বিখ্যাত কীর্তনগায়ক শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঘোষ যেন কীর্তন গাহিবার জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন ৷ পিতা স্বর্গত বীরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয় আকস্মিক ভাবে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ প্রাপ্ত হন। একজন লোক এই অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহ দুইটি বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল। তিনি মূর্তি দুইটি কিনিয়া পত্নী শ্রীমতী বীণাপাণির হাতে দেন ৷ বীণপাণি মূর্তিযুগলের পাদপদ্মে চন্দনের প্রলেপ দেখিয়া বুঝিতে পারেন ইহা কাহারো পূজিত বিগ্রহ ৷ স্বামীকে সে-কথা জানাইলে বীরেন্দ্রনাথ মূর্তি দুইটি স্বগৃহে প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিত্যপূজার ব্যবস্থা করেন— নামকরণ করেন শ্রীরাধারমণ ৷ বীরেন্দ্রনাথ নাই, কিন্তু রথীন্দ্র-জননী বীণাপাণির নিষ্ঠায় ভক্তিতে আদরে যত্নে বিগ্রহযুগল আজিও পূজা প্রাপ্ত হইতেছেন ৷ রথীন্দ্রনাথ এই পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ১৩২৮ সালের ১৫ই আশ্বিন মহালয়ার পুণ্যদিনে ৷ এই বাতাবরণেই রথীন্দ্রনাথ লালিত হইয়াছেন ৷
বাঙ্গালায় বার মাসে তের পার্বণ ৷ বিভিন্ন পর্বদিনে শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে লীলাকীর্তন হইত ৷ রথীন্দ্রনাথ আগ্রহভরে তাহা শুনিতেন ৷ মন্তাবাবুর গান শুনিয়া শুনিয়া নয়-দশ বৎসরের বালক পিতৃপ্রদত্ত একটি ছোট হারমোনিয়ামে তাহা অভ্যাস করিতেন ৷ মন্তাবাবু (গ্রামোফোন-খ্যাত এম.এন. ঘোষ) তাঁহার দিদিকে গান শিক্ষা দিতে আসিতেন ৷ বালকের গান শুনিয়া তিনি আনন্দিত হইলেন ৷ বালকের গানে হাতেখড়ি হইল মন্তাবাবুর নিকট ৷ বীরেন্দ্রনাথ জ্যেষ্ঠা ভগিনীর সঙ্গে কনিষ্ঠ রথীন্দ্রের মন্তাবাবুর নিকটে গান শিখিবার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন ৷ চৌদ্দপনের বৎসর বয়সের রথীন্দ্রনাথ শৈলেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নিকট শিখিতে লাগিলেন খেয়াল ঠুংরী টপ্পা ৷ সেই সঙ্গে ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁহাকে তবলাও শিক্ষা দিতে লাগিলেন ৷ পরে শ্রীযুক্ত পরেশনাথ ভট্টাচার্য রথীনকে তবলা ও পাখোয়াজ শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ তাঁহার তবলা -শিক্ষা সমাপ্ত হয় বিখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ কেরামৎউল্লা খাঁর নিকট ৷ রথীনের বয়স সে সময় পঁচিশ-ছাব্বিশ বৎসর ৷
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে অনেকের মত বীরেন্দ্রনাথও সপরিবারে কলিকাতা ছাড়িয়া যান এবং নবদ্বীপধামে গিয়া বাস করেন ৷ এই সময় সুপ্রসিদ্ধ গায়ক (শিবা) পশুপতির জ্যেষ্ঠ পুত্র একই কারণে নবদ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ রথীন্দ্র এই সুযোগ গ্রহণ করিলেন ৷ রামকৃষ্ণ মিশ্র রথীনকে প্রায় বৎসরকাল ধরিয়া গান শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ ইহার কিছুদিন পরেই মধুপুরে রথীনের পিতৃবিয়োগ ঘটে ৷ পিতার পারলৌকিক কৃত্য সম্পাদনের পর রথীন্দ্রনাথ সপরিবারে দার্জিলিঙ চলিয়া যান ৷
দার্জিলিঙে গিয়া দিন যেন কাটিতে চাহে না ৷ কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে স্থির হইল কলিকাতা হইতে দুই-একজন গায়ককে আনিতে পারিলে দিন কাটাইবার একটু সুযোগ পাওয়া যায় ৷ রথীনকে এখন তবলা বাজাইবার নেশায় ধরিয়াছে ৷ পিতৃশোক ভুলিবার জন্য তিনি এই একটা নেশাই গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু তাঁহার সঙ্গতের সঙ্গে সঙ্গীতে লয় রাখিতে পারে, দার্জিলিঙে সে-সময় তেমন গায়ক কেহ ছিলেন না ৷ বন্ধুরা চাঁদা তুলিয়া (শিবা) পশুপতির কনিষ্ঠ পুত্র বিষ্ণু মিশ্র, শ্রীসুখেন্দু গোস্বামী ও ওস্তাদ মোস্তাক আলি খাঁকে দার্জিলিঙে উপস্থিত করিলেন ৷ পালা করিয়া এক একদিন এক-একজনের বাড়িতে সঙ্গীতের বৈঠক বসিতে লাগিল ৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনদাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী মায়া বসু এই বৈঠকের নিয়মিত শ্রোত্রী ছিলেন ৷ একদিন হ্যাভলক ভিলায় তাঁহার বাড়িতে বৈঠক ৷ তিনি বলিলেন, দেখ রোজ রোজ এসব গান ভাল লাগে না ৷ তোমরা কেউ কীর্তন গাহিতে জান? রথীন বলিলেন— আমি জানি ৷ রথীন গাহিলেন চুটকী তালের পদাবলী রেকর্ড শুনিয়া শেখা — কৃষ্ণচন্দ্র দে, পান্না কীর্তনওয়ালী প্রভৃতির সুরের গান ৷ সেই হইল রথীন্দ্রনাথের কীর্তনগানের বর্ণপরিচয় ৷ দুই-একদিন পরে মায়া বসুর অনুরোধে কীর্তনের মূল গায়কদের মত তিনি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াও গান করেন ৷ অতঃপর পিতার পরলোকগমনের বৎসরান্তে সপণ্ডিকরণ উপলক্ষে কীর্তনীয়া শ্রীরেণুপদ অধিকারীকে রথীন্দ্রনাথ দার্জিলিঙ লইয়া যান ৷ রেণুপদ তিন দিন মাত্র ছিলেন ৷ এই তিন দিনেই তাঁহার নিকট রথীন্দ্রনাথ নৌকাবিলাস ও মাথুর পালা শিক্ষা করেন ৷ দার্জিলিঙে তিনি বহু বৈঠকে এই দুইটি পালাগান করিয়াছিলেন ৷
কলিকাতা ফিরিয়া রেণুপদ অধিকারীর নিকট কীর্তন ও সুখেন্দু গোস্বামীর নিকট মার্গসঙ্গীতে শিক্ষা চলিতে লাগিল ৷ তারপরে একদিন আসিল শুভ সুযোগ ৷ ১৩৫৮ সালে রাঢ়ের স্বনামধন্য কীর্তনগায়ক শ্রীনন্দকিশোর দাস লীলাগীতিসুধাকর কলিকাতায় কীর্তন গাহিতে আসিলেন ৷ নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীর পুত্র যদুগোপালের জামাতা রথীন্দ্রনাথের ময়দা-কলের সরকারী পরিদর্শক শ্রীসুধাকর সরখেল রথীনকে বলিলেন, চলুন,— নন্দকিশোরের কীর্তন শুনিয়া আসি ৷ রথীন্দ্রনাথ তখনও নন্দকিশোরের নাম পর্যন্ত জানিতেন না ৷ সরখেলের নির্বন্ধাতিশয্যে রথীন্দ্রনাথ নন্দকিশোরের গান শুনিলেন ৷ শুনিয়াই বুঝিলেন এই গানের ধারা পৃথক্ ৷ ইহা বাঙ্গালার এক অপূর্ব সম্পদ্ ৷ ইহা তাঁহার শেখা চটুল গান নহে ৷ পর পর দুই দিন গান শুনিয়া তিনি নন্দকিশোরকে যথাযোগ্য দক্ষিণা দিবার প্রতিশ্রুতিতে নিজ বাড়িতে দুই দিন গানের আমন্ত্রণ জানাইলেন ৷ ইহার পর আরও তিন-চার দিন নন্দকিশোরের গান শুনিয়া তাঁহাকে তিনি কীর্তন -শিক্ষার গুরুপদে বরণ করেন ৷ নন্দকিশোরের নিকট কয়েকটি পালাগান শিখিয়া তিনি অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, আর কাহার নিকট কীর্তনগানে শিক্ষা করা যায় ৷ শ্রীবৃন্দাবনের নিত্যলীলা-প্রবিষ্ট প্রভুপাদ শ্রীগৌরগোপাল ভাগবতভূষণ হাওড়ায় আসিয়া বাস করিলে রথীন্দ্রনাথ তাঁহার নিকট কয়েকটি গান শিক্ষা করেন ৷ পরে বিখ্যাত কীর্তনীয়া রাম ও হৃষী দুই ভাইয়ের মধ্যে হৃষীর নিকট এবং বড় মূল গায়েন রসিক দাসের পুত্র রাধাশ্যামের নিকট দু-চারিটি গান শিখিবার সুযোগ পাইয়াছেন ৷ পরলোক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন ধরিয়া রথীনকে নিয়মিত কীর্তন শিক্ষা দিয়াছিলেন ৷ স্বধামগত কীর্তনীয়া যামিনীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নিকটও তিনি দুই-চারিটি পদ শিখিয়াছেন সুবিখ্যাত কীর্তনগায়ক নিত্যধামগত অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র কীর্তনীয়া শ্রীপঞ্চানন দাসকে তিনি নিজ বাড়িতে রাখিয়া প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া কীর্তনের বহু পদ শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷
কীর্তন শিখিতে গিয়া রথীন্দ্রনাথ বুঝিতে পারেন বাঙ্গালার কীর্তনীয়াগণ কর্মসিদ্ধ ৷ তাঁহারা গুরুমুখে গান শিখিয়াছেন, গান পরিবেশনের সময় বুঝিতে পারেন না, কি অপূর্ব রসাবেশে শ্রোতৃগণকে মুগ্ধ করে তাঁহাদের গান ৷ কিন্তু স্বরগ্রামের অভ্যাস না থাকায় বিশুদ্ধ স্বরালাপ হইতে তাঁহার যেন মাঝে স্থানচ্যুত হইয়া পড়েন ৷ অথচ পদাবলীর অনেক পদের উপর রাগ ও তাল লেখা আছে ৷ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর শ্রীবৃন্দাবনে তানসেনের সঙ্গীত গুরু শ্রীল হরিদাস স্বামীর নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করিয়া আসিয়াছিলেন ৷ তাঁহার প্রবর্তিত লীলাগান কখনও বেসুরো বেতালা হইতে পারে না ৷ বহু কীর্তনগায়ক তালের দিকে দক্ষতার পরিচয় দেন, কিন্তু গান গাহিবার সময় পর্দা ঠিক রাখিতে পারেন না ৷ এইজন্য রথীন্দ্রনাথ কীর্তন লইয়া সাধনা আরম্ভ করিয়াছেন ৷ তিনি চেষ্টা করিতেছেন, প্রভাতের গান খণ্ডিতা, কুঞ্জভঙ্গ, গোষ্ঠলীলা প্রভৃতি গান তিনি প্রভাতের উপযোগী সুরেই গাহিবেন ৷ উত্তরগোষ্ঠ বৈকালিক সুরেই গাহিতে হইবে ৷ অবশ্য রাত্রিকালের গানে সকল সময় সময়োচিত সুর সংযোগ করা যায় না এবং তাহাতে দোষ হয় না ৷ কারণ সঙ্গীতশাস্ত্র বলিতেছেন, “রঙ্গভূমৌ নৃপাজ্ঞায়াং কালদোষো না বিদ্যতে”৷ আমরা আশা করি, এই নিরসল সাধানায় তাঁহার সিদ্ধিলাভ ঘটিবে ৷ সুমিষ্ট কণ্ঠ, বিশুদ্ধ সুর-তালের দিকে সতর্ক দৃষ্টি, পদাবলীর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য বিশ্লেষণ এবং বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যায় ও লীলাগানের রসপর্যায় অনুসরণে নিষ্ঠা, সেই সঙ্গে আখরের পারিপাট্য রথীন্দ্রনাথকে স্বনামপ্রসিদ্ধ করিয়া তুলিয়াছে ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভু তাঁহাকে শতায়ু দান করুন ৷
কয়েকটি ছায়াচিত্রেও তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করিয়াছেন ৷ প্রসঙ্গক্রমে বৃন্দাবনলীলা, নিত্যানন্দ প্রভু, নৃত্যেরি তালে তালে, মিস্টার ও মিসেস চৌধুরী, নদের নিমাই, শেষ চিহ্ন, রাধাকৃষ্ণ, রূপ সনাতন, মহাতীর্থ কালিঘাট প্রভৃতির নাম করিতে পারি ৷ রথীন্দ্রনাথ একজন বিখ্যাত রেডিও -গায়ক ৷ প্রাচীন সঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত, আধুনিক সঙ্গীত প্রভৃতির সুরকার ও গায়করূপেও তাঁহার সুনাম আছে ৷ তিনি কীর্তনগান গাহিতে গিয়া নানা স্থান হইতে বহু উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছেন ৷