খাঁটি বাংলাভাষার পদগুলিতে সংস্কৃত কাব্যের প্রভাব অতি সামান্য ৷ ব্রজবুলিতে রচিত পদগুলি সংস্কৃত কাব্যধারার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত ৷ সংস্কৃত কাব্যে প্রেম ও কামের মধ্যে একটা সীমারেখা নাই— প্রেম ও কাম অঙ্গাঙ্গিভাবে অনুস্যুত ৷ এখন যেমন, বিদেহ প্রেম, নিষ্কাম প্রেম, অতীন্দ্রিয় প্রেম, অবান্তর প্রেম ইত্যাদি নিয়ে কাব্য রচিত হয়, সংস্কৃতে তা হত না ৷ দেহসম্পর্কশূন্য নিরালম্ব প্রেম কাব্যের বিষয়ীভূতই ছিল না ৷ যেখানেই প্রেমের কথা, সেখানেই তার উপযুক্ত দৈহিক আবেষ্টনী, আধার, উপচার, উপকরণ ও আনুষঙ্গিকতার কথা আছে ৷ সীতাকে হারিয়ে দণ্ডকারণ্যে দারুণ বর্ষাগমে রামচন্দ্রের মনে বিরহব্যথার সঞ্চার হয়েছে ৷ মহাকবি তাতে কামার্তিও মিশ্রিত করেছেন ৷ কুমারসম্ভবে মহাযোগীর গৌরীপ্রেমও দেহ-সম্পর্কবর্জিত নয় ৷ সংস্কৃত কবির লেখনীতে হরগৌরীর প্রেমলীলা কামলীলাতেই পরিণত হয়েছে ৷
ব্রজবুলিতে রচিত পদগুলি সংস্কৃত কাব্যধারার দ্বারা আবিষ্ট বলে জয়দেবের গীতগোবিন্দের মতই এইগুলিতে কামলীলারও স্থান হয়েছে ৷ হরগৌরী বা রামসীতার প্রসঙ্গেও মহাকবিরা সতর্কতার প্রয়োজন বোধ করেন নি, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাতে এ ত অপরিহার্য অঙ্গ হবেই ৷
রবীন্দ্রনাথ ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটির ‘কান্ত পাহুন কাম দারুণ’ এই পংক্তির ‘কাম দারুণের’ স্থলে ‘বিরহ দারুণ’ সংযোজন করেছিলেন— এটাই বর্তমান যুগের রসাদর্শের পক্ষে সুসমঞ্জস ৷ বিরহিণীর পক্ষে ‘কাম দারুণ’ যখন পরম সত্য, তখন তাই লিখতে বৈষ্ণব কবি কোন অসঙ্গতি দেখেননি ৷ সংস্কৃত কাব্যের অনুসৃতি এবং কাব্যের চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারার অনুবর্তনের ফলেই ব্রজবুলির পদাবলীতে কামলীলার বর্ণনা স্থান পেয়েছে ৷