আরো নিঃশেষ করে রসসম্ভোগ করতে হলে অর্থাৎ ওটাকে মিস্‌টিক কাব্য হিসাবে উপভোগ করতে হলে লীলারসের রসিক হতে হবে ৷ আমাদের চিত্ত এমন সংস্কারাচ্ছন্ন — আমাদের চেতোদর্পণ এমনই অমার্জিত যে, সহজে সেই উজ্‌জ্বল রসের উজ্‌জ্বলতা তাতে প্রতিফলিত হয় না ৷ এজন্য প্রথমে ভাগবতাদি ধর্মগ্রন্থের বাণীকে আপ্তবাক্যস্বরূপ স্বীকার করতে হবে— বৈষ্ণবগুরুগণের উপলব্ধ সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে ৷ এই বিশ্ব যে ব্রহ্মের সৃষ্টি (creation) বা অভিব্যক্তি (manifestation) বা বিবর্তন (evolution) নয় — এটা যে তাঁর লীলামাত্র, এ সত্য উপলব্ধি করা সহজ নয় ৷ এজন্য আপ্তবাক্য বা আর্যবাক্যে বিশ্বাস করতে হবে ৷ সাধারণ পাঠক যদি transcendental কবিতা হিসাবে পদাবলীর রস উপভোগ করেন, তবে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না ৷ এই বৈজ্ঞানিক যুগে আপ্ত বাক্যনিষ্ঠতা প্রত্যাশা করা ভুল ৷ বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যেই অনেকে উজ্জ্বল রসে অন্তর্নিহিত সার্থকতা ও গূঢ়রহস্য মনে প্রাণে উপলব্ধি করেন না— দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যরস পর্যন্ত উপলব্ধি করেন ৷
মানুষ ভালবাসে, জ্ঞানলাভ করে, কাজ করে আর খেলায় মাতে ৷ জ্ঞান, কর্ম আর প্রেম এই তিনটি বৃত্তি নিয়ে তার সত্তা ৷ কর্মের মূলে আছে অভাব, প্রয়োজন ও দুঃখ ৷ যে ভগবানের এ সব কিছুই নাই, কর্মমার্গে তাঁর সন্ধান বৃথা ৷ জ্ঞানের পথে তাঁর সন্ধান পাওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু জ্ঞান সকল মানুষের অধিগম্য নয় ৷ তাই জ্ঞানপথে তাঁর সন্ধান সর্বজনীন নয় ৷ প্রেমই সর্বদেশের সর্বযুগের সর্বস্তরের মানুষের সাধারণ জীবনধর্ম ৷ প্রেমই মানুষকে জ্ঞানপথ থেকে আহ্বান করে কর্ম থেকে বিশ্রাম দিয়ে লীলায় মাতাতে পারে ৷ লীলাই মানুষের অহৈতুকী আত্মাভিব্যক্তি৷ ভগবান্‌কে তাই ভক্তিপথের সাধকগণের প্রেমময় ও লীলাময় বলে কল্পনা করেছেন ৷ তাঁরা মনে করেন, প্রেমের বিবিধ লীলার মধ্যে দিয়েই তাঁর সান্নিধ্যলাভ ঘটতে পারে ৷ বৈষ্ণব ভক্ত ও কবিগণ তাই প্রেমলীলার রস উপভোগ করাই সাধনভজন মনে করেছেন ৷
এই বিশ্ব লীলাময় ভগবানের লীলাবিলাস ৷ কিন্তু লীলার রস পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্য তিনি সসীমকে আশ্রয় করেছেন অর্থাৎ নরদেহ ধারণ করেছেন ৷ হতে পারেন তিনি বিশ্বম্ভর, হতে পারেন তিনি সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, তিনি যখন একবার লীলায় নেমেছেন – এবং আমাদের লীলায় ডাক দিয়েছেন— তখন তাঁর ঐশ্বর্য বা ভগবত্তা কেন স্বীকার করব ? তাঁকে ভয়ই বা করব কেন ? পাছে অপরাধ হয় এই ভেবে কুণ্ঠাই বা প্রকাশ করব কেন ? তাঁর সম্বন্ধে আমাদের সঙ্কোচই বা কী ? খেলার সাথী যেই হোক তার সঙ্গে আমাদের যে আচরণ সেই তাঁর প্রাপ্য ৷ তিনি এতে রাগ করতে পারেন না — তা হলে তিনি লীলাময় নন— ছলনাময় ৷ নিজের ভগবত্তা তাঁকে ভুলতে হবে ৷ বৈষ্ণব ভক্তগণ বলেন, বৃন্দাবনলীলায় তিনি সেই ভগবত্তা ভুলেছিলেন ৷ তাঁর সেই ভগবত্তা ভোলা আর লীলায় মাতার গানই পদাবলী ৷