শ্রীপাদ রূপ গোস্বামীর সঙ্গে বাঙ্গালার কীর্তনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ রহিয়াছে ৷ শ্রীপাদ রূপের উজ্জ্বল নীলমণির সূত্রানুসরণেই কীর্তনের রসপর্যায় স্থিরীকৃত হইয়াছে ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভুর সমকালীন এবং পরবর্তী পদরচয়িতৃগণ সকলেরই অবলম্বন উজ্জ্বল নীলমণি ৷ নায়ক-নায়িকার লক্ষণ, পূর্বরাগাদির বিবরণ, সখা-সখীগণের পরিচয় প্রভৃতি অসংখ্যাত বিষয়ের সুবিস্তৃত বর্ণনা আছে উজ্জ্বল নীলমণির মধ্যে ৷ পদরচয়িতৃগণ সকলেরই উপজীব্য এই গ্রন্থখানি শ্রীরূপের স্মরণীয় অবদান ৷ শ্রীরূপের সংগৃহীত পদ্যাবলী হইতেও বহু পদকর্তা স্ব-রচিত পদের বিষয় ও ভাবসম্পদ্ আহরণ করিয়াছেন ৷ শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ গৌড়ের স্বাধীন সুলতানের বিশ্বস্ত রাজবল্লভ ছিলেন ৷ অতুলনীয় ঐশ্বর্য সর্বজনবাঞ্ছিত পদমর্যাদা এবং বিলাস – ব্যসন ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহ পরিত্যাগপূর্বক দুই ভ্রাতাই শ্রীমন্ মহাপ্রভুর শরণ গ্রহণ করেন ৷ উভয় ভ্রাতাই বিদ্বান্ ছিলেন ৷ সনাতন যেমন ব্যবহার শাস্ত্রে সুনিপুণ ছিলেন, রূপ ছিলেন তেমনই রসশাস্ত্র-প্রবীণ, স্বাভাবিক কবিত্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ৷ আর ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব ছিলেন কবি এবং দার্শনিক ৷ আমি সংক্ষেপে শ্রীরূপের পরিচয় লিপিবদ্ধ করিলাম ৷
যে প্রস্থানত্রয়ের উপর ভারতীয় মানব-ধর্ম—শাশ্বত ও সনাতন হিন্দুধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই তিনটির নাম শ্রুতিপ্রস্থান (উপনিষৎ), ন্যায়-প্রস্থান (বেদান্ত) ও স্মৃতি-প্রস্থান (গীতা)৷ অভিনব চতুর্থ প্রস্থানের উদ্গাতা রসভাবের সমন্বয়মূর্তি প্রেমবিগ্রহ শ্রীমন্ মহাপ্রভু ৷ চতুর্থ প্রস্থান রস-প্রস্থান, এই প্রস্থানের ব্যাখ্যাতা শ্রীরূপ গোস্বামী ৷ প্রস্থান অর্থে গতি ৷
আচার্যগণের মতে— শ্রীমদ্রূপগোস্বামিনাং ৷৷ জন্ম শক ১৪৩১ ৷৷ গৃহী ২২ ৷৷ শ্রীবৃন্দাবনে ৫৩ ৷৷ বয়ঃ ৭৫ ৷৷ অপ্রকট তিথি শ্রাবণ শুক্লা দ্বাদশী ৷৷
এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ-সন্তান নবদ্বীপ নগর অলোড়িত করিয়া তুলিয়াছেন ৷ আপন অসামান্য ব্যক্তিত্বে অধিকাংশ হিন্দু সন্তানকে একতাবদ্ধ করিয়াছেন, রাজনীতিকে অন্তরালে রাখিয়া তাহারই সমান্তরালে সামাজিক আন্দোলনে শৌচ সদাচারের প্রবর্তনপূর্বক হিন্দুধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার পথে অবাধ গতিতে অগ্রসর হইতেছেন ৷ এই সংবাদ গৌড়-দরবারকে সচকিত করিয়াছিল ৷ বঙ্গেশ্বর সুলতান হুসেন শাহ সংবাদ রাখিতেছিলেন আপন স্বার্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, আর শ্রীসনাতন ও শ্রীরূপ সংবাদ রাখিতেছিলেন অন্য উদ্দেশ্যে ৷ হিন্দুর এই জাতীয় অভ্যুত্থান ভ্রাতৃদ্বয়কে আশ্বস্ত ও আশান্বিত করিয়া তুলিয়াছিল ৷ কাজীদলন, জগাই-মাধাই উদ্ধার, পরের পর সংবাদে তাঁহারা উৎফুল্ল হইয়া উঠিতেছিলেন ৷ মহাপ্রভুর সন্ন্যাসগ্রহণে দুই ভাই-ই চঞ্চল হইয়া পড়িলেন ৷ অতঃপর রামকেলিতে বহু-প্রত্যাশিত সন্দর্শন ৷ এবং চরমুখে মহাপ্রভুর শ্রীবৃন্দাবন-যাত্রার সংবাদ পাইয়া কনিষ্ঠ বল্লভকে সঙ্গে লইয়া প্রয়াগে গিয়া শ্রীরূপের মহাপ্রভুর শরণ গ্রহণ বাঙ্গালার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা ৷
আচার্য ভরত হইতে বিশ্বনাথ কবিরাজ পর্যন্ত কোন আলঙ্কারিকই ভক্তিকে রস বলিয়া গ্রহণ করেন নাই ৷ শ্রীমন্ মহাপ্রভুই প্রথম জগতে এই অভিনব বার্তা বহন করিয়া আনিলেন— প্রেম পঞ্চম পুরুষার্থ ৷ ভক্তিই প্রেমের বীজ ৷ এমন কি ”সা কস্মৈ পরমপ্রেমরূপা”৷ ভক্তিই শৃঙ্গার-রসরাজকে শ্রীমণ্ডিত করে ৷ ভজন প্রবৃত্তিই আদিরসকে উদ্রিক্ত করিবার হেতু ৷ এই ভক্তি তথা প্রীতিই মানবের সহজাত বৃত্তি ৷ এই বৃত্তি শ্রীভগবানে সমর্পিত হইলেই কুল পবিত্র এবং জননী কৃতার্থা হন ৷ ভক্তিই রস ৷ রসের আস্বাদনেই আনন্দ ৷ আনন্দই ব্রহ্ম ৷ শ্রীরূপ গোস্বামী শ্রীমহাপ্রভুর পদপ্রান্তে বসিয়া এই শিক্ষাই লাভ করিয়াছিলেন ৷ ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি এবং বিদগ্ধ-মাধব ও ললিত-মাধবে শ্রীরূপ এই তত্ত্বই আপন অতুলনীয় কবিত্ব ও রসবিশ্লেষণী প্রতিভায় প্রকাশিত করিয়াছেন ৷ ভারত-বিখ্যাত দার্শনিক এবং কবি শ্রীজীব ষট্সন্দর্ভে এই তত্ত্ব বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন — অতি দক্ষতার সঙ্গে, পরিষ্কৃত সুবিস্তীর্ণ পরিসরে ৷ শ্রীজীব শ্রীরূপেরই ভ্রাতুষ্পুত্র৷
প্রয়াগে গিয়া সানুজ শ্রীরূপ দেখিলেন শ্রীমাধবমূর্তি দর্শনে ভাবোন্মত্ত মহাপ্রভু প্রেমভরে নৃত্য করিতেছেন ৷ নাচিতেছেন আর দুটি হেমদণ্ড-বাহু ঊর্ধ্বে তুলিয়া মধুর কণ্ঠে উচ্চ হরিধ্বনি করিতেছেন ৷ সহস্র সহস্র কণ্ঠে তাহার প্রতিধ্বনি উঠিতেছে — সে এক অপূর্ব দৃশ্য ৷
কেহ কান্দে কেহ হাসে কেহ নাচে গায় ৷
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি কেহ গড়াগড়ি যায় ৷৷
গঙ্গা যমুনা প্রয়াগে নারিল ডুবাইতে ৷
প্রভু ডুবাইল কৃষ্ণপ্রেমের বন্যাতে ৷৷
মহাপ্রভু প্রকৃতিস্থ হইলে নৃত্য-কীর্তনের বিরাম ঘটিল ৷ এক দাক্ষিণাত্য ব্রাহ্মণ প্রভুকে ভিক্ষার আমন্ত্রণ জানাইলেন এবং নিজ গৃহে লইয়া গেলেন ৷ এই বিপ্রগৃহেই শ্রীরূপ ও শ্রীঅনুপম মহাপ্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করেন ৷ প্রয়াগে দশ দিন মহাপ্রভু শ্রীরূপকে বিবিধ বিষয়ে শিক্ষাদান করিয়াছিলেন। প্রয়াগ হইতে মহাপ্রভু পুরীর পথে বারাণসী যাত্রা করিলেন ৷ প্রয়াগ হইতেই শ্রীরূপের বৃন্দাবন-যাত্রা ৷
বৃন্দাবন হইতে অনুপমকে সঙ্গে লইয়া শ্রীরূপ গৌড়ে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন ৷ গৌড়েই অনুপমের গঙ্গা-প্রাপ্তি ঘটে ৷ বোধ হয় এই সময়ই এক বৎসর শ্রীরূপ গোস্বামীর গৌড়ে বিলম্ব হইল ৷
কুটুম্বেরে স্থিতি অর্থ বিভাগ করি দিল ৷
গৌড়ে যত অর্থ ছিল সব আনাইল ৷
কুটুম্ব ব্রাহ্মণ দেবালয়ে সব বাঁটি দিল ৷৷
সব মন কথা গোসাঞী করি নির্বাহন ৷
নিশ্চিন্ত হইয়া শীঘ্র আইলা বৃন্দাবন ৷৷
বৃন্দাবন হইতে পুরীধামে আসিয়া শ্রীরূপ এক সময় দশ মাসকাল মহাপ্রভুর সঙ্গসুখ ভোগ করিয়াছিলেন ৷ আসিবার সময় পথেই তিনি শ্রীকৃষ্ণ লীলার নাটক রচনার নান্দী শ্লোকাদি লিখিয়া রাখিতেছিলেন ৷ সত্যভামাপুর গ্রামে স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হন — ” আমার পৃথক নাটক রচনা কর”- স্বপ্নে আদেশ দিতেছেন দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণমহিষী দেবী সত্যভামা৷ পুরীতে আসিলে মহাপ্রভু বলিলেন, ”কৃষ্ণকে বাহির নাহি কর ব্রজ হইতে”৷ এইজন্যই তিনি দুইটি পৃথক্ নাটক রচনা করেন — বিদগ্ধমাধব ও ললিতমাধব ৷
পুরীতে আসিয়া দুই ভাই-ই ব্রহ্ম-হরিদাসের কুটিরে অবস্থান করিতেন ৷ হরিদাস, রূপ ও সনাতন কোনদিন শ্রীজগন্নাথ-মন্দিরে প্রবেশ করেন নাই ৷ তজ্জন্য তাঁহাদের কোন অনুযোগ, দুঃখ বা ক্ষোভ ছিল না ৷ শ্রীমন্দিরের ধ্বজা দর্শনপূবর্ক প্রণাম করিতেন ৷ নিত্য দর্শন লাভ হইত শ্রীমহাপ্রভুর, তিনি সমুদ্রস্নানের পথে প্রতিদিন হরিদাসের কুটীরে আসিয়া ইঁহাদিগকে দর্শন দিয়া যাইতেন ৷
শ্রীরূপ অবস্থিতি করিতেছেন হরিদাস-কুটীরে ৷ স্বরূপ দামোদর এবং রামানন্দ রায়ের সঙ্গে প্রভু নিত্য আসিয়া মিলিত হইতেছেন ৷ রূপের নাটক লইয়া আলোচনা চলিতেছে ৷ একদিকে দিগন্তবিস্তৃত নীলাম্বুধির উদ্বেলিত তরঙ্গভঙ্গে চঞ্চল বারিবিস্তার, অপরদিকে অযুত কণ্ঠে জয়ধ্বনি-মুখরিত দারু-ব্রহ্মের গগন-গৌরবস্পর্ধী ধীর স্থির শ্রীমন্দির ৷ মধ্যে ব্রহ্ম হরিদাসের পুষ্পোদ্যানে রসভাব-মিলিত মূর্তি জঙ্গম-ব্রহ্মকে কেন্দ্র করিয়া রসিক ও ভাবুকবৃন্দের আলোচিত কৃষ্ণলীলার উচ্ছলিত রসমাধুর্য ৷ উপলক্ষ রূপ ও রূপের দুইটি নাটক ৷
সনাতনের ত্যাগ-বৈরাগ্য ছিল অনন্যসাধারণ ৷ মাধুকরী -বৃত্তিতে জীবনধারণ, এক এক বৃক্ষের তলে এক একদিন শয়ন । কন্হা করঙ্গ মাত্র সম্বল, দৈন্যের অবতার ৷ শ্রীজীব শ্রীরূপের নিকটেই দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ শ্রীজীব আকুমার ব্রহ্মচারী ৷ পাণ্ডিত্য, কবিত্বে, রসজ্ঞতায় তিনি পিতৃব্যদ্বয়েরই সমকক্ষ ছিলেন ৷ শ্রীরূপ গ্রন্থ রচনা করিয়া সংশোধন করিতে দিতেন শ্রীজীবকে ৷ রূপ-সনাতনের প্রাণপ্রতিম ছিলেন শ্রীজীব ৷
একদিন এক দ্বিগ্বিজয়ী আসিয়া শ্রীরূপকে বলিলেন, আমি আপনার সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করিতে চাই ৷ বিচারে জয়পরাজয় নির্ণীত হইবে ৷ বিবাদ না করিয়া শ্রীরূপ পরাজয় স্বীকারপূর্বক তাঁহাকে জয়পত্র লিখিয়া দিলেন ৷ যমুনা হইতে স্নানান্তে ফিরিবার পথে দিগ্বিজয়ীর জয়োল্লাস এবং সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া জীব পথে দাঁড়াইয়াই তাঁহার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়া তাঁহাকে নিরুত্তর করিয়া জয়পত্রখানি কাড়িয়া লইলেন ৷ এই অপরাধে শ্রীরূপ শ্রীজীবকে ত্যাগ করিয়াছিলেন ৷ বলিয়াছিলেন — একখানি জয়পত্র পাইয়া তিনি কত আনন্দিত হইয়া গিয়াছিলেন! জয়পত্র কাড়িয়া তুমি তাঁহাকে সেই আনন্দে বঞ্চিত করিলে ৷ অপরের এই আনন্দ তোমার সহ্য হইল না ৷ অভিমান তুমি আজিও ত্যাগ করিতে পারিল না ৷ আমি আর তোমার মুখ দেখিব না ৷ অপরাধ বুঝিতে পারিয়া শ্রীজীব প্রায়োপবেশনে দেহত্যাগের সঙ্কল্প করেন ৷ অবশেষে শ্রীসনাতনের অনুরোধে শ্রীরূপ শ্রীজীবকে ক্ষমা করিয়াছিলেন ৷ ভ্রাতুষ্পুত্র ও পিতৃব্যের পুনর্মিলন ঘটিয়াছিল ৷ নিত্যসিদ্ধ ব্রজপরিকররূপে শ্রীরূপ আজিও ভারতের এক বৃহত্তর সম্প্রদায়ের বন্দনীয় পুরুষ ৷
(৩)
অপারং কস্যাপি প্রণয়িজনবৃন্দস্য কুতুকী
রসস্তোমং হৃত্বা মধুরমুপভোক্তুং কমপি যঃ ৷
রুচিং স্বমাবব্রে দ্যুতিমিহ তদীয়াং প্রকটয়ন্
স দেবশ্চৈতন্যাকৃতিরতিতরাং নঃ কৃপয়তু ৷৷
শ্রীরূপ গোস্বামী প্রভৃতি সুপণ্ডিত সজ্জনগণ শ্রীচৈতন্যদেবকে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল-বিগ্রহরূপেই পূজা করিয়া গিয়াছেন ৷ অনেক পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি বলিয়া থাকেন, শ্রীচৈতন্যদেব প্রকটকালের মধ্যে ভগবান্রূপে পূজা প্রাপ্ত হন নাই ৷ তাঁহারা শ্রীরূপ-প্রণীত তিনটি শ্রীচৈতন্যাষ্টক ও নাটকাদির অভীষ্ট নমস্কারাদির আলোচনা করিলেই আপন ভ্রম বুঝিতে পারিবেন ৷ শ্রীপাদ স্বরূপ দামোদর শ্রীমন্মহাপ্রভুর অবতার-গ্রহণের যে তত্ত্ব নির্দেশ করিয়াছিলেন, শ্রীরূপাদি সেই তত্ত্বেরই সাধনা করিতেন ৷ শীর্ষোদ্ধৃত স্তবে শ্রীরূপ বলিতেছেন—যে লীলাকৌতুকী ভগবান্ অনির্বাচ্য মধুর রস আস্বাদন জন্য নিজ প্রণয়িগণের রসরাশি অপহরণপূর্বক তাঁহাদের অঙ্গকান্তিতে আকার গোপন করিয়াছেন, সেই চৈতন্যাকৃতি গৌরতনু আমাদিগের প্রতি অতিশয় কৃপা বিতরণ করুন ৷
শ্রীরূপ বলিয়াছেন— ”গতির্যঃ পৌণ্ড্রাণাং প্রকটিতনবদ্বীপমহিমা”৷ টীকাকার বলদেব বিদ্যাভূষণ বলিতেছেন— ”নবদ্বীপস্য দক্ষিণতঃ কুলীনগ্রামোপান্তঃ পুন্ড্রো নাম দেশঃ৷ তদ্ভবানাং পৌন্ড্রাণাং যো দেবো গতিঃ সাধ্যসাধনভূতো নিস্তারক ইত্যর্থঃ”৷ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের এই অর্থ সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না৷ কুলীনগ্রাম বর্ধমান জেলার মেমারী ষ্টেশনের নিকট ৷ তাহার দক্ষিণে পুন্ড্র নামে কোন দেশের কথা শুনি নাই ৷ আমার মনে হয়, শ্রীরূপ গোস্বামী এখানে নিজেদের কথাই বলিয়াছেন ৷ পুন্ড্র বলিতে উত্তরবঙ্গের মালদহ অঞ্চলকেই বুঝাইতেছে ৷ শ্রীরূপ মালদহের আধিবাসী ছিলেন ৷ পূর্বে পৌন্ড্রগণ পতিত জাতিরূপে পরিচিত ছিল ৷ নিজদিগকে পৌন্ড্র বলিয়া পরিচয় দিয়া শ্রীরূপ স্বভাবসিদ্ধ দৈন্যেরই পরিচয় দিয়াছেন ৷ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শ্রীমন্মহাপ্রভুর নিকট শ্রীসনাতন নীচজাতি নীচসঙ্গী বলিয়া দৈন্য প্রকাশ করায় অনেকে কবিরাজ গোস্বামীর উপর কটাক্ষ করিয়াছেন ৷ তাঁহারা শ্রীরূপের এই নিজ মুখের উক্তি অনুধাবন করিবেন ৷ শ্রীচৈতন্যদেব রামকেলীতে পদার্পণপূর্বক গৌড়ীয় (মালদহবাসী)-গণকে উদ্ধার করিয়াছিলেন, ইহাই উক্ত শ্লোকের অর্থ ৷ পুন্ড্র বলিতে গৌড়মণ্ডলও অর্থ হইতে পারে ৷
শ্রীরূপ নীলাচলে জগন্নাথক্ষেত্রে আপন রসজ্ঞতার পরীক্ষা দিয়া সারা পৃথিবীর অতীত ও ভবিষ্যজন্মা মরমী সাধক ও কবিগণের সগোত্র মধ্যে গণ্য হইয়াছেন ৷ পুরীধামে রথযাত্রার দিনে রথাগ্রে নৃত্য করিতে করিতে—
এইভাবে নৃত্য মধ্যে পড়ে এক শ্লোক ৷
সেই শ্লোকের অর্থ কেহ নাহি বুঝে লোক ৷৷
স্তে যঃ কৌমারহরঃ সএবহি বরস্তাএব চৈত্রক্ষপা
চোন্মীলিতমালতীসুয়ভয়ঃ প্রৌঢ়াঃ কদম্বানিলাঃ ৷
সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপার লীলাবিধৌ
রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে ৷৷
সখি, যিনি আমার কৌমার হরণ করিয়াছিলেন, সেই আমার অভিমত বর ৷ সেই চৈত্র মাসের রাত্রি, সেই মালতীসুরভি প্রৌঢ় কদম্ববনবায়ু ৷ সেই আমি, তথাপি আমাদের মিলন ব্যাপারে বেরা নদীর তীরে সেই বেতসী লতাকুঞ্জের জন্য আমার চিত্ত উৎকণ্ঠিত হইতেছে৷
এই শ্লোকের অর্থ জানে একেলা স্বরূপ ৷
দৈবে সে বৎসর তাঁহা গিয়াছেন রূপ ৷৷
প্রভুমুখে শ্লোক শুনি শ্রীরূপ গোসাঞী ৷
সেই শ্লোকের অর্থ শ্লোক করিল তথাই ৷৷
শ্লোক করি এক তালপত্রেতে লিখিয়া ৷
আপন বাসার চালে রাখিল গুঁজিয়া ৷৷
শ্লোক রাখি গেলা সমুদ্রে স্নান করিতে ৷
হেনকালে আইলা প্রভু তাহারে মিলিতে ৷৷
* *
দৈবে আসি প্রভু যবে ঊর্ধ্বেতে চাহিলা ৷
চালে গোঁজা তাল পত্রে সেই শ্লোক পাইলা ৷৷
শ্লোক পড়ি প্রভু আছেন আবিষ্ট হইয়া ৷
রূপ গোসাঞী আসি পড়িলা দণ্ডবৎ হইয়া ৷৷
উঠি মহাপ্রভু তারে চাপড় মারিয়া ৷
কহিতে লাগিলা কিছু কোলেতে করিয়া ৷৷
মোর শ্লোকের অভিপ্রায় কেহ নাহি জানে ৷
মোর মনের কথা তুই জানিলি কেমনে ৷৷
এত বলি তারে বহু প্রসাদ করিয়া ৷
স্বরূপ গোসাঞীরে শ্লোক দেখাইল লইয়া ৷৷
শ্রীরূপ-প্রণীত শ্লোক –
প্রিয়ঃ সোয়ং কৃষ্ণঃ সহচরি কুরুক্ষেত্রমিলিত-
স্তথাহং সা রাধা তদিদমুভয়োঃ সঙ্গমসুখম্ ৷
তথাপ্যন্তঃ খেলন্ মধুর মুরলী পঞ্চমজুষে
মনো মে কালিন্দী -পুলিন-বিপিনায় স্পৃহয়তি ৷৷
শ্রীমদ্ভাগবতে এই কুরুক্ষেত্র -মিলনের বর্ণনা আছে ৷ সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে তীর্থস্নানের জন্য শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা হইতে কুরুক্ষেত্রে আগমন করিয়াছেন ৷ সঙ্গে পিতা বসুদেব আছেন, বলদেবসনাথ,সাত্যকিসহায় পরাক্রান্ত যদুবীরগণ আছেন, জননী দেবকী, রোহিণী ও মহিষী রুক্মিণী আদি পুরনারীগণ আছেন ৷ এতদ্ভিন্ন অগণিত করী তুরগ, পদাতিপরিবেষ্টিত সংখ্যাভূয়িষ্ঠ সুসজ্জিত স্যন্দন প্রভৃতি লইয়া তিনি রাজোচিত আড়ম্বরেই আসিয়াছেন ৷ আবার সাক্ষাৎ প্রার্থনায় সমাগত ভোজ, মৎস্য, কুরু, পাঞ্চাল প্রভৃতি নরনাথবৃন্দ— তাঁহাদের সঙ্গেও মর্যাদার অনুরূপ সৈন্যবাহিনী ৷ সুবিস্তীর্ণ সমন্তপঞ্চকে তিলধারণেরও স্থান নাই৷ সংবাদ শ্রীধাম বৃন্দাবনেও পৌঁছিয়াছে৷ হৃদয়েশ্বরকে দেখিবার জন্য গোপীযূথপরিবৃতা শ্রীমতী ভানুনন্দিনী, প্রাণ-কানাইকে দেখিবার জন্য শ্রীদামাদি ব্রজরাখালগণ এবং নয়নপুত্তলী ননীচোরকে দেখিবার জন্য গোপরাজ নন্দ ও জননী যশোমতী কুরুক্ষেত্রে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন ৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ কোথায়? ব্রজের এই নয়নানন্দ! “ইহ হাতী ঘোড়া রথ মনুষ্যগহন”— এখানে রাজবেশে সজ্জিত শ্রীকৃষ্ণকে দেখিয়া তো তৃপ্তি হইতেছে না ৷ শিরে শিখিপুচ্ছ, কর্ণে গুঞ্জাভূষণ, গলে বনফুলের মালা, পরিধানে পীতধটী, কবলবেত্রবেণুবিষাণ-পরিশোভিত নন্দনন্দন কই ? জননী যশোমতীর অশ্রুসিক্ত আঁখি খুঁজিতে লাগিল ব্রজভূমির নিরালা নিকেতনের কক্ষকুট্টিম ৷ রাখালগণের নয়নসমক্ষে ভাসিয়া উঠিল উন্মুক্ত আকাশতলে প্রকৃতির সেই আনন্দকানন— শ্যাম-শষ্প ক্ষেত্র—গোষ্ঠভূমি ৷ আর শ্রীমতীর মনে পড়িয়া গেল আনন্দের শত -স্মৃতি -বিজড়িত যমুনার কালো জল, আর তারই তীরে পুষ্পিত নিকুঞ্জবন, নীপতরুতল ! সে কৃষ্ণ, সেই দর্শন, সেই মিলন! কিন্তু দর্শনে সে তৃপ্তি কই, মিলনে সে আনন্দ কই? দেখা হইল, কিন্তু সে দেখায় এ দেখায় পার্থক্য কত? মাধুর্যের স্বতঃ উচ্ছ্বসিত অমৃত-প্রবাহ, প্রকৃতির আনন্দনির্ঝর গিরিবক্ষ বহিয়া বনপথ ধরিয়া সাবলীল স্বচ্ছন্দ ধারায় যে অবাধ মুক্ত গতিতে ছুটিয়া যায়, কৃত্রিম উদ্যানের মণিমণ্ডিত অববাহিকায় তাহার সে আবেগ, সে উচ্ছ্বাস, সে লীলায়িত ভঙ্গিমার স্থান কোথায়? তাই শ্রীরাধা বলিতেছেন— “সখি! সেই আমার প্রিয় কৃষ্ণ, আমিও সেই রাধা, কুরুক্ষেত্রে আমরা মিলিত হইয়াছি ৷ সেই আমাদের মিলনসুখ, তথাপি যাহার অভ্যন্তরে মুরলীর পঞ্চম স্বর তরঙ্গায়িত হইত আমার মন সেই কালিন্দী তীরবর্তী বৃন্দাবনকেই আকাঙ্ক্ষা করিতেছে ৷” শ্রীমন্মহাপ্রভু রাধাভাবে ভাবিত বিরহের স্ফুর্তিতেই ‘যঃ কৌমার হর’ শ্লোক পাঠ করিয়াছিলেন ৷ শ্লোকের আক্ষরিক অর্থ বিচার না করিয়া তাহার ব্যঞ্জনার, শ্রীমন্মহাপ্রভুর অন্তনির্হিত রসভাবের আস্বাদনেই শ্রীরূপ উক্ত শ্লোকের প্রকৃত অর্থ পরিস্ফুরণের জন্য ‘প্রিয়ঃ সোয়ং’ শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন ৷ শ্রীমন্মহা প্রভুর নিকট তিনি ভাব-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন ৷ শ্রীরূপ নিজ-সঙ্কলিত পদ্যাবলীতে কস্যচিৎ বলিয়া ‘যঃ কৌমার হরঃ’ শ্লোক এবং নিজের বলিয়া স্ব রচিত ‘প্রিয় সোয়াং ‘ শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন ৷
শ্রীরূপ-সংগৃহীত পদ্যাবলী এবং অন্যান্য গ্রন্থাবলী অনুসন্ধান করিলে পদাবলীর বহু পদের মূল শ্লোকের সন্ধান পাওয়া যায় ৷ বাহুল্যভয়ে সে সমস্ত আলোচনায় বিরত রহিলাম ৷ রাজধানী দিল্লীর অতি নিকটে শ্রীধাম বৃন্দাবনকে কেন্দ্র করিয়া শ্রীমন্মহাপ্রভু আপন প্রেমধর্ম প্রচারের জন্য যাঁহাদের উপর নির্ভর করিয়াছিলেন, শ্রীরূপ সেই ছয় জন গোস্বামীর অন্যতম ৷ প্রকৃতপক্ষে শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন ও শ্রীজীব গোস্বামী হইতেই কৃষ্ণকথা সারা ভারতে নূতনরূপে প্রচারিত হইয়াছিল ৷ শ্রীমন্মহাপ্রভু-প্রচারিত ধর্মান্দোলনে, প্রেমবিতরণে,সমাজ-সংস্কারে ও জাতিগঠনে মহাপ্রভুর পরিকর প্রধানগণের মধ্যে শ্রীরূপ অন্যতম ৷ জলৌকা যেমন অগ্রে একটি তৃণাগ্র অবলম্বনপূর্বক তবেই অন্য তৃণকে পরিত্যাগ করে, শ্রীরূপ-সনাতনও তেমনই অগ্রে মহাপ্রভুর কৃপারূপ শ্রেয়ঃ লাভ করিয়াই লোকদুর্লভ প্রেয়কে পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন ৷ এই লব্ধ শ্রেয়ঃ তাঁহারা আজীবন লোককল্যাণেই বিতরণ করিয়া গিয়াছেন ৷ ১৪৭৬ শকাব্দের শ্রাবণদ্বাদশী এই লোকোত্তরচরিত মহাপুরুষের তিরোভাবতিথি ৷ কবি কর্ণপূর শ্রীরূপ সম্বন্ধে অতি সত্য কথাই বলিয়াছেন —
প্রিয়স্বরূপে দয়িতস্বরূপে
প্রেমস্বরূপে সহজাতিরূপে ৷
নিজানুরূপে প্রভুরেকরূপে
ততানুরূপে স্ববিলাসরূপে ৷৷