পদাবলী কী গীতিকবিতা? কতগুলো পদের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গের সংযোগে গাঢ়বন্ধতা নাই ৷ এইগুলি অনেকটা চিত্রা ….. ৷ কতগুলোতে আছে সুসম্বন্ধ বাক্য-পরম্পরায় ভাববিশেষের ক্রমোন্মেষ (organic development,-rounded as a star),এইগুলোই উৎকৃষ্ট শ্রেণীর পদ ৷ উৎকৃষ্ট শ্রেণীর পদ অজস্র নয় ৷ অধিকাংশ পদ ঐ উৎকৃষ্ট পদগুলোর অনুকৃতি, অথবা উৎকৃষ্ট শ্রেণীর পদের ভাবই রূপান্তরে প্রকাশিত ৷ এমন কি, সেগুলিতে অন্য পদের পদবিন্যাস, অলঙ্কৃতি, বাক্যক্রম ইত্যাদির permutation combination হয়েছে ৷
লিরিক বা গীতিকবিতা বলতে যাহা বোঝায় এগুলো তা নয় ৷ এগুলো বাণীভূয়িষ্ঠ গানই ৷ গীতিকবিতার সাধারণতঃ একটি নির্দিষ্ট সীমা বা গণ্ডী নাই ৷ তার অন্তর্নিহিত ভাবধারার নিজস্ব একটা বেগবত্তা আছে ৷ সে বেগ কত দূরে গিয়ে বিশ্রান্ত হবে তার একটা বাঁধাধরা নিয়ম নাই ৷ তা দীর্ঘও হতে পারে, হ্রস্বও হতে পারে ৷ কিন্তু গানের একটা নির্দিষ্ট অবধি আছে, তার আকাঙ্ক্ষার একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে, তার রূপ সংক্ষিপ্ত ৷ পদগুলি সেরূপ একটা নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে শেষ হয়েছে,— সনেটের মত ৷
এমন এক-একটা ভাবখণ্ড নিয়ে পদ রচিত হয়েছে যে,তার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা ১২৷১৪ চরণেই পরিতৃপ্ত হয়েছে ৷ ফলে, অনেক সময় এক-একটা পরিপূর্ণ ভাবাবেগ হয়ত একাধিক পদে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ৷
গীতিকবিতার একটা নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য আছে ৷ কবি তাহাতে সাধারণতঃ নিজের প্রাণের কথাই বলেন— নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকেই ছন্দে রূপ দান করেন ৷ পদাবলীর মত একটা গোষ্ঠী, সমাজ বা সম্প্রদায়ের ভাবধারাই তার উপজীব্য হয় না ৷ অন্ততঃ রচনাশৈলী বা ভাবপ্রকাশের ভঙ্গীটা কবির নিজস্বই থাকে ৷ অন্ধভাবে একটা অনুশাসনের বিধিবদ্ধ ভাবধারা, রীতি বা ভঙ্গীর অনুসৃতি গীতিকবিতা নয় ৷
তা ছাড়া, আবৃত্তির জন্য গীতিকবিতা রচনা হয়, যদিও তা গাওয়াও যেতে পারে ৷ (সেইজন্যই নামও এর গীতিকবিতা) ৷ কিন্তু গায়কের কণ্ঠের মুখাপেক্ষী হয়ে গীতিকবিতা রচনা করা হয় না ৷ বৈষ্ণব পদাবলীর অধিকাংশ রচিত হয়েছে সুরের দিকে লক্ষ্য রেখে ৷ ছন্দের মর্যাদা সেজন্য অনেকে গোবিন্দদাসের মত অক্ষরে অক্ষরে সতর্কতার সাথে রক্ষা করে চলেননি ৷ সুরে গাইতে সুবিধা হয়নি বলে হ্রস্বস্বরকে বহু স্থলে দীর্ঘত্ব এবং দীর্ঘস্বরকে হ্রস্বত্ব দান করা হয়েছে ৷