিচিত হইত ৷ একচক্রায় যমুনা নাম্নী অতি ক্ষুদ্র একটি নদী আছে ৷ তাহার এক পার্শ্বে বীরচন্দ্রপুর, অপর পার্শ্বে গর্ভবাস ৷ প্রবাদ আছে, শ্রীপাদ নিত্যানন্দপুত্র শ্রীবীরচন্দ্র প্রভুর নামেই একচক্রার এই অংশ বীরচন্দ্রপুর নামে পরিচিত হইয়াছে ৷ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর আবির্ভাবভূমিই গর্ভবাস নামে অভিহিত ৷ একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানকে নিত্যানন্দের সূতিকাগাররূপে চিহ্নিত করা হইত ৷ একটি প্রাচীন ইষ্টক স্তূপকে লোকে বলিত হাড়াই পণ্ডিতের বাসভবনের লুপ্তাবশেষ ৷ চোঙ্গাধারী বাবাজী মহারাজের সময় এই সমস্ত স্থানের কোনরূপ সংস্কার সাধিত না হইলেও বাবাজী মহারাজের প্রভাবে ধীরে ধীরে এ দিকে বহুলোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়৷
বীরভূম-বিবরণ দ্বিতীয় খণ্ড সঙ্কলনের সময় প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে দেখিয়াছিলাম বীরচন্দ্রপুরে বঙ্কিম রায় যুগলবিগ্রহ৷ বিশ্রাম তলায় শ্রীরামকৃষ্ণ, কদম্বখণ্ডীতে শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীগৌরাঙ্গ, গর্ভবাসে শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীগৌরাঙ্গ, বকুলতলায় শ্রীরাধাকান্ত ও গর্ভবাসের অদূরে চোঙ্গধারী বাবাজীর আশ্রমে শ্রীগিরিধারী জীউর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ৷ এক একজন নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব ভিক্ষার দ্বারা এই সমস্ত বিগ্রহের সেবা-পূজা নির্বাহ করিতেন ৷ অবশ্য শ্রীবঙ্কিম রায়, বিগ্রহের সেবা নিত্যানন্দ -বংশীয় গোস্বামীদের দ্বারা নির্বাহিত হইত ৷ চোঙ্গাধারী বাবাজীর তিরোধান ঘটে ১৩২০ সনের ৩রা আষাঢ় শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে ৷ বাবাজী মহারাজ কখনো কোন অলৌকিক শক্তি প্রকাশ করেন নাই ৷ তথাপি বহু আর্ত আতুর , রোগগ্রস্ত, আত্মীয়-বিয়োগকাতর নরনারী তাঁহার কৃপালাভে ধন্য হইয়াছেন— রোগমুক্ত হইয়াছেন, শোকমুক্ত হইয়াছেন৷ বাবাজীর তিরোধানের চৌদ্দ বৎসর পর ত্রিভঙ্গদাস বাবাজী স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া একচক্রায় আসিয়া বাস করেন এবং মন্দিরাদির সংস্কার ও সেবাপূজার পারিপাট্যবিধানে অগ্রসর হন ১৩৩৪ সালে ৷
মুর্শিদাবাদ জেলায় কীর্তিপুর গ্রাম ৷ এই গ্রামে সৎশূদ্র বংশে ত্রিভঙ্গদাসের জন্ম ৷ পিতার নাম ছবিলাল, মাতার নাম গরবিনী ৷ বাল্যকাল হইতেই ত্রিভঙ্গের ভগবদ্‌ভক্তি এতই প্রবল ছিল যে মাঠে চাষের কাজ করিবার সময়ও একটি ক্ষুদ্র ভাণ্ডে রোপিত তুলসী বৃক্ষ লইয়া যাইতেন ৷ তুলসীমূলে জল দিয়া পরে জল গ্রহণ করিতেন ৷ প্রথমত ইনি ভক্ত শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডলের কৃপা লাভ করেন ৷ মণ্ডল মহাশয় ত্রিভঙ্গকে কীর্তিপুর হইতে আনিয়া আপন গুরুপরিবারে দীক্ষিত করিয়াছিলেন ৷ সেই সময় ইনি কীর্তনীয়া দীনু দাসের নিকট কীর্তন শিক্ষা করিতেন ৷ পরে তিনি পাঁচথুপির স্বনামধন্য বনওয়ারীলাল সিংহের আশ্রয় প্রাপ্ত হন ৷ বনওয়ারীলাল তাঁহাকে নিজ হরিবাসরে বৈষ্ণব-সেবায় নিযুক্ত করেন ৷ পাঁচথুপিতে থাকিবার সময় প্রসিদ্ধ কীর্তন-শিক্ষক কৃষ্ণদয়াল চন্দের (চান্দজীর) সুযোগ্য শিষ্য অদ্বৈত দাসের কাশিমবাজার কীর্তন চতুষ্পাঠীতে ত্রিভঙ্গদাস কীর্তনশিক্ষার সুযোগ পাইয়াছিলেন ৷ মনোহরসাহী সুরের তিনি একজন সুদক্ষ গায়ক ছিলেন ৷ শ্রীখণ্ডের উৎসবে পর পর কয়েক বৎসরই আমি তাঁহার ‘রাস’ গান শুনিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলাম ৷ কীর্তনগানের স্বনামধন্য শিক্ষক শ্রীগৌর গুণানন্দ ঠাকুর ত্রিভঙ্গদাসের গানে দোহারি করিতেন ৷ প্রসিদ্ধ সাধক আচার্য শ্রীরাখালানন্দ ঠাকুর ত্রিভঙ্গদাসের রাসগানের প্রশংসায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিতেন ৷
সিংহজীর আজ্ঞাক্রমে পাঁচথুপি হইতে ত্রিভঙ্গদাস মাত্র চারি আনা পয়সা লইয়া পদব্রজে শ্রীধাম বৃন্দাবনে গিয়াছিলেন এবং মাসান্তে পায়ে হাটিয়াই পাঁচথুপি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন ৷ সিংহজীর অনুমতি লইয়া শ্রীধাম নীলাচলে গিয়া ত্রিভঙ্গদাস শ্রীরাধারমণ চরণ দাসের আশ্রয় প্রাপ্ত হন ৷ বড় বাবাজী তাঁহাকে বেষাশ্রয় দিয়া নাম রাখেন বনওয়ারীদাস ৷ কিন্তু সাধারণে তাঁহাকে ত্রিভঙ্গদাস বলিয়াই জানিত ৷ পুরীধামে ঝাঁজপেটা মঠে রাধারমণের (বড় বাবাজীর) আশ্রয়ে থাকিয়া তাঁহারই আদেশে ত্রিভঙ্গ পাঁচথুপিতে ফিরিয়া আসেন ৷
স্বপ্নাদিষ্ট হইয়া ১৩৩৪ সালে ত্রিভঙ্গদাস একচক্রায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন ৷ সুরু হইল আশ্রমের পারিপাট্য-বিধান, সেবাপরিচর্যার অনলস সাধনা ৷ দেশ-বিদেশে ভিক্ষা করিতেন ৷ সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন ৷ শ্রদ্ধার দান যেখানে যাহা-কিছু পাইতেন, একচক্রায় আনিয়া নিতাই-এর পাদমূলে সমর্পণ করিতেন ৷ নিতাইগত প্রাণ ত্রিভঙ্গদাসের মধুর ব্যবহারে একচক্রা তীর্থে সমাগত যাত্রিগণও পরম পরিতৃপ্ত হইতেন ৷ নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব-জগতের প্রতিভূ ছিলেন ত্রিভঙ্গদাস ৷ বাঙ্গালার কীর্তনীয়াগণও সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করিতেন ৷ মহারাস-নৃত্যের পর রসালসে শ্রীরাধাকৃষ্ণ যুগলকে কুসুমশয্যায় সুখ-শয়নে নিদ্রার ক্রোড়ে সমর্পণপূর্বক ত্রিভঙ্গদাস যখন গাহিতেন— “ধীরে ধীরে কও গো কথা রাই যেন জাগে না” — শ্রোতৃবৃন্দ সুরমাধূর্যে অনাস্বাদিত ভাবাদেশে যেন এক অদৃষ্ট কল্পলোকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িতেন ৷ এই গান যিনি বারেক শুনিয়াছেন, তিনি আমরণ স্মরণে রাখিবেন ৷
বাঙ্গালার নানা গ্রামে, বাঙ্গালার বাহিরে কত স্থানেই না তাঁহাকে দেখিয়াছি ৷ একবারের কথা মনে আছে ৷ পাটনায় সোদরপ্রতিম সুহৃৎ ডঃ শ্রীমান্‌ শম্ভুশরমের ধর্মপ্রাণা সহধর্মিণী তাঁহাকে অকপট ভক্তিতে সমাদর করিতেন ৷ একদিন তাঁহাকে লইয়া মনীষী প্রফুল্লরঞ্জনের (পি. আর. দাশের) আবাসে গিয়া উপস্থিত হইলাম ৷ দাশ মহাশয় তাঁহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন, শ্রদ্ধা করিতেন ৷ মনে হইল আমি যেন ত্রিভঙ্গদাসের সঙ্গগুণে দাশ মহাশয়ের নিকট নূতন ভাবে পরিচিত হইলাম ৷
১৩৩৬ সাল হইতেই ভিক্ষালব্ধ অর্থে একচক্রায় শ্রীপাদ নিত্যানন্দের শুভ আবির্ভাব-উৎসব উপলক্ষে ত্রিভঙ্গদাস নবরাত্রব্যাপী অখণ্ড শ্রীহরিনাম-কীর্তনের ব্যবস্থা করেন ৷ এই উৎসব উপলক্ষে নয় দিন তিনি সমাগত ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল পর্যন্ত সকল নরনারীকে প্রসাদ বিতরণ করিতেন ৷ নয় দিন ধরিয়া একচক্রায় আনন্দের প্লাবন বহিয়া যাইত ৷ একাধিক্রমে ষোল বৎসর ধরিয়া তিনি সমানভাবে এই উৎসব পরিনির্বাহ করেন ৷ ১৩৫১ সালের ১৪ই মাঘ এই উৎসবের সমাপ্তি হইয়াছে ৷ সমাপ্তিদিনে উৎসব-অঙ্গনেই তিনি চিরপ্রস্থান করেন ৷