স্নিগ্ধ মনোভাব থেকে মহাপ্রেমের ক্রমোদ্বর্তন দেখানোর জন্য বৈষ্ণবাচার্যগণ একটি রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন— ইক্ষু থেকে মিছরিদানার ক্রমপরিণতি ৷
বীজমিক্ষুঃ স চ রসঃ স গুড়ঃ খণ্ড এব সঃ ৷
সা শর্করা সিতা সা চ সা যথা স্যাৎ সিতোপলা ৷৷
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শ্রীমুখের বাণী—
সাধনভক্তি হইতে হয় রতির উদয় ৷
রতি গাঢ় হৈলে তারে প্রেমনাম কয়৷৷
প্রেমবৃদ্ধি ক্রমে স্নেহ মান ও প্রণয় ৷
রাগ অনুরাগ ভাব মহাভাব হয় ৷৷
রাধার প্রেম ও শ্রীচৈতন্যের প্রেম— এই মহাভাব৷ শ্রীচৈতন্যের এই মহাভাবাবেশ যাঁরা স্বচক্ষে দেখেছিলেন, তাঁরা স্বীকার করে গিয়েছেন— এই মহাভাব অনির্বচনীয়— ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ৷ পদকর্তারা এই মহাভাবের স্বরূপ বোঝাতে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন— এটা অনির্বচনীয়৷ কবিরা কেউ উপমার দ্বারা, কেউ অতৃপ্তির ভাষায়, কেউ প্রকাশ-ব্যাকুলতার দ্বারা আভাস দিতে চেষ্টা করে এর অনির্বচনীয়তাই স্বীকার করেছেন ৷
জয় জয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমে অদভুত ৷
নিতুই নূতন প্রেম অনুরাগযুত ৷৷
রূপের ভাষায়—
জং সব্বদএ উপভুজ্যমানব্বি অভুত্তরুব্ব জেব্ব ভোদি ৷
(নিয়ত উপভুজ্যমান হইলেও অভুক্তপূর্ব বলিয়া মনে হয় )
সদানুভূতমপি যঃ কুর্যান্নবনবং প্রিয়ম্ ৷
ন কেঅলং লোওত্তরস্‌স বত্থুনো গাঢ়ানুরাঅস্‌স বি জেণ নিঅগো-অরো জণো ক্‌খণে ক্‌খণে অউরুব্বো অউরুব্বো করীঅদি ৷
কেবল লোকোত্তর বস্তু নয়, গাঢ় অনুরাগের ধর্মই এই— প্রিয়জনকে সম্মুখে দেখলেই ক্ষণে ক্ষণে অপূর্ব অপূর্ব বলে মনে হয় ৷ (ললিতমাধব)
এই অনুরাগ বোঝানোর ভাষা নাই ৷ বিদ্যাপতির নীর ও ক্ষীরের উপমার চাতুর্যই প্রকাশিত হয়েছে— প্রেমের স্বরূপ প্রকাশিত হয়নি ৷ বিদ্যাপতি আর একস্থলে লিখেছেন—
দুহুঁ রসময় তনু গুণে নাহি ওর ৷
লাগল দুহুঁক না ভাঙ্গল জোড় ৷৷
কো নাহি কয়ল কতহুঁ পরকার ৷
দুহুঁ জন ভেদ করই নাহি পার ৷৷
রাধাকৃষ্ণ নিত্যকাল অবিচ্ছেদ্য প্রেমে আবদ্ধ— কোন পার্থিব বাধা এই অপার্থিব মিলনের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না৷ এর বেশি ব্যঞ্জনা এতে নাই৷
গোবিন্দদাস বলেছেন—
দরশনে নহত নয়ন ভরি তিরপিত
পরশনে না রহে গেয়ান৷
মানসলোকে রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ নাই ৷ বিচ্ছেদে একে অন্যের অন্তরে বিরাজ করে — ‘স্বপনে না হেরত আন ৷’
গোবিন্দদাস শেষ পর্যন্ত বললেন —
অমলিন মিলন দুহুঁ ভেল সমতুল
গোবিন্দদাস ভালে জান ৷
রাধাকৃষ্ণের প্রেমে মিলন-অমিলন দুইই সমান ৷ প্রাকৃত প্রেমের সঙ্গে মহাপ্রেমের এখানেই প্রভেদ৷ কবিবল্লভ বলেছেন—
সখি, কি পুছসি অনুভব মোয় ৷
সোই পীরিতি অনুরাগ বাখানিতে
তিলে তিলে নৌতুন হোয় ৷৷
তিলে তিলে যা নবনবায়িত তার ব্যাখ্যান কি করে সম্ভব ? যে প্রেম কখনও বৈচিত্র্যহীন বা পুরাতন হয় না, তাতে একটা তৃপ্তির ছেদ থাকতে পারে না ৷ তাই ‘লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া’ রাখলেও হিয়া জুড়ায় না— জনম অবধি রূপ দেখেও নয়ন পরিতৃপ্ত হয় না৷ কবিবল্লভ এখানে লাখ লাখ যুগের কথা বলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম অনাদি, অনন্ত, চিরন্তন এটাই ব্যঞ্জিত করেছেন ৷ জ্ঞানদাস লিখেছেন—
আঁখে রৈয়া আঁখে নয় সদা রয় চিতে ৷
সে রস বিরস নয় জাগিতে ঘুমিতে ৷৷
এক কথা লাখ হেন মনে বাসি ধাঁধি ৷
তিলে কতবার দেখোঁ স্বপনসমাধি ৷৷
এতে উল্লিখিত কবিদের কথারই প্রতিধ্বনি হয়েছে ৷
চণ্ডীদাস বলেছেন—
মানুষে এমন প্রেম কোথা না শুনিয়ে ৷
নরনারীর হৃদয়াবেগের ভাষায় ও ভঙ্গীতে এর প্রকাশ দেওয়ার চেষ্টা হলেও এটি অমানুষিক ও অপার্থিব ৷ ব্যতিরেক অলঙ্কারের সাহায্যে চণ্ডীদাস এই প্রেমকে ত্রিভুবনাতীত বলে প্রমাণ করেছেন —
এমন পীরিতি কভু দেখি নাই শুনি ৷
পরাণে পরাণ বাঁধা আপনা আপনি ৷৷
দুহুঁ ক্রোড়ে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া ৷
আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া ৷৷
ভানু কমল বলি সেহো হেন নয় ৷
হিমে কমল মরে ভানু সুখে রয় ৷৷
চাতক জলদ কহি সে নহে তুলনা ৷
সময় নহিলে সে না দেয় এককণা ৷৷
কুসুমে মধুপ কহি সেহো নয় তুল ৷
না আইলে ভ্রমর আপনি না যায় ফুল ৷৷
কি ছার চকোর চাঁদ দুহুঁ সম নহে ৷
ত্রিভুবনে হেন নাহি চণ্ডীদাস কহে ৷৷
যে জন সাঁতার জানে না সে যেমন পাথারে পড়িয়া আকুলি বিকুলি করে, বলরাম দাস এই প্রেমের গভীরতা বোঝাতে তেমনি আকুলি বিকুলির ভাষা ব্যবহার করেছেন শ্রীকৃষ্ণের মুখে ৷
বসিয়া দিবস রাতি অনিমিখ আঁখি ৷
কোটি কল্পকাল যদি নিরবধি দেখি ৷৷
তবু তিরপিত নহে এ দুই নয়ান৷
জাগিয়া তোমারে দেখি স্বপন সমান ৷৷
দরপণ নীরস সুদূরে পরিহরি ৷
কিছার কমলের ফুল বটেক না করি ৷৷
দরপণ নীরস সুদূরে পরিহরি৷
কিছার কমলের ফুল বটেক না করি ৷৷
ছি ছি শরতের চাঁদ ভিতরে কালিমা ৷
কি দিয়া করিব তোমার মুখের উপমা ৷৷
যতনে আনিয়া সখি ছানিয়ে বিজলী ৷
অমিয়ার সাঁচে যদি রচিয়ে পুতলী ৷৷
রসের সায়র মাঝে করাই সিনান ৷
তভু তো না হয় তোমার নিছনি সমান ৷৷
হিয়ার ভিতর থুইতে নহ পরতীত ৷
হারাঙ হারাঙ হেন সদা করে চিত ৷৷
হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির ৷
তেঞি বলরামের পহুঁর চিত নয় থির ৷৷
এই প্রেম অপার্থিব, লোকাতীত ও অতীন্দ্রিয় এই ভাবে কবিরা মহাপ্রেমের আভাস দিতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করে শেষ পর্যন্ত অনির্বচনীয় বলে স্বীকার করেছেন ৷পাঠক একজনের পদ থেকে নয়, বহুজনের পদ থেকে মহাপ্রেম সম্বন্ধে একটা আভাস মাত্র পেতে পারবেন ৷ যা সাধনার দ্বারা উপলব্ধব্য তা কবিদের অসম্যক্‌ প্রকাশ থেকে কি করে পাবেন ?