সে যুগে মিথিলার সঙ্গে, বিদ্যাজ্ঞানের আদানপ্রদানের পথে, বাংলার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল ৷ বিদ্যাপতির পদাবলী শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে থেকেই বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল ৷ বিদ্যাপতির পদাবলীর ভাষার নাম ব্রজবুলি ৷ ডাঃ সুকুমার সেনের মতে খৃঃ ৭ম-৮ম শতাব্দী থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত পাঁচ শ বছর ধরে আর্য ভাষাভাষীদের মধ্যে আর্যাবর্তের কথ্যভাষার সার্বভৌম সাধুরূপকে আশ্রয় করে যে সাহিত্য রচনার ভাষা প্রচলিত ছিল তার একটি নাম অবহট্‌ঠা ৷ এই অবহট্‌ঠা থেকেই পূর্বভারতের প্রত্যেক প্রদেশে ব্রজবুলির উৎপত্তি ৷ অবহট্‌ঠাই মৈথিলী, বাঙ্গালা, উড়িয়া, আসামী ইত্যাদি স্থানীয় ভাষার প্রভাবে ১৫শ-১৬শ শতাব্দীতে ব্রজবুলির রূপ ধারণ করেছে— এক হিসাবে এটি সর্বভারতীয় কনিষ্ঠতম সাধু আর্য ভাষা ৷ এই ভাষাই বাংলাদেশে প্রচুর বাংলা পদ এবং সংস্কৃত শব্দের বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তিজাত রূপের সাথে মিশে পদাবলী সাহিত্যের বাহন হয়েছে ৷ অন্য কোন প্রদেশে এমন ব্যাপকভাবে ব্রজবুলির পদ রচিত হয়নি ৷ বাংলায় ব্রজবুলির প্রথম পদ যশোরাজ খাঁর,— ”এক পয়োধর চন্দনে লেপিত আরে সহজই গোর ৷” তারপর উড়িষ্যার রামানন্দ রায়ের বিখ্যাত পদ— ”পহিলহি’ রাগ নয়নভঙ্গ ভেল ৷”— আমাদের পদাবলী সংকলনে স্থান পেয়েছে ৷
শ্রীচৈতন্যদেবের সময়ে বাংলায় ব্রজবুলিতে পদরচনার পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রচলিত হয়নি ৷ চৈতন্যদেবের তিরোধানের কিছু দিন পরে ব্রজবুলিতে পদরচনার ধুম পড়ে গেল ৷ খেতুরির উৎসবের সময়ে ব্রজবুলির পদ লীলাকীর্তনের প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছিল ৷ এ ভাষায় কোন পুরা গ্রন্থ রচিত হয়নি ৷ বৈষ্ণব সমাজেও এটি কথিত ভাষা হয়ে ওঠেনি ৷ কিন্তু বৈষ্ণব সমাজের সকলেই এই ভাষা বুঝত ৷ কিন্তু এই ভাষায় পদরচনার সার্থকতা কি ?
১৷ এই ভাষা এতই উদার ও আতিথেয় যে, এর মধ্যে যে-কোন প্রাদেশিক ভাষার শব্দ সহজে সামঞ্জস্য লাভ করে ৷ সেজন্য এই ভাষায় কখনও উপযোগী শব্দের অভাব হয়নি ৷ দবির খাস ও শাকর মল্লিকের বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশের মতো এতে ফারসী শব্দও প্রবেশ করেছে ৷
২৷ ব্রজবুলির সঙ্গে কবিরা প্রাকৃত ভাষার বিবিধ সুললিত ছন্দ পেয়েছেন ৷ এই ছন্দগুলি দীর্ঘহ্রস্ব স্বরের সমাবেশে হিন্দোলিত। বাংলা ভাষায় দীর্ঘস্বর তার গুরুত্ব ও দীর্ঘতা হারিয়েছিল— বাংলায় যুক্তাক্ষরের পূর্বস্বর ছাড়া অন্যত্র দীর্ঘস্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ করতে গেলে অস্বাভাবিক হয়ে উঠত ৷ কিন্তু ব্রজবুলিতে তা হয় না ৷ কথিত ভাষায় দীর্ঘস্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ অস্বাভাবিক শোনায়— কৃত্রিম ভাষাতে সে অসুবিধা নাই ৷ এইভাবে ছন্দোহিন্দোল পাওয়ার সুযোগের জন্য কবিরা ব্রজবুলিকে আশ্রয় করেছিলেন ৷ বাংলা ভাষায় হসন্ত শব্দের সংখ্যা খুব বেশী । ব্রজবুলির অধিকাংশ শব্দ স্বরান্ত ৷ পদকর্তারা যে ছন্দগুলোতে পদ রচনা করতে চেয়েছিলেন— সেই ছন্দগুলোতে হসন্ত শব্দ একেবারেই উপযোগী নয়, সেজন্যও তাঁরা ব্রজবুলির আশ্রয় নিয়েছিলেন ৷
৩৷ শ্রীচৈতন্যদেবের সময় থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম সমগ্র আর্যাবতে প্রচারিত হয়েছিল ৷ বিশেষতঃ বৃন্দাবন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় আর্যাবর্তেও বঙ্গীয় পদাবলী-সাহিত্য-প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল ৷ আর্যাবর্তের বহু লোকও এই সাহিত্য উপভোগের জন্য পিপাসু ছিল ৷ সেজন্য কবিরা এমন ভাষার আশ্রয় নিলেন, যা আর্যাবতের্র সকল লোকরই সহজে বোধগম্য হতে পারে ৷ যে অবহট্‌ঠা ব্রজবুলিতে রূপান্তরিত তাহা আর্যাবর্তের সর্বত্রই কতকটা পরিচিত ৷
৪৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসসাধনার সহায়ক একটি স্বতন্ত্র নিজস্ব ভাষা থাকে, কবিগণের সম্ভবতঃ ইহা অভিপ্রেত ছিল ৷ সর্বজনের উচ্ছিষ্ট লৌকিক ভাষাকে অলৌকিক রসের অভিব্যক্তিতে যথাসম্ভব বর্জনের চেষ্টা হয়েছে ৷
৫৷ অনধিকারী প্রাকৃত জনের দ্বারা পাছে পদাবলীর মর্যাদাহানি হয় বলে হয়ত কবিরা প্রাকৃত জনের ভাষা বর্জন করেছেন ৷ বিশেষতঃ সম্ভোগের বর্ণনা সর্বজনবোধ্য ভাষায় হওয়া কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয় ৷ ব্রজবুলিতে যা আদিরসাত্মক সাহিত্য, তা প্রচলিত ভাষায় রচিত হলে অশ্লীল কামলীলার বর্ণনা মাত্র বলে মনে হবে ৷
৬৷ প্রেমলীলা-বর্ণনার পক্ষে এই ললিত কোমল তরলায়িত ভাষাকে বিশেষ উপযোগী বলে মনে করা হয়েছিল ৷ বিদ্যাপতির বাংলায় রূপান্তরিত পদাবলীতে মধুররসাত্মক ব্রজলীলাবর্ণনা ব্রজবুলিকে প্রেমলীলার আদর্শ ভাষা করে তুলেছিল ৷ আমাদের কবিরা অন্যান্য রসোপকরণের সঙ্গে তাই বিদ্যাপতির ভাষার বঙ্গীয় রূপকে গ্রহণ করেছিলেন ৷ পরে এই ভাষায় অ-বৈষ্ণব ভাবের কবিতাও লেখা হয়েছিল ৷ কিন্তু সে সব কবিতার আদর হয়নি ৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ, রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্রের ব্রজবুলিতে রচিত কবিতার নাম করা যেতে পারে ৷ ভানুসিংহ ঠাকুরই ব্রজবুলির শেষ কবি ৷
৭৷ স্কটল্যাণ্ডের প্রাদেশিক ভাষায় রচিত Burnsএর কবিতা যেমন ইংলণ্ডের নাগরিকদের মধুর লাগে— ব্রজবুলিও তেমনি বাঙ্গালী পাঠকের মধুর লাগত ৷ রসিক শ্রোতাদের চাহিদাতেই বোধ হয়, এই ভাষা কবিদের আদরণীয় হয়েছিল ৷
৮৷ দেশগত ও কালগত ব্যবধান যেমন একটা রোমান্সের সৃষ্টি করে— ভাষাগত ব্যবধানও তেমনি একটা রোমান্সের সৃষ্টি করত ৷
৯৷ কীর্তন সঙ্গীতের রসমূর্ছনা ও সুরের অলঙ্করণের পক্ষে বাংলা অপেক্ষা ব্রজবুলি অধিকতর উপযোগী বলেও বোধ হয় কবিরা ব্রজবুলিতে পদ রচনা করতেন ৷ মোটের উপর, এই অপূর্ব ভাষাটির জন্য বঙ্গীয় কবিরা বিদ্যাপতির কাছে প্রধানতঃ ঋণী ৷ যশোরাজ খানের প্রদত্ত নিদর্শন প্রচার লাভ করে ৷ বিদ্যাপতির পদাবলীই বাঙালী কবিদের ব্রজবুলিতে পদরচনায় প্রেরণা দিয়েছে— শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধানের পরে ৷