বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনেকেই সংস্কৃত সাহিত্য ও অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন ; ভাগবত ছিল তাঁদের ধর্মগ্রন্থ ৷ অন্যান্য পুরাণের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল ৷ সংস্কৃত রাগসাহিত্যের সমস্ত উপাদান উপকরণই বৈষ্ণব কবিরা পদাবলী-রচনায় গ্রহণ করেছেন ৷
রসমঞ্জরী, অমরুশতক, আর্যাসপ্তশতী, শৃঙ্গারতিলক, বাৎস্যায়নের কামসূত্র ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁরা অনেক ভাববস্তু গ্রহণ করেছেন ৷ সদুক্তিকর্ণামৃত, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, সুভাষিতাবলী, পদ্যাবলী, সূক্তিমুক্তাবলী, শার্ঙ্গধরপদ্ধতি,সূক্তিরত্নহার ইত্যাদি গ্রন্থের বহু শ্লোককে কবিরা নব বাণীরূপ দিয়েছেন ৷ কবিরা সবচেয়ে বেশী ভাবোপকরণ পেয়েছেন— গাহা সত্ত সঈ (হালের গাথা সপ্তশতী) থেকে ৷ ছন্দের দৃষ্টান্তস্বরূপ পিঙ্গলে উল্লিখিত শ্লোকগুলি থেকেও কবিরা ভাবসূত্র লাভ করেছেন ৷ এই সব রচনার মধ্যে যেগুলোতে প্রাকৃত প্রেমের কথা আছে সেগুলোর ভোগোপকরণকে চন্দনাক্ত ও তুলসীবাসিত করে বৈষ্ণব কবিরা রাধাশ্যামের উদ্দেশে নিবেদন করেছেন ৷ গাহা সত্ত সঈ কাব্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমানুরাগের কথাও আছে— এটিই বোধ হয় সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উৎস ৷ ভাগবতের অনেক অংশকে কবিরা চৈতন্যপ্রবর্তিত লীলাতত্ত্বের অনুগত করে নিয়ে পদ রচনা করেছিলেন (রাসলীলাপ্রসঙ্গে এর আলোচনা করা হবে) ৷ বড়ু চণ্ডীদাস ভাগবত, হরিবংশ এবং অন্যান্য পুরাণের রস-নির্যাসকে সেকালে প্রচলিত ধামালী সঙ্গীতের চষকে ঢেলে তাঁর কৃষ্ণকীর্তন পরিবেষণ করেছেন ৷ মালাধর বসু পদকর্তাদের আগেই ভাগবতের মর্মানুবাদ করেছিলেন ৷ এই অনুবাদের এক-একটি অংশ রাগরাগিণী সংযুক্ত হলেও পদের আকারে রচিত নয় ৷ এটি কৃত্তিবাসের রামায়ণের মত প্রধানতঃ পয়ার ছন্দে গ্রথিত ৷ দীন চণ্ডীদাস ভাগবতের অনেক অংশ অবলম্বন করে পদের আকারে একখানা কাব্য রচনা করেন ৷ এটিকে শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল কাব্য বলা যেতে পারে ৷ প্রচীন সঙ্কলন-পুস্তকেও দীন চণ্ডীদাসের কতগুলো পদ স্থান পেয়েছে ৷