প্রত্যেক লীলা-প্রকরণের প্রারম্ভে তদ্‌ভাবানুগ গৌরচন্দ্রিকা সংযুক্ত হয়েছে এবং কীর্তনের প্রারম্ভেই গীত হয় ৷ শ্রীমতীর যে ভাবটিকে আশ্রয় করে লীলাবিশেষের পদ সংকলিত হয়েছে— শ্রীচৈতন্যের জীবনে ঠিক সেই ভাবের বিলাস যে পদে বাণীরূপ লাভ করেছে— সেই পদই ঐ ভাবপ্রকরণের গৌরচন্দ্রিকা হয়েছে ৷ গৌরচন্দ্রিকা শুনলেই বোঝা যায় কোন্‌ লীলাপ্রকরণের কীর্তন গাওয়া হবে ৷ ব্রজলীলার সঙ্গে ভাবসাম্য রক্ষা করার জন্য যে অনেক পদ যে কবিরা চেষ্টা করে লিখেছেন তা বোঝা যায় ৷ সেজন্য বহু অস্বাভাবিক ভাবও গৌরাঙ্গের জীবনে আরোপিত হয়েছে ৷ বিবিধ রসের ও ভাবের কীর্তনগানের চাহিদাতেই বিবিধ রস ও ভাবের গৌরপদাবলী রচিত হয়েছে ৷ কীর্তনের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গেই গৌরপদাবলীর সমৃদ্ধি বেড়েছে ৷ নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ,পরবর্তী যুগে লোচনদাস চৈতন্যের রসজীবনে রাধা অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণভাবেরই প্রাধান্য স্বীকার করেছেন ৷ সেজন্য ব্রজগোপীদের ভাবে নদীয়া-নাগরীদের বিভাবিতা কল্পনা করে বহু রাগরসের পদ তাঁরা রচনা করেছেন ৷ এঁরা কেবল চৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণ বলিয়া জানিতেন না — নদীয়াকে নব-বৃন্দাবন মনে করতেন ৷
বাসু ঘোষ শ্রীচৈতন্যের রাধাভাবের পদও রচনা করেছিলেন অনেক৷ এইগুলিও গৌরচন্দ্রিকারূপে গৃহীত হয়েছে৷ অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ বলেছেন — ”গৌরচন্দ্রিকা গান করার পদ্ধতি শ্রীচৈতন্যের সময়ে বর্তমান ছিল না ৷ শ্রীচৈতন্য লীলাকীর্তনের প্রবর্তক হলেও কীর্তনসঙ্গীতের শ্রীবৃদ্ধি হয় তাঁর তিরোধানের পর ৷ কীর্তনগানের শ্রীবৃদ্ধির সাথে গৌরচন্দ্রিকার সমাদর বেড়ে যায়৷” খগেনবাবু আরও বলেছেন— ”রাগরাগিণীর কলাকৌশল দেখানোর পক্ষে গৌরচন্দ্রিকাই প্রশস্ত ৷”
কীর্তনগানের আগে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়ার সার্থকতা একাধিক ৷ একটি সার্থকতা এই— রাধাকৃষ্ণের লীলাসঙ্গীতে কোথাও ঐশ্বর্য আরোপিত হয়নি, তাতে এই সঙ্গীতকে প্রাকৃত প্রণয়ের লালসামূলক সঙ্গীত মনে হতে পারে ৷ গৌরচন্দ্রিকা উদ্‌গীত হইয়া প্রথমতঃ একটা আধ্যাত্মিক পরিবেষ্টনীর সৃষ্টি করে ৷ তাই ই মূল রাগলীলাসঙ্গীতকে একটা mystic interpretation দান করে ৷ শ্রোতা শ্রীগৌরাঙ্গের ভক্তজীবনের লীলাবিলাসকেই বৃন্দাবনলীলায় রূপে-রসে পরিমূর্ত ভাবতে পারে ৷ বলা বাহুল্য কীর্তনগানের নিজস্ব কলাসৌষ্ঠব ও সুরের mystic appeal ও এর সহায়তা করে ৷ শ্রীকৃষ্ণই যে গৌরাঙ্গরূপে অভিনব লীলা করেছেন লীলাগানের অনুরূপ গৌরচন্দ্রিকার দ্বারা সকলকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় ৷ ব্রজলীলার রস যিনি নিজের জীবনে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন , তাঁরই ভাবে শ্রোতৃগণকে তন্ময় ও বিভাবিত করাও এর উদ্দেশ্য৷ গৌরাঙ্গদেবকে স্মরণ করলে চেতোদর্পণ মার্জিত হয়, তার ফলে স্বচ্ছ নির্মল চিত্তে ব্রজলীলার প্রকৃত স্বরূপটি প্রতিফলিত হইতে পারে ৷ রায় রামানন্দের কথায় গৌরচন্দ্রিকা ব্রজলীলার পরমান্নে একবিন্দু কর্পূরের কাজ করে ৷ এই একবিন্দু কর্পূরে সমগ্র লীলার মাধুরীসম্পূটই সুবাসিত হয় ৷
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘মহাপ্রভু কৃষ্ণলীলার চমৎকারিত্ব যেরূপভাবে আস্বাদন করেছিলেন, এমন আর কেউ করেননি ৷ বস্তুতঃ সেই নিখিল রসমাধুরী-বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ শ্রীগৌরাঙ্গরূপে নিজ রসমাধুর্য নিজেই আস্বাদন করেছিলেন ৷ সুতরাং তাঁরই অনুগত হয়ে রসাস্বাদন করার যে প্রতিজ্ঞা গায়ক ও ভক্তগণ করেন, তা তত্ত্বের দিক্‌ দিয়ে ও রসের দিক দিয়ে সর্বথা যোগ্য বলে মনে হয় ৷ তারপর কৃষ্ণলীলা গান করতে হলে চিত্তশুদ্ধি আবশ্যক ৷ শ্রীমন্‌ মহাপ্রভুকে স্মরণ করলে হৃদয় নির্মল হয় ৷
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুই কীর্তনের অধিদেবতা ৷ সেইজন্যও মহাপ্রভুর নাম ব্যতীত যে কীর্তন হয়, তা বিবেকী শ্রোতৃসমাজে গ্রহণীয় নয় ৷ প্রতিমা বহুমূল্য মণিমরকতে নির্মিত হতে পারে, প্রাণপ্রতিষ্ঠা না করলে যেমন তার পূজা হয় না তেমনি গৌরচন্দ্রিকার দ্বারা প্রস্তাবনা না করে কীর্তনগান করতে নাই ৷”
তিনি অন্যত্র লিখেছেন —
”অন্য সমস্ত কারণ ছাড়িয়া দিলেও শুধু কৃতজ্ঞতার দিক্‌ দিয়া গৌরচন্দ্রিকার আদর হওয়া উচিত ৷ বাঙ্গালী অকৃতজ্ঞতার দিক্‌ দিয়া গৌরচন্দ্রিকার আদর হওয়া উচিত ৷ বাঙ্গলী অকৃতজ্ঞ নহে ৷ তাহারা অন্যের সম্পত্তি ব্যবহার করিতে হইলে তাহার নাম করিতে ভুলে না ৷ সুতরাং যে করুণাবতার কীর্তনের ভাগীরথী সারা বঙ্গে আনয়ন করিয়া এদেশে ধন্য করিয়াছিলেন, কীর্তনের প্রারম্ভে তাঁহার নাম স্মরণ করিয়া বাঙালী দু-ফোঁটা চোখের জল কেন-না ফেলিবে ?”