পঞ্চতত্ত্ব
ভক্ত রূপ শ্রীগৌরাঙ্গ, ভক্ত স্বরূপ শ্রীনিত্যানন্দ, ভক্তাবতার শ্রীঅদ্বৈত ৷ ভক্ত শ্রীশ্রীবাস ও ভক্ত শক্তি শ্রীগদাধর ৷

ছয় গোস্বামী
শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ, শ্রীরঘুনাথ ভট্ট, শ্রীগোপাল ভট্ট, শ্রীজীব ও শ্রীরঘুনাথ দাস; অপর দুই গোস্বামী শ্রীভূগর্ভ ও শ্রীলোকনাথ ৷

ছয় চক্রবর্তী
শ্রীব্যাস, শ্রীদাম, শ্রীগোকুলানন্দ, শ্রীশ্যামদাস, শ্রীগোবিন্দ (ভাবক চক্রবর্তী) ও শ্রীরামচরণ ৷

অষ্ট কবিরাজ
শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীগোবিন্দ, শ্রীকর্ণপুর, শ্রীনৃসিংহ, শ্রীভগবান্‌, শ্রীবল্লবীকান্ত, শ্রীগোপীরমণ ও শ্রীগোকুল ৷

অষ্ট প্রধান মোহান্ত
শ্রীস্বরূপ দামোদর, শ্রীরায় রামানন্দ, শ্রীগোবিন্দানন্দ, শ্রীবসু রামানন্দ, শ্রীসেন শিবানন্দ, শ্রীগোবিন্দ ঘোষ, শ্রীমাধব ঘোষ (মতান্তরে শ্রীবক্রেশ্বর পণ্ডিত) ও শ্রীবাসুদেব ঘোষ ৷

দ্বাদশ গোপাল
শ্রীঅভিরাম ঠাকুর, শ্রীউদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর, শ্রীকমলাকর পিপলাই, শ্রীকালা কৃষ্ণদাস, শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিত, শ্রীধনঞ্জয় পণ্ডিত, শ্রীপরমেশ্বরী দাস, শ্রীনাগর পুরুষোত্তম, শ্রীপুরুষোত্তম দাস, শ্রীমহেশ পণ্ডিত, শ্রীশ্রীধর (খোলাবেচা) ও শ্রীসুন্দরানন্দ ঠাকুর ৷
দ্বাদশ উপগোপাল
শ্রীহলায়ুধ ঠাকুর (রামচন্দ্রপুর), শ্রীরুদ্র পণ্ডিত (বল্লভপুর), শ্রীমুকুন্দানন্দ (নবদ্বীপ), শ্রীকাশীশ্বর (বল্লভপুর), শ্রীওঝা বনমালী (কুল্যাপাড়া) শ্রীমন্ত ঠাকুর (রুকুনপুর), শ্রীমুরারি মাইতি (বংশীটোটা), শ্রীগঙ্গাদাস (নৈহাটী), শ্রীগোপাল ঠাকুর (গৌরাঙ্গপুর), শ্রীশিবাই (বেলুন), শ্রীনন্দাই (শালিগ্রাম), শ্রীবিষ্ণাই (ঝামটপুর)৷

চৌষট্টি মোহান্ত
শ্রীস্বরূপ দামোদর প্রধান
রত্নগর্ভ ঠাকুর, চন্দ্রশেখর আচার্য, মুকুন্দ দত্ত, ভূগর্ভ ঠাকুর, রাঘব গোস্বামী দামোদর পণ্ডিত, কৃষ্ণদাস ঠাকুর ও কৃষ্ণানন্দ ঠাকুর ৷
শ্রীরায় রামানন্দ প্রধান
মাধব সঞ্জয়, নীলাম্বর ঠাকুর, রামচন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দত্ত, নন্দন আচার্য, শঙ্কর ঠাকুর, সুদর্শন ঠাকুর ও সুবুদ্ধি মিশ্র ৷
শ্রীগোবিন্দানন্দ ঠাকুর প্রধান
শ্রীমান পণ্ডিত, ঠাকুর জগন্নাথ দাস, জগদীশ ঠাকুর, সদাশিব ঠাকুর, রায় মুকুন্দ, মুকুন্দানন্দ, পুরন্দর আচার্য ও নারায়ণ বাচস্পতি ৷
শ্রীবসু রামানন্দ প্রধান
পরমানন্দ ঠাকুর, বল্লভ ঠাকুর, জগদীশ ঠাকুর, বনমালী দাস, শ্রীকর পণ্ডিত, শ্রীনিধি পণ্ডিত, লক্ষ্মণ আচার্য ও পুরুষোত্তম পণ্ডিত ৷
শ্রীসেন শিবানন্দ প্রধান
মকরধ্বজ দত্ত, রঘুনাথ দত্ত, মধু পণ্ডিত, বিষ্ণুদাস আচার্য, পুরন্দর মিশ্র, গোবিন্দ ঠাকুর, পরমানন্দ গুপ্ত ও বলরাম দাস ৷
শ্রীগোবিন্দ ঘোষ প্রধান
কাশী মিশ্র, শিখি মাহিতি, শ্রীরাম পণ্ডিত, বড় হরিদাস, কবিচন্দ্র, হিরণ্যগর্ভ, জগন্নাথ সেন ও দ্বিজ পীতাম্বর ৷
শ্রীমাধব ঘোষ প্রধান
মকরধ্বজ সেন, বিদ্যাবাচস্পতি, গোবিন্দ ঠাকুর, মহেশ ঠাকুর, শ্রীকান্ত, মাধব পণ্ডিত, প্রবোধানন্দ সরস্বতী ও বলভদ্র ভট্টাচার্য ৷
শ্রীবাসুদেব ঘোষ প্রধান
রাঘব পণ্ডিত, মুরারি চৈতন্য দাস, মকরধ্বজ পণ্ডিত, কংসারি সেন, শ্রীজীব পণ্ডিত, মুকুন্দ কবিরাজ, ছোট হরিদাস ও কবিচন্দ্র গুপ্ত ৷

(২)

শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর ‘রবীন্দ্রমানসের উৎস সন্ধানে’ বইএর ‘রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞাতবাসর সঙ্গী’ হইতে উদ্ধৃত—
শিবনাথ সাহা— এঁর বাড়ি ঠাকুর জমিদারীর কমলাপুর গ্রামে বিখ্যাত গঞ্জ জানিপুরের (খোক্‌সা ষ্টেসন নদীয়া) পূর্বে গোরাই নদীর তীরে ৷ এককালে মনোহরসাহী কীর্তনগানে ইনি ঐ অঞ্চল মাতিয়ে তুলেছিলেন৷ যৌবনে রবীন্দ্রনাথ জানিপুর মহাল পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় জনসাধারণ মহাসমারোহে তাঁর অভ্যর্থনা করেন৷ ঐ সভায় প্রশস্তিপাঠ, বক্তৃতাদি ছাড়াও ‘শিবুসা’র কীর্তন হয় ৷ তখনই রবীন্দ্রনাথ শিবুসার কীর্তনে আকৃষ্ট হন ৷ সে সময় বামাচরণ বসু ঠাকুর এষ্টেটের ম্যানেজার ছিলেন, তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত পরম বৈষ্ণব ও বিচক্ষণ ম্যানেজার ৷ ঐ দিন রাত্রে রবীন্দ্রনাথ বামাচরণ বাবু ও শিবুসার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বৈষ্ণব রসতত্ত্ব ও ভক্তিশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করেন ৷ জানিপুরে গেলেই রবীন্দ্রনাথ শিবুসাকে ডেকে আনিয়ে কীর্তন শুনতেন ৷ শিলাইদহ কাছারিতে প্রতি বৎসর পুণ্যাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে শিবুসার কীর্তনগান হত ৷ রবীন্দ্রনাথ এঁকে বিনা নজরে অনেক জমি বন্দোবস্ত দেন ৷ শিবুসার কীর্তন সে সময়ে হিন্দুদের যাবতীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে দেশময় কীর্তনানন্দ বিতরণ করে ৷ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগের পর রবীন্দ্রনাথ সদলবলে শিবু সাহাকে কলকাতা ঠাকুরভবনে নিয়ে আসেন ৷ গগনেন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের সকলেই শিবু সার কীর্তনগানে মুগ্ধ হন ৷ স্বর্গীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে শিবু সাহ বহুবার কীর্তনগান করেন ৷ তার পরে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর গৃহে, আচার্য জগদীশচন্দ্রের গৃহে, নাটোর ও পাইকপাড়া রাজবাড়িতে কীর্তন গেয়ে শিবু সাহা কলিকাতাবাসী অভিজাতবর্গকে মুগ্ধ করেন ৷ সমস্ত বঙ্গদেশে এঁর খ্যাতি রটে যায় ৷ স্বর্গত দীনেশচন্দ্র সেন দশবারো বছর পূর্বেকার আনন্দবাজার পত্রিকায় (পূজা সংখ্যা) ‘কলিকাতায় কীর্তনের আদর’ নামে এক প্রবন্ধে এঁর বিস্তারিত পরিচয় দিয়েছিলেন ৷ তাঁর রচিত ‘মুক্তাচুরি’ গ্রন্থেও এঁর উল্লেখ আছে ৷ এমন একদিন ছিল যেদিন অপূর্ব কীর্তনানন্দে বাংলার আকাশ -বাতাস মুখরিত হত ৷ এঁর ফুলমালাশোভিত সুঠাম দেহে কীর্তনানন্দের যে সুমধুর অভিব্যক্তি প্রকাশিত হত, তা এখনও আমাদের কানের ও চোখের ভিতর দিয়ে রসপ্রবাহের সৃষ্টি করে ৷
প্রসঙ্গত কৌতুহলী-পাঠকের কাছে আর একজন মরমীয়া সাধকের প্রসঙ্গ নিবেদন করি ৷

অধরচাঁদ সন্ন্যাসী— ইনি প্রথমে ছিলেন বৈষ্ণব ৷ পরে হয়ে যান সহজিয়াভাবের ভাবুক ৷ এঁর গৃহস্থাশ্রমের নাম সতীশচন্দ্র সরকার ৷ বিভিন্ন মত নিয়ে ইন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শেষে রবীন্দ্রনাথের ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে বহুবার তাঁর উপদেশ গ্রহণ করেন ৷ “বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়”— রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব কবিতায় এঁর ধর্মবিশ্বাস এক নূতন খাতে বইতে থাকে ৷ ইনি পল্লীতে ও কলকাতাতেও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে কীর্তন শিক্ষার নানা আয়োজন করেন ৷ ‘রসরাজ’ নামে একখানি মাসিক পত্রিকাও ইনি বহুদিন পরিচালনা করেন ৷ ইনি বহু দেশ পর্যটন করে ধর্মমত সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ লেখেন ৷ শেষে এঁর ধর্মমতের কোন স্থিরতা ছিল না ৷ আশ্রম চালাবার জন্য অর্থভিক্ষায় ইনি বাংলার নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান ৷ এঁর শেষ জীবনের কোন সংবাদই আমাদের জানা নেই ৷
যৌবনে শিলাইদহে বাসকালীন ঐ রকমের আরও বহু বৈষ্ণব, ফকির, বাউলদের সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ৷ কবির ‘বোষ্টমী’ গল্প (গল্পগুচ্ছ) সেই কথারই প্রমাণ ৷ ‘বোষ্টমী’ সত্যকাহিনী ৷
—শচীন্দ্রনাথ অধিকারী

(৩)

নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসী

ইঁহার পিতৃদত্ত নাম পূরণচন্দ্র ব্রজবাসী ৷ জন্ম ১৯২৫ সংবতে বৃন্দাবনধামে ৷ পিতা প্রসিদ্ধ কীর্তনগায়ক কৃষ্ণদাস ব্রজবাসী ৷ ৭ বৎসর বয়সে ইনি পিতার নিকট খোল-বাজনা শিক্ষা আরম্ভ করেন ৷ কৈশোরে একদিন প্রভু জগবন্ধু ইঁহার কাঁধে খোল তুলিা দিয়াছিলেন ৷ পরে পণ্ডিত বাবাজীর নিকট ইনি গরাণহাটী ও মনোহরসাহী কীর্তন অভ্যাস করেন ৷ প্রেমানন্দ গোস্বামী ইঁহার দীক্ষাগুরু ৷ ১৩২০ সালে ইনি কলকাতায় আগমন করিলে ইঁহার গীতবাদ্যে মুগ্ধ হইয়া যায় বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র ইঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া শিক্ষিত সমাজে কীর্তনের প্রবর্তন করেন ৷ ইনি ভবানীপুর আশুতোষ কলেজে প্রতিষ্ঠিত কীর্তন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে বৃত হইয়ছিলেন ৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জ্যেষ্ঠা কন্যা অর্পণা দেবী ব্রজবাসীর নিকট কীর্তন শিখিয়াছিলেন ৷

(৪)
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ মিত্র
(পিতা ৺দীননাথ মিত্র ৷ জন্ম : ১১ মাঘ, ১২৮৭
প্রয়াণ : দেবী পক্ষ ব্রাহ্মমুহূর্ত ২৩ আশ্বিন ১৩৬৮)

খগেন্দ্রনাথ কর্মময় জীবনের পরিচয় কয়েকটি পৃষ্ঠার মধ্যে নিবদ্ধ করা সম্ভব নয় ৷ কারণ তাঁর কর্মের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত ৷ বৃত্তি হিসাবে তিনি অধ্যাপনার কার্য গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রায় অর্ধশতাব্দী তিনি অধ্যাপনা করেছেন, কিন্তু নিছক অধ্যাপনার গণ্ডীর মধ্যে তিনি নিজেকে সঙ্কুচিত করে রাখেন নি, নিজের কর্মক্ষমতাকে তিনি প্রসারিত করেছিলেন বৃহত্তর জগতে। যেখানেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সেখানেই তিনি স্বীয় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷
যশোহর জেলার ধূলগ্রামে বিখ্যাত মিত্র বংশে ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে খগেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন ৷ নড়াইলের নর্মাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলিকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে প্রবেশ করেন এবং সেখান থেকে ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে এম এ পরীক্ষায় দর্শন-শাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেন ৷ তারপর সুরু হয় তাঁর অধ্যাপক জীবন ৷ ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে রাজসাহী ও তার পরে কৃষ্ণনগর কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনার পর তিনি ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে যোগদান করেন এবং সেখানে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন ৷
প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনার সময়ে তিনি বহু গুণী ব্যক্তি সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে৷ সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, সংগঠনে তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন ৷ নীলাম্বরী, কানের দুল, বিবি বউ, মুদ্রাদোষ, সারি প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করে তিনি অচিরেই সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন ৷ তাঁর লেখা গল্প ‘প্রেমের ঠাকুর’ সকল শিক্ষিত বাঙ্গালীর কাছে বিশেষ সমাদর লাভ করেছে ৷ অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের পর ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন৷ তার সংগঠন ক্ষমতায় ইনস্টিটিউট সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন ৷ তার সংগঠন-ক্ষমতায় ইনস্টিটিউট উন্নতির পথে অগ্রসর হয়৷ তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং ঐকান্তিক চেষ্টায় ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ভবন নির্মিত হয় ৷ এইজন্য তিনি বাংলার তদানীন্তন গর্ভনর লর্ড কারমাইকেলের সংস্পর্শে আসেন ৷ লর্ড কারমাইকেল তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বিশেষ প্রীত হন এবং তাঁকে তাঁর প্রচেষ্টায় সাহায্য করেন ৷ ইনস্টিটিউটের সকল সদস্যই খগেন্দ্রনাথকে শুধু যে শ্রদ্ধা করতেন তা নয়, তাঁকে ভালবাসতেন ৷ এই সময়ের বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে নাম করা যায় ডঃ শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নরেশচন্দ্র মিত্র, শ্রীরাঘবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির ৷
ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার সময় বাংলার গভর্নর লর্ড রোন্যাল্ডশের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং এই পরিচয়ের ফলে পরে লর্ড রোন্যাল্ডশে তাঁকে সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় বিধান পরিষদে এবং পরে কাউন্সিল অফ ষ্টেটে সদস্যরূপে মনোনীত করেন ৷
তাঁর সংগঠনক্ষমতার আর একটি নিদর্শন ‘রাণী ভবানী’ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ৷ ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর কলিকাতায় তিনি এই বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন ৷ তাঁর সুযোগ পরিচালনায় এটি একটি বিশিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ৷
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ব্যতীত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন ৷ এর কারণ ছিল একাধিক ৷ তিনি সুবক্তা ছিলেন, সুগায়ক ছিলেন, তাঁর রুচিবোধ ছিল তীক্ষ্ণ, তিনি সকলকে প্রেরণা দিতেন এবং সর্বোপরি ছিল তাঁর অমিত সৌজন্য ও অমায়িকতা ৷ তাঁর সংস্পর্শে যে কেউ একবার আসত, তাঁর কাছে তাকে আসতে হত আবার ৷ তাঁর ব্যবহার নম্র ও মধুর হলেও তিনি প্রয়োজন হলে বজ্রাদপি কঠোরও হতে পারতেন ৷ ব্যক্তিত্ববোধ ছিল তাঁর অসামান্য ৷ কোন কারণেই তিনি তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণ্ণ করেন নি ৷
সরকারী চাকুরীর শেষ চার বছর তিনি প্রেসিডেন্সী বিভাগের বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসাবে কাজ করেন এবং ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণ করেন ৷
সেই বছরই তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন ৷ ১৯৪৬ সালে তিনি এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ৷ এই পদে অধিষ্ঠিত থাকা কালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভূত উন্নতি করেন ৷ তাঁর অধীনে গবেষণা করে বহু ছাত্র ডক্টরেট উপাধি লাভ করেছেন ৷ ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর একটি ঘনিষ্ঠ ও মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল ৷ তাঁর মনীষার স্বীকৃতি হিসাবে অবসরগ্রহণের পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘এমেরিটাস অধ্যাপক’ করে তাঁকে সম্মানিত করেন ৷
খগেন্দ্রনাথের সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক শুধু তাঁর অধ্যাপনার কালেই সীমাবদ্ধ ছিল না ৷ তিনি বহুদিন যাবৎ সেনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবা করে গেছেন ৷ এখানকার সভায় তাঁর সুচিন্তিত অভিমত অধিকাংশ স্থলে গৃহীত হত ৷ ১৯৩৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে তিনি কেম্ব্রিজে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলন ও কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ভাষা-বিষয়ক সম্মেলনে যোগদান করেন ৷ ১৯৫০ সালের শেষে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে Comparative Religion-এর উপর স্টিফানোস নির্মলেন্দু বক্তৃতা দেন ৷ এই বক্তৃতামালা বিভিন্ন ধর্ম-সম্বন্ধে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের পরিচায়ক ৷ এগুলি Dynamics of Faith নামে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে ৷ ১৯৫১ সনে মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেনেট-কর্তৃক পর্ষতের সভ্য নির্বাচিত হন এবং পর্ষতের সভ্যগণ-কর্তৃক প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ৷
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর একটা ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল ৷ তিনি অসংখ্য সাহিত্যসভার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন ৷ প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি একাধিকবার সভাপতিত্ব করেছেন ৷ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে তিনি সম্পাদক ও সহ-সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠান ‘রবিবাসরে’র তিনি সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন আমরণ ৷ খগেন্দ্রনাথের একটি বিশিষ্ট পরিচয় তাঁর বৈষ্ণবসাহিত্যে জ্ঞান ও অনুরাগ এবং কীর্তনসঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি ৷ বস্তুত বাংলাদেশে শিক্ষিত এমন লোক খুব কম আছেন যাঁরা খগেন্দ্রনাথের এই পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ ৷ আজীবন তিনি এই দুটি জিনিসের চর্চা করেছেন ৷
নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসীর সহযোগিতায় খগেন্দ্রনাথ ‘পদামৃতমাধুরী’ নামে খ্যাত বৈষ্ণব-পদাবলীর যে সঙ্কলনগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন বৈষ্ণবসাহিত্যে তা মূল্যবান বলেই বিবেচিত হয়েছে ৷ ‘বৈষ্ণব-রসসাহিত্য’ নামক সমালোচনাগ্রন্থ এবং বিশ্বভারতী-কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ’ পুস্তক-মালার অন্তর্ভুক্ত খগেন্দ্রনাথের লিখিত ‘কীর্তন’ নামক পুস্তক আছে ৷

(৫)
বহু কীর্তনীয়ার নাম জানি ৷ কাটোয়ার নিকট মেরেলা কোঙার পুরের হারাধন সূত্রধর ৷ মান করের (বর্ধমান) নন্দ দাস ৷ বীরভূম তাঁতিপাড়ার নন্দ দাস ও নিতাই দাস ৷ দক্ষিণ খণ্ডের বনওয়ারী দাস ৷ লাহার পাড়ার বিষ্ণুদাস ৷ ইহাদের কোন পরিচয় পাই নাই ৷ বনওয়ারী দাসের ও বিষ্ণুদাসের গান শুনিয়াছি ৷ সুগায়ক ছিলেন ৷ হারাধন সূত্রধর সেকালের বহু বিখ্যাত কীর্তনীয়া ৷ গঙ্গা নাপিত, কালহৃদয়, জানাই হৃদয়, কালা গৌর দাস, নকুড় দাস, ইহাদের বাস গ্রামের নামও জানিনা । বীরভূম মুলুকের মহানন্দ দাস একজন বিখ্যাত কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ আখুরে হরিদাস ও তাহার পুত্র গোপাল দাস দুইজনেরই গান শুনিয়াছি ৷ পরিচয় বিশেষ জানিনা ৷

(৬)
কীর্তনীয়া প্রেমদাস ৷ পিতা নিতাই দাস ৷ বাড়ি ছিল সিজ গ্রামে ৷ নিতাই মালিহাটিতে বিবাহ করিয়া সেখানেই বাস করেন ৷ ১২৫০ সালের ফাল্গুন মাসে প্রেমদাসের জন্ম হয় ৷ ভেকাশ্রিত বৈষ্ণব ৷ ১৩২৪ সালের জ্যেষ্ঠ মাসে তিনি নিত্যাধামে প্রস্থান করেন ৷ সুধাশ্রাবী কণ্ঠ ছিল প্রেমদাসের ৷ সুবিখ্যাত কীর্তনীয়া ৷ বর্ধমান অষ্টম বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনে প্রথম তাঁহার গান শুনি ৷ পরে বহুবার তাঁহার কীর্তন গান শুনিয়াছি ৷

(৭)
কীর্তনীয়া শ্রীসুরেন্দ্রনাথ আচার্য ৷ পিতার নাম প্রিয়নাথ আচার্য, মুর্শিদাবাদ জিলায় বরোয়াঁ গ্রামে নিবাস ৷ সন ১২৭৮ সালে ১২ অগ্রহায়ণ পিত্রালয়েই ভূমিষ্ঠ হন ৷ পিতার নিকট এবং শ্রীবিশ্বম্ভর মোহান্ত নামক একজন কীর্তনাচার্যের নিকট গান শিক্ষা করেন ৷ শ্রীধাম নবদ্বীপে এবং বীরভূমের বহুগ্রামে তাঁহার কীর্তন শুনিয়াছি ৷ কণ্ঠস্বর ছিল উচ্চ, তীব্র অথচ সুরেলা ৷ সুগায়ক বলিয়া সুনাম ছিল ৷ সন ১৩৪৫ সালের ১৯শে চৈত্র তিনি নিত্যধামে গমন করেন ৷ এই বংশে গোপীরমন আচার্য একজন কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ ইঁহারা গ্রহাচার্য ব্রাহ্মণ ৷ সুরেন আচার্যের চিত্র প্রকাশিত হইল ৷

(৮)
কীর্তনীয়া রাধাশ্যামদাস ৷ বড় মূল গায়ক রসিক দাসের পুত্র ৷ জন্ম সন ১২৮৮ সালের ৩০শে আশ্বিন ৷ পিতার যোগ্য পুত্র ৷ সুগায়ক ছিলেন ৷ বহুবার তাঁহার কীর্তন শুনিয়াছি নানা স্থানে ৷ রাধাশ্যাম ছুতারের কাজ, কামারের কাজ, স্বর্ণকারের কাজ এবং রাজমিস্ত্রীর কাজ ভালই জানিতেন ৷ খোল, সেতার, এস্রাজ, বেহালা, তবলা আদি বাজনায় সুদক্ষ ছিলেন ৷ ভাল রকম ধ্রুপদ ও খেয়াল গান জানিতেন ৷ এই প্রতিভাধর পুরুষ কীর্তন গানে পিতার সুনাম রক্ষা করিয়াছিলেন ৷ প্রতিকৃতি দিলাম ৷ রাধাশ্যাম দাস সন ১৩৬২ সালের ২রা চৈত্র নিত্যধামে প্রস্থান করিয়াছেন ৷
রসিক দাসের বৈমাত্রেয় ভাই রতন রসিক দাসের দলের শির দোহার ও দলের কর্তা ছিলেন ৷ রতনের ছোটভাই গৌরদাস কলিকাতায় কীর্তন গানে বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করেন ৷ বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের লেখক দীনেশচন্দ্র সেনের নিকট গৌরদাসের বিশেষ প্রশংসা শুনিয়াছিলাম ৷
রসিক দাসের কনিষ্ঠা কন্যার নাম হেমলতা দাসী ৷ স্বামীর নাম নিত্যানন্দ কাব্যতীর্থ ৷ নিত্যানন্দের পুত্র রাধাশ্যামের ভাগিনেয় শ্রীমান্‌ যশোদানন্দন দাস দক্ষিণ খণ্ডেই বাস করিতেছেন ৷ যশোদানন্দন রসিক দাস ও রাধাশ্যামের ধারার একজন প্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া ৷

(৯)
কীর্তনীয়া শ্রীযামিনী মুখোপাধ্যায় ৷ পিতা নৃসিংহনন্দন মুখোপাধ্যায় ৷ নিবাস দক্ষিণ খণ্ড (মুর্শিদাবাদ)৷ ১২৯৪ সালের ১৮ই বৈশাখ জন্ম ৷ দক্ষিণ খণ্ডের বড় রসিক দাসের দোহার ছিলেন ছয় বৎসর ৷ পরে অবধূত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে যোগদান করিয়াছিলেন ৷ ১৩২৮ সালে স্বাধীনভাবে সম্প্রদায় গঠন করিয়া বনওয়ারীবাদ রাজবাড়িতে প্রথম গান করেন ৷ জনপ্রিয় কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ সন ১৩৭২, ১১ই আশ্বিন ইঁহার তিরোধান ঘটে ৷ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্রের নিকট দক্ষিণ খণ্ডে বারবার পত্র লিখিয়াও প্রতিকৃতি সংগ্রহ করিতে পারি নাই ৷

(১০)
স্বর্ণহাটির শচীনন্দন দাস নামকরা কীর্তনীয়া ছিলেন ৷ শ্রীখণ্ডের কীর্তনাচার্য শ্রীগৌরগুণানন্দ ঠাকুরের নিকট কীর্তন শিক্ষা করিয়াছিলেন ৷ শ্রীখণ্ডের বড় ডাঙ্গার উৎসবে তাঁহার বাঁধা আসর ছিল ৷ বহুবার তাঁহার গান শুনিয়াছি ৷ প্রতিকৃতি প্রকাশিত হইল ৷ শচীনন্দনের পুত্র কমলাকান্ত দাসও কীর্তন গানে সুযশ অর্জন করিয়াছিলেন ৷