লৌকিক সমাজনীতির আদর্শে পদাবলীর মধুররসের বিচার করতে গেলে রসাভাস হবে ৷ রাধা-চন্দ্রাবলী ও ব্রজগোপীগণ পরোঢ়া বা পরকীয়া ৷ তাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের প্রণয় সামাজিক আদর্শের বিচারে দূষনীয় ৷ মনে রাখতে হবে— এ শ্রীকৃষ্ণ কোন লৌকিক জগতের পুরুষ নন ৷ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্‌— রাধা-তাঁরই হ্লাদিনী শক্তি ৷ মানস বৃন্দাবনে ভগবান্‌ প্রেমলীলা আস্বাদনের জন্য দ্বিভুজ মুরলীধর হয়ে অবতীর্ণ ৷ শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধার মিলন নিত্য ৷ আর বিবাহ একটা সামাজিক সংস্কার মাত্র ৷ ঐ নিত্যমিলন কোন সামাজিক সংস্কারের অধীন নয় ৷ প্রাকৃত-জগতের অনুশাসন অপ্রাকৃত-বৃন্দাবনে প্রয়োগ করা চলে না ৷
রূপ গোস্বামী পরকীয়াবাদের সঙ্গে সামাজিক সংস্কারের একটা সন্ধি করতে চেয়েছেন ৷ তিনি তাঁর নাটকে রাধাকৃষ্ণের বিবাহ দিয়েছেন ৷ আবার তিনি শ্রীরাধার পরকীয়া অভিমান ও স্বকীয়াত্ব-বিস্মৃতিকে যোগমায়াকৃত প্রতিভাস বলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলেছেন— উপপতিত্ব সংস্কার প্রাকৃত নায়কের পক্ষেই খাটে ৷
ন কৃষ্ণে রসনির্যাসস্বাদার্থমবতারিণি ৷
আত্মানন্দ আস্বাদনের জন্য অবতীর্ণ শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে ইহা প্রযোজ্য নয় ৷ কবিরাজ গোস্বামী রূপ গোস্বামীর অনুবর্তিতায় যোগমায়ার দোহাই দিয়া বলেছেন—
মো বিষয়ে গোপীগণের উপপতি ভাবে ৷
যোগমায়া করিবেন আপন প্রভাবে ৷৷
প্রকট লীলায় যোগমায়াই শ্রীকৃষ্ণে গোপীগণের উপপতি ভাবের মায়ার সৃষ্টি করেছে ৷ ব্রজবধূদের পরবধূত্ব অপবাদমাত্র, বাস্তব নয় ৷ কবিরাজ গোস্বামী মহাশয় আবার অন্যত্র বলেছেন—
পরকীয়াভাবে অতি রসের উল্লাস ৷
ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস ৷৷
ব্রজবধূগণের এই ভাব নিরবধি ৷
তার মধ্যে শ্রীরাধার ভাবের অবধি ৷৷

পরকীয়াবোধ না হইলে অতি রসের উল্লাস বা মহাভাবের পরাকাষ্ঠা সম্ভব নয় ৷ কবিত্বের দিক হইতে অনায়াসে বলা যায়—
পরকীয়াভাবে অতি রসের উল্লাস ৷
কাব্য বিনা অন্যত্র ঘটায় রসাভাস ৷৷
রুদ্রট ইত্যাদি আলংকারিকরা একথা স্বীকার করেন ৷ জীব গোস্বামী বলেন— অপ্রকট ব্রজধামে এই মহাভাবের পরাকাষ্ঠা স্বকীয়াতে অস্বাভাবিক নয় ৷ ইনিও যোগমায়ার দোহাই দিয়েছেন ৷
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন,
একাত্মনীহ রসপূর্ণতমেঽত্যগাধে
একাসুসংগ্রথিতমেব তনুদ্বয়ং নৌ ৷
কস্মিংশ্চিদেক-সরসীব চকাশদেক
নালোত্থমব্জযুগলং খলু নীল-পীতম্‌ ৷৷
রাধাকৃষ্ণ এক মৃণাল থেকে সমুদ্‌গত একটি নীল একটি পীত পদ্মের মত নিত্যমিলিত ৷ রাধাকৃষ্ণের নিত্যমিলনের স্বরূপ বোঝানোর জন্য ইহা একটি উপমা ৷
প্রকৃতপক্ষে রাধাকৃষ্ণ একাত্মক, লীলার মধ্য দিয়ে অদ্বৈতের দ্বৈতভাব কল্পনা করা হয়েছে মাত্র ৷ দ্বৈতভাবে দুই শরীরে রূপ ধারণ না করলে লীলা হয় না ৷ দ্বৈতভাবকে সুপ্রকট করার উদ্দেশ্যে কল্পিত ব্যবধানকে দূরতর করার জন্যই দুইয়ের মধ্যে বৈবাহিক সংস্কারের অভাব পরিকল্পনা করা হয়েছে ৷
কবি বলেছেন— ”অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ ৷” অসীম অনন্ত ভগবান্‌ সীমার মধ্যে অর্থাৎ মানুষের জীবনকে আশ্রয় করে আত্মানন্দ উপভোগ করেন ৷ অসীমকে যেমন সীমার ভাষায় ব্যক্ত করা হয়— দিব্যানন্দকেও তেমনি মানবিক ও দৈহিক আনন্দের ভাষায় পদাবলীতে ব্যঞ্জনাগর্ভ রূপ দান করা হয়েছে ৷
পরকীয়াবাদ অনির্বচনীয়কে সঙ্কেত, ইঙ্গিত বা ব্যঞ্জনার দ্বারা অধিগম্য করে তোলার প্রয়াস ৷ ”সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা ৷” অসীমের মধ্যে হারা হওয়ার জন্য সসীমের যে স্বতঃসিদ্ধ পিপাসা ও ব্যাকুলতা (yearning) তাই ই পূর্বরাগ, অভিসার ও বিরহের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে ৷ (অসীমেরও সীমার জন্য ব্যাকুলতা কম নয়৷ (অভিসার দেখ); কেবল অসীম বলেই তার সীমাবিরহ ঐকান্তিক নয় ৷ তাই শ্রীকৃষ্ণের মাথুর বিরহের পদ নাই, কিন্তু ভাবসম্মিলনের আগ্রহের পদ আছে ৷ ) সাধকের এই পিপাসা ও ব্যাকুলতা একই গাঢ়, ও তীব্র যে নির্বাধ স্বকীয়া প্রেমের ভাষায় ব্যক্ত হয় না বলেই পরকীয়া প্রেমের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে ৷
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ”আমরা যাহাকে ভালবাসি কেবল তাহারই মধ্যে আমরা অনন্তের পরিচয় পাই ৷ এমন কি জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করার জন্য নাম ভালবাসা ৷ সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে এই তত্ত্বটি নিহিত আছে ৷ বৈষ্ণবধর্ম সমস্ত প্রেমসম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিবার চেষ্টা করিয়াছে ৷ যখন দেখিয়াছে মা তাহার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না— সমস্ত হৃদয় মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ঐ মানবাঙ্কুরটিকে বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না— তখন সে আপনার সন্তানের মধ্যে ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে ৷ যখন দেখিয়াছে— প্রভুর জন্য দাস আপনার প্রাণ দেয়, বন্ধুর জন্য বন্ধু আপনার স্বার্থ বিসর্জন করে, প্রিয়তম ও প্রিয়তমা পরস্পরের নিকট আপনার সমস্ত আত্মাকে সমর্পণ করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে— তখন এই সমস্ত পরম প্রেমের মধ্যে একটা সীমাতীত লোকাতীত ঐশ্বর্য অনুভব করে ৷”
এখানে রবীন্দ্রনাথ দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের মধ্য দিয়া অনন্তের উপলব্ধির কথা বলেছেন ৷ পতিপত্নী কথাটা ব্যবহার না করে কবিগুরু প্রিয়তম-প্রিয়তমা কথা ব্যবহার করেছেন কেন তা লক্ষ্য করতে হবে ৷ যে ভালবাসায় আনন্দের অবধি পাওয়া যায় না, যে ভালবাসার গভীরতায় থই পাওয়া যায় না, যে ভালবাসায় আত্মদানের অন্ত নাই, সেই ভালবাসাতেই অশেষ, অগাধ, অনন্ত বা অসীমের উপলব্ধি মেলে ৷ তাই যদি হয় তবে ভালবাসার বিবিধ প্রবাহের মধ্যে নিবিড়তম, গভীরতম প্রবাহ কোন্‌টি যাতে সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃতি ঘটে, যাতে থই না পেয়ে নরনারী একেবারে অনন্তের মধ্যে তলিয়ে যায় ? বৈষ্ণব কবিরা বলেন, দুর্লভ প্রিয়তমের জন্য দুর্লভা প্রিয়তমার প্রেম,— সংস্কারমুক্ত মনে বিচার করে দেখলে পরপুরুষের প্রতি কুলবতীর প্রেম ৷ এই প্রেমই Symbolised হয়েছে দেশকালাতীত অপ্রাকৃত বৃন্দাবনের পরকীয়া-প্রেমে ৷ বলা বাহুল্য, অনন্তের উপলব্ধির জন্য যেমন কোন মাতাকে আহ্বান করা হচ্ছেনা তার সন্তানকে ভালবাসতে, তেমনি কোন কুলনারীকে আহ্বান করা হচ্ছে না বা উৎসাহিত করা হচ্ছে না পরপুরুষের প্রতি অনুরাগের জন্য ৷ রাধাকৃষ্ণের প্রণয়ের মধ্য দিয়ে অনন্তকেই উপলব্ধি করার জন্যই বৈষ্ণব কবিরা আহ্বান করেছেন সকল পুরুষ ও নারীকে ৷ বৈষ্ণবাচার্যেরা বলেন—
যাকে শুকমুনি
ভাগবতে পরকীয়া বলিলা আপনি ৷
ইহা ভাবি মঙ্গল ইচ্ছিবা যেইজন ৷
ভক্তাচার করুন ন তু কৃষ্ণের আচরণ ৷৷
বাধাবিঘ্নসংস্কারের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি থেকে বিমুক্ত হওয়ায় লৌকিক ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের অনুবর্তিনী অদুর্লভা স্বকীয়া রতি, ভাগবত প্রেমের Symbol হতে পারে না ৷ একমাত্র ব্রজের এই পরকীয়া প্রীতিকে ভক্তিধর্মের অঙ্গীভূত করে ভক্তাচার করতে হবে, জীবনে অনুকরণ করলে চলিবে না ৷ যারা লীলাতত্ত্ব বোঝে না— তারাই ভাববিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের তথাকথিত কাল্পনিক আচরণের অনুকরণ করে ৷ বৈষ্ণব সাধকগণ বলিতে চান— পরপুরুষে অনুরক্তা কুলবধূর আত্মহারা আকুলতাটুকু অধিগত করে শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ কর,—তার জীবনের আচরণের অনুসরণ কোরো না ৷