জয়দেবই পদকর্তাদের গুরু । জয়দেবের পদাবলীর ছন্দ, বিষয়বস্তু , গঠনভঙ্গী, পদবিন্যাস, আলঙ্কারিকতা, ভাবভঙ্গী সবেরই অনুসরণ করেছেন পরবর্তী পদকর্তারা। কেবল তাঁর পদে যে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাবের কথা মাঝে মাঝ আছে বড়ু চণ্ডীদাস ছাড়া অন্য কোন পদকর্তা সে ভাবের অনুসরণ করেননি ৷ পদকর্তারা কেবল জয়দেবের পদবিন্যাস অনেক পদে গ্রহণ করেননি— কোন কোন শ্লোককে অভিনব পদের আকারও দান করেছেন, জয়দেব রচিত পদের কোন কোন অংশ নিজেদের পদের মধ্যে আত্মসাৎ করেছেন,ভঙ্গীগত বৈশিষ্ট্যকে পদের অঙ্গীভূত করেছেন এবং জয়দেবের আলঙ্কারিক চাতুর্যের সবটুকুই পদকর্তাদের বিভিন্ন পদে বিকীর্ণ হয়ে আছে ৷ জয়দেবের পদগুলি বাংলা ও ব্রজবুলির পদের তুলনায় দ্রাঘীয়ান্‌ ৷ গীতগোবিন্দে রাধাকৃষ্ণের পূর্বরাগ, দানলীলা, গোষ্ঠলীলা, মাথুর, ভাবসম্মেলন ইত্যাদি নাই ৷ এইগুলোর কোন কোনটার সূত্রপাত হয়েছে বিদ্যাপতি থেকে, কোন কোনটির বড়ু চণ্ডীদাস থেকে ৷ গীতগোবিন্দে রাধা প্রধানতঃ খণ্ডিতা ও মানিনীরূপে চিত্রিতা হয়েছেন ৷ ভণিতায় জয়দেব বলেছেন, হরিস্মরণে যাদের মন সরস, বিলাসকলায় যারা কুতূহলী, তাদের হর্ষবৃদ্ধি ও ভক্তিসঞ্চারের জন্যই তাঁর কাব্য ৷ পদকর্তারা নিজেদের শ্রীমতীর সখীস্থানীয় কল্পনা করে মধুর রসের বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেছেন এবং শ্রীরাধার উদ্দেশে আশ্বাস, সমবেদনা ও উপদেশাদি সংযোগ করেছেন ৷ এ প্রথা শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে প্রাধান্য লাভ করেনি ৷
জয়দেবের আগে প্রাকৃত ভাষায় পদরচনার পদ্ধতি ছিল ৷ পিঙ্গলের প্রাকৃত ছন্দের গ্রন্থে শ্লোকাকারে ২৷৪ টি পদের নিদর্শন পাওয়া যায় ৷ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার পদও পাওয়া যায় ৷ জয়দেব যে ছন্দে পদ রচনা করেছেন— সে ছন্দ মরহট্টা, বৃত্তনরেন্দ্র, চৌপইআ, চর্চরী, দোহা ইত্যাদি প্রাকৃত ভাষারই ছন্দ ৷ এইগুলোই পদকর্তারাও গ্রহণ করেছেন ৷ প্রাকৃত ভাষা আর কথিত ভাষা হিসাবে চলিল না,— দেশের বিদ্বৎসমাজও প্রাকৃত ভাষার রচনার বিশেষ আদর করল না ৷— তার ফলে প্রাকৃত ভাষার পদগুলি ক্রমে বিলুপ্ত হল ৷ জয়দেবের সময়ে প্রাকৃত ভাষায় কবিতা রচনার পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও জয়দেব প্রাকৃত ভাষায় না লিখে অত্যন্ত সহজ সরল সংস্কৃতে (অনেকটা সংস্কারিত প্রাকৃতে ) লিখে অসামান্য সাফল্য লাভ করলেন ৷
জয়দেবের পদাবলীর সংস্কৃত ভাষায় ক্রিয়াপদের বাহুল্য নাই এবং সংস্কৃতের ললিতমধুর শব্দাবলীর দ্বারা পদগুলো রচিত ৷ এই শব্দাবলী তৎসম শব্দরূপে বাংলা কবিতায় চিরপ্রচলিত ৷ ক্রিয়াপদগুলোর ধাতুও বাংলায় অপরিচিত নয় ৷ ললিতমধুর শব্দগুলো সমাসবদ্ধ,— ঘন ঘন বিভক্তি প্রয়োগে সন্ধিবদ্ধ নয়, সেজন্য জয়দেবের পদাবলীর ভাষা বাংলা ভাষার সমীপবর্তী ৷
জয়দেবের গীতগোবিন্দ সহজবোধ্য সংস্কৃতে রচিত হওয়ায় আর্যাবর্তের সর্বত্রই— এমন কি দক্ষিণাপথের বহু স্থলে তার প্রচার ও সমাদর হয়েছিল ৷ কিন্তু বাংলার মত অন্য প্রদেশের গীতিকাব্যে এটি এতটা প্রভাব বিস্তার করিতে পারেনি ৷ গীতগোবিন্দের অনুসরণে হিন্দী ভাষাতেও গীতিকবিতা কিছু কিছু রচিত হয়েছিল, কিন্তু বাংলার সমতলে এটি গীতিরসের বন্যা এনে দিয়েছিল ৷ এর কয়েকটি কারণ আছে ৷ প্রথমতঃ বাঙালী প্রেমিক জাতি, প্রেমের কবিতার বড়ই অনুরাগী ৷ বাঙালীরা গীতগোবিন্দে প্রেমগীতির একটা চূড়ান্ত আদর্শ পেয়ে গেল ৷ দ্বিতীয়ঃ, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে ও তাঁর প্রেমধর্ম-প্রচারের ফলে গীতগোবিন্দ বৈষ্ণবজগতে ভাবগত বা গীতার মর্যাদা লাভ করল ৷ চৈতন্যদেব গীতগোবিন্দে লোকাতীত ব্যঞ্জনা সঞ্চার করলেন ৷ তখন চৈতন্যোত্তর গীতিসাহিত্যে গীতগোবিন্দ পদরচনায় অভিনব প্রেরণা দান করল ৷ তৃতীয়তঃ, বাঙ্গালীর নিজস্ব কীর্তনসঙ্গীতের অভাবনীয় সমুন্নতির ফলে গীতগোবিন্দের পদ কীর্তনের অঙ্গীভূত হয়ে অসাধারণ সমাদর লাভ করল— তদনুসরণে রচিত পদেরও তেমনি মর্যাদা বেড়ে গেল ৷ চৈতন্যোত্তর কীর্তনসঙ্গীতে গীতগোবিন্দ কেবল অভিনব সার্থকতা (interpretation) নয়,— অভিনব সুরতালও লাভ করল ৷