ব্রজের প্রেমলীলার গূঢ়তা ও গাঢ়তা-প্রকাশের ভাষা মানবকণ্ঠে নাই ৷ তাই প্রাকৃত প্রেমের ভাষাতেই তার প্রকাশের চেষ্টা হয়েছে ৷ তাতে যে অনির্বচনীয় নবনবায়মান মহাপ্রেমের যথাযথ প্রকাশ হইতেছে না— তা কবিরা অনুভব করেছেন ৷ রচনার মধ্যেই অনুভব করা যায় তাঁদের প্রাণের আকুলি-বিকুলি ৷ সোজা ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে কেউ কেউ ঠারে ঠোরে বক্রোক্তি-ব্যঞ্জনার সাহায্যে প্রকাশ করতে চেয়েছেন ৷ কেউ কেউ উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ব্যতিরেক ইত্যাদি অলঙ্কারের মালা গেঁথেছেন, মনে করেছেন— একটি তরঙ্গ যেমন রাজহংসকে অন্য তরঙ্গের দিকে এগিয়ে দেয়, একটি অলঙ্কৃতি তেমনি ভাবটিকে অন্য অলঙ্কৃতির দিকে এগিয়ে দেয়, একটি অলঙ্কৃতি তেমনি ভাবটিকে অন্য অলঙ্কৃতির দিকে এগিয়ে দেবে— এইভাবে শেষ পর্যন্ত সবগুলো মিলে ভাবটিকে উপলব্ধির অধিগম্য ও আস্বাদ্য করে তুলবে ৷ আর একটি চেষ্টা অন্তর্নিহিত সুরের আবেদনের দ্বারা ৷ প্রকাশের ভাষায় এই মিস্‌টিক সুরটি পাওয়া যায় চণ্ডীদাসের অনেকগুলি পদে ৷ চণ্ডীদাসের ভাষায় সুরই আমাদেরকে লৌকিক জগৎ থেকে লোকাতীত স্তরে নিয়ে যেতে পারে ৷ সেইজন্যই বোধ হয়, চণ্ডীদাসের পদের সব চেয়ে বেশি আদর হয়েছে ৷
পরবর্তী কবিরা দেখলেন— সর্বজনের উচ্ছিষ্ট ভাষায় মহাপ্রেমের প্রকাশ সম্ভব নয়— তাই বোধ হয় ব্রজবুলির আশ্রয় নিলেন, তাতে অধিকতর ব্যঞ্জনায় এবং ভাষাগত দূরত্বের দ্বারা রোমন্সের সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন৷ কিন্তু এ ভাষা তো মর্মের গভীরতার ভাষা নয়৷ সেজন্য ব্রজবুলির পদগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোমাণ্টিক ঐশ্বর্য বহন করেছে, কিন্তু চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠ পদগুলির মত মিস্‌টিক মাধুর্যে গহন হতে পারনি৷ সংস্কৃতে রচিত পদগুলি রসঘন ও গাঢ়বন্ধ— কিন্তু তাতে ভাষাগত ব্যবধান এতই অধিক যে ঐগুলো বাঙ্গালী পাঠকের কাছে রোমাণ্টিক ও মিস্‌টিক দুই বৈভবই হারিয়েছে ৷ ঐগুলো কেবল বিদ্বজ্জনের মনীষার উপভোগ্য হয়ে থেকে গেছে , বৈষ্ণব চতুষ্পাঠীতে আস্বাদ্য হয়েছে,— বৈষ্ণবসমাজে আরাধ্য হয়নি ৷
চণ্ডীদাসের পর জ্ঞানদাস, বলরামদাস ও নরোত্তমদাস মহাপ্রেমলীলার পক্ষে কতটা উপযোগী ভাষা ব্যবহার করতে পেরেছেন। ভক্ত-কবিরা যথাযথ ভাষণের দ্বারা যা পারেননি, প্রকাশের ব্যাকুলতার দ্বারা তা পেরেছেন ব্যঞ্জনায় ও ইঙ্গনায়৷ মোট কথা, পাঠকের মনোভূমি পূর্ব থেকে লীলারসে পরিষিক্ত না থাকলে কবিদের অসম্যক্‌ প্রকাশ পাঠকচিত্তে ভাববীজ বপন করতে পারে না৷ বিশেষতঃ রাধাপ্রেম বোঝাতে কবিদের চিরপ্রচলিত কামনাময় প্রেমের ভাষাই প্রয়োগ করতে হয়েছে৷ পূর্ব থেকে পাঠকের মতি ভক্তি-গঙ্গানীরে শুচি, লীলাতত্ত্বের চন্দনে অনুলিপ্ত ও নিষ্ঠার শুচিবাসে পিহিত হয়ে না থাকলে ঐ ভাষা তার অঞ্জলিতে চন্দনাক্ত গীতিপুষ্পদাম রূপে সার্থকতা লাভ করতে পারে না৷ এজন্যও পদাবলী-সাহিত্যকে অর্ধদৃষ্টি বলতে হয়৷
বক্রোক্তির সাহায্যে বিদ্যাপতি তাঁর পদগুলিকে রোমাণ্টিক করে তুলেছেন, কিন্তু বহুপদকে মিস্‌টিক করে তুলতে পারেননি৷ বোধ হয়, সে উদ্দেশ্যও তাঁর ছিল না৷ তাঁর শিষ্য গোবিন্দদাস বক্রোক্তি, অলঙ্কৃতি ও ভাষার পারিপাট্যের সহায়তায় মহাপ্রেমলীলাবর্ণনায় বরং অনেকটা সাফল্য লাভ করেছেন৷ সংস্কৃত শ্লোকের গাঢ়বন্ধতাকে তরলায়িত করেও তিনি যে কলধ্বনির সৃষ্টি করেছেন, তার আবেদন মূল শ্লোকের আবেদনের চেয়ে ঢের বেশী৷
উজ্জ্বলনীলমণিতে আছে—
পঞ্চত্বং তনুরেতু ভূতনিবহাঃ স্বাংশে বিশন্তু স্ফূটং
ধাতারং প্রণিপত্য হন্ত শিরসা তত্রাপি যাচে বরম্‌ ৷
তদ্বাপীষূ পয়স্তদীয় মুকুরে জ্যোতিস্তদীয়াঙ্গন—
ব্যোম্নি ব্যোম তদীয় বর্ত্মনি ধরা তত্তালবৃন্তে’নিলঃ ৷
ইহার ভাবার্থ— এ দেহ পঞ্চত্ব পা’ক, আমার দেহে পঞ্চভূতের যে অংশগুলি আছে সেগুলি পঞ্চভূতে মিশে যাক ৷ তবুও বিধাতার কাছে এই বর চাই, তার বাপীতে আমার দেহের জলীয়াংশ, তার মুকুরে আমার দেহের জ্যোতিরংশ, তার অঙ্গনাকাশে আমার দেহের নাভসাংশ, তার গমন-পথে আমার দেহের মৃদংশ ও তার তালবৃন্তে আমার দেহের বায়বাংশ যেন মিশে যায় ৷
এতে গভীর প্রেম প্রকাশিত হল কি ? গোবিন্দদাস একে যে বাণীরূপ দিয়েছেন, তাতে কতটা সাফল্য লাভ করেছে দেখা যাক ৷
যাহাঁ পহুঁ অরুণ চরণে চলি যাত ৷
তাহাঁ তাহাঁ ধরণী হইয়ে মঝু গাত ৷৷
যে সরোবরে পহুঁ নিতি নিতি নাহ ৷
মঝু অঙ্গ সলিল হোউ তথি মাহ ৷৷
এ সখি বিরহমরণ নিরদ্বন্দ্ব ৷
ঐছনে মিলই যব গোকুলচন্দ ৷৷
যো দরপণে পহুঁ নিজ মুখ চাহ ৷
মঝু অঙ্গ জ্যোতি হোউ তথি মাহ ৷৷
যো বীজনে পহুঁ বীজই গাত ৷
মঝু অঙ্গ তথি হোউ মৃদু বাত ৷৷
যাহাঁ পহুঁ ভরমই জলধর শ্যাম ৷
মঝু অঙ্গ গগন হোউ তছু ঠাম ৷৷
গোবিন্দদাস কহ কাঞ্চন গোরি ৷
সো মরকত তনু তোহে কিয়ে ছোড়ি ৷৷
রূপের সংস্কৃত শ্লোকে যা আলঙ্কারিক তথ্যমাত্র, তা গোবিন্দদাসের পদে রসে পরিণত হয়েছে ৷ গোবিন্দদাস বিরহ-মরণের নির্দ্বন্দ্বতা দেখিয়ে একটা কলিকাকে মধুগন্ধে চতুর্দশ দলে বিকসিত করে তুলেছেন ৷