রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
১৷ আমার মাঝে তোমার লীলা হবে
তাইত আমি এসেছি এই ভবে ৷
২৷ আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর
তোমার প্রেম হ’ত যে মিছে ৷
তাইত তুমি রাজার রাজা হ’য়ে
তবু আমার হৃদয় লাগি’
ফিরছ কত মনোহরণ বেশে
প্রভু নিত্য আছ জাগি ৷
৩৷ দয়া ক’রে ইচ্ছা ক’রে
আপনি ছোট হয়ে,
এস তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে ৷
তাই তোমার মাধুর্য-সুধা
ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা
জলে স্থলে দাও যে ধরা কত আকার ল’য়ে ৷৷
বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে
আপনি তুমি ছোট হয়ে এর হৃদয়ে ৷

এই সমস্ত গানে রবীন্দ্রনাথ ভগবান্‌কে লীলাময় রূপেই কল্পনা করেছেন — এটি বৈষ্ণব-রসতত্ত্ব-সম্মত, কিন্তু সেইসঙ্গেই তিনি বলেছেন—

আমি কি আপন হাতে কর্‌ব ছোট বিশ্বনাথে?
জানাব আর জানব তোমায় ক্ষুদ্র পরিচয়ে ?

এই উক্তি লীলাতত্ত্বের সাথে সমঞ্জস হয় না ৷ লীলাময়ের সঙ্গে শান্ত বা দাস্য ভাবে পরিচয় উচ্চাঙ্গের ভক্তির কথা নয় ৷ বৈষ্ণব সাধক বলবেন— তিনি যদি লীলার জন্যই অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, তবে তাঁর লীলাসঙ্গী বা সঙ্গিনী হওয়াই তো তাঁর পক্ষে পরম প্রীতিকর ৷ লীলায় যোগ না দিলে তাঁর সঙ্গে সংযোগ কি করে সম্ভব ? তিনি আসলেন খেলা খেলতে, আমি কি তাঁর খেলায় যোগ না দিয়া ফুলচন্দন দিয়া তাঁর পূজা করতে থাকব অথবা জোড়হাতে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর স্তব করব ? তাঁর লীলায় যোগ দেওয়া এবং সেই লীলা উপভোগ করা ছাড়া আমার করার কি আছে ? আমাকেও ভুলতে হবে যে তিনি ত্রিভুবনেশ্বর ৷ লীলার রঙ্গভূমে আবার ছোট বড় কি ?
শেখরের পদে সখী রাধাকে বলেছেন ‘মোরে দেখি পাটাবুকী না করিল ডর৷’ এই রাধার মতোই পাটাবুকো এই পদকর্তারা ৷ ভগবানের সঙ্গে আচরণে ব্যবধান জয় করিবার এত সাহস আর কোন কবি, কোন ভক্ত কি দেখাতে পেরেছেন ?
সাহসের সাথে এই ব্যবধানটা জয় করাই উচ্চতর বৈষ্ণব সাধনা ৷ পদকর্তারা সকলেই লীলাসঙ্গী ৷ তাঁরা তাঁদের পদাবলীর রসসঙ্কেতের দ্বারা আমাদেরকেও লীলাসঙ্গী হতে আহ্বান করেছেন ৷
রবীন্দ্রনাথ আর একটি গানে বলেছেন—
সুরের ঘোরে আপনারে যাই ভুলে
বন্ধু বলি ডাকি মোর প্রভুকে ৷
সুরের ঘোর কেটে গেলেই বন্ধু আবার প্রভু হয়ে যান ৷ কবিসখা হয়ে পড়েন দাস ৷ বৈষ্ণব কবিদের এই সুরের ঘোর একেবারেই কোনদিন কাটেনি, তাই তাঁদের প্রভু চিরদিনই সখাই থেকে গেছেন ৷
রবীন্দ্রনাথ লীলাময়ের লীলায় ভক্তের দাস্যভাবের কথাই বলেছেন ৷ এই দাস্যভাবই আমাদের সংস্কারগত ভাব ৷ এই ভাবকে ত্যাগ করা কঠিন ৷ সেজন্য বৈষ্ণব সাধকগণ সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ভাবের মধ্যেও এই দাস্যভাব নিগূহিত আছে বলে স্বীকার করেছেন ৷ যাকে ভালবাসা যায় তার সেবা-পরিচর্যা করতেই স্বতই ইচ্ছা হয় ৷ ব্রজের সখারা কাঁধেও চড়েছেন, আবার দাসত্বও করেছেন ৷ সখীরা যৎপরোনাস্তি তিরস্কারও করেছেন, আবার সেবাও করেছেন ৷ পদকর্তারা সখীস্থানীয় হয়েও অনেক ভণিতায় দাস্যভাব প্রকাশ করেছেন ৷ নিজেদের নামের সঙ্গে দাস শব্দ যোগ করেও দাস্যভাবকে স্বীকার করেছেন ৷
শ্রীরাধা বলছেন—
কৃষ্ণ মোরে কান্তা করি কহে যবে প্রাণেশ্বরী
মোর হয় দাসী অভিমান ৷
—চৈতন্যচরিতামৃত
শ্রীরাধা যখন উপেক্ষিতা হয়েছেন, অনুতপ্তা হয়েছেন, বিরহাতুরা হয়েছেন, শরণাগতা হয়েছেন, তখন তাঁর প্রেমমাধুর্যের নিম্নতলস্থ দাসীভাব জেগে উঠেছে ৷
বঁধু কি আর বলিব আমি ৷
জীবনে মরণে জনমে জনমে
প্রাণনাথ হইও তুমি ৷৷
তোমার চরণে আমার পরাণে
বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি ৷
সব সমর্পিয়া একমন হইয়া
নিশ্চয় হইলাম দাসী ৷৷
শ্রীকৃষ্ণ নিজেও শ্রীমতীর প্রতি দাস্যভাব নিবেদন করে বলছেন —
কিশোরীর দাস আমি পীতবাস
ইহাতে সন্দেহ যার,
কোটি যুগ যদি আমারে ভজয়ে
বিফল ভজন তার ৷
ভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে উপমা ভক্তির লক্ষণ এই—
অন্যাভিলাষিতাশূন্যং জ্ঞানকর্মাদ্যনাবৃতম্‌ ৷
আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা ৷
কবিরাজ গোস্বামীও বলেছেন —
চতুর্বর্গ লব্ধ হয় বেদাচারে ক্রমে,
রসময় সেবা ছাড়া মিলে না পঞ্চমে ৷
বৈষ্ণব সাধকগণ দাস্যভাবকে অস্বীকার করেননি ৷ তাঁদের মতে উচ্চতর ভাব সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ৷ এই ভাবগুলির মধ্যে দাস্যভাব নিগূহিত আছে ৷ বৈষ্ণব কবিরা শ্রীকৃষ্ণরাধার লীলাসঙ্গী, সেজন্য তাঁদের ভাব প্রধানতঃ সখ্যভাব ৷