পদাবলী-সাহিত্য প্রধানতঃ আদিরসের রচনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে একটা অলৌকিক কারুণ্যধারা প্রবাহিত ৷ যে ধামকে অবলম্বন করে পদাবলী রচিত সে ধাম ত কালিদাসের অলকাপুরীর মত আনন্দধাম ৷ সেখানে রোগ শোক দারিদ্র্য বঞ্চনা অপমান ইত্যাদি প্রাকৃত দুঃখের রেখাটিও নাই ৷ তবে এ কারুণ্য কিসের জন্য ?
শ্রীকৃষ্ণকে সখা বলিয়া ডাকিতে যে সুবল-শ্রীদামের চোখে জল আসে, গোপালের গায়ে হাত দিলে যশোদার চোখে যে জল আসে এ কোন্‌ কারুণ্য ? বংশীধ্বনি শুনিয়া ব্রজগোপীদের মন যে-কোন্‌ অজ্ঞেয় রহস্যময় বেদনায় উন্মনা হয়ে ওঠে ৷ এ কোন্‌ বেদনা ? যে কারুণ্যে রাধাশ্যাম ‘দুহুঁ’ ক্রোড়ে দুহুঁ কাঁদে’, ‘নিমিখে মানয়ে যুগ কোরে দূর মানে’— সে কারুণ্য কিসের ? ভাবসম্মেলনের উল্লাসও গভীর কারুণ্যেরই নামান্তর ৷ মাথুরের হাহাকার কি যমুনার এপার ওপার ব্যবধানটুকুর জন্য ? জনম অবধি রূপ দেখেও যে নয়ন তৃপ্ত হয় না, লাখ লাখ যুগ হৃদয়ে হৃদয় রেখে যে হৃদয় জুড়ায় না— তা কোন্‌ অতৃপ্তির বাণী ? এ সকল প্রশ্ন পাঠকের মনে আসা স্বাভাবিক ৷ মনে আসলেই স্বতই মানবজীবনের চিরন্তন অপূর্ণতা, সসীমতা, অসহায়তা, অস্বস্তি ও অশক্তির বেদনার সুরই সমস্ত পদাবলীর মধ্যে আমরা শুনতে পাই ৷ মানবাত্মার এই বেদনাই মাথুর ৷
হৃদয়ে যে-কোন মধুর বৃত্তি গভীর গাঢ় ও অন্তর্গূঢ় হলেই আমরা পূর্ণের সান্নিধ্য লাভ করি— তখনই আমরা নিজেদের অপূর্ণতা উপলব্ধি করি ৷ সেই উপলব্ধি যে কারুণ্যের সৃষ্টি করে, ব্রজের কারুণ্যও কি তাই নয় ?