পদাবলী একটা রসগোষ্ঠীর রচনা ৷ যাঁদের নামের ভণিতা আছে তাঁরা যেন উপলক্ষ মাত্র ৷ কার রচনায় যে কার ভণিতা আছে, অনেক ক্ষেত্রে তার ঠিক নাই ৷ একটা ভণিতা দিতে হয় তাই যেন দেওয়া হয়েছে ৷ বহু কবি সম্ভবতঃ তাঁদের নিজের রচনায় বিখ্যাত কবির ভণিতাই চালিয়েছেন ৷ আত্মবিলোপ যে সাধনার অঙ্গীভূত, সে সাধনায় ভণিতাযোগও যেন একটা অভিমানের কথা ৷ তাই ভণিতায় দীনতার অবধি নাই ৷ যার যে উপাধিই থাকুক সকলেই ‘দাস’ ৷ পদে যাঁর ভণিতা থাকে, ভাষা যদি তাঁর নিজস্ব হয়, ভাব তাঁর নয়— ভাব ঐ রসগোষ্ঠীর নিজস্ব ৷ এমন কোন ভাব কোন পদে পাওয়া যায় না— যাহা অন্যান্য পদেও নাই ৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ—
বিদগ্ধমাধবে রূপ গোস্বামী লিখলেন—
অকারুণ্যঃ কৃষ্ণো ময়ি যদি তবাগঃ কথমিদম্‌
মুধা মা রোদীর্মে কুরু পরমিমামুত্তরকৃতিম্‌ ৷
তমালস্য স্কন্ধে সখি কলিতদোর্বল্লরিরিয়ম্
যথা বৃন্দারণ্যে চিরমবিচলা তিষ্ঠতি তনুঃ ৷৷
যদুনন্দনদাস লিখলেন—
তমালের কান্ধে মোর ভুজলতা দিয়া ৷
নিশ্চল করিয়া তুমি রাখিয়ো বান্ধিয়া ৷৷
শ্রীখণ্ডের বিদ্যাপতি লিখলেন—
না পোড়াইও রাধা অঙ্গ না ভাসাইও জলে ৷
মরিলে তুলিয়া রেখ তমালের ডালে ৷৷

শশিশেখর তাঁর স্বাভাবসিদ্ধ ছন্দোমাধুর্য যোগ দিয়ে বললেন—
নীরে নাহি ডারবি অনলে নাহি দাহবি
রাখবি তনু ইহ বরজ মাঝে ৷
হামারি দুন বাহু ধরি সুদৃঢ় করি বাঁধবি
শ্যামরূপী তরু-তমালডালে ৷
শুধু ভাব নয়, এমন অলঙ্কারেরও প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়— যা অন্যান্য কবির রচনাতেও পাওয়া যায় না ৷
বৈষ্ণব কবিগোষ্ঠীর মতে পদরচনার ভাব, ভাষা, অলঙ্কৃতি সমস্তই এজমালী সম্পত্তির মত; তাতে সকলেরই ছিল সমান অধিকার ৷ সে যুগের রসজ্ঞদের কাছেও ব্যক্তির বিশেষ কিছু মূল্য ছিল না— রসবস্তু ও রসগোষ্ঠীর দিকেই তাঁরা দৃষ্টি রাখতেন ৷
পদগুলি যেন একটি বিশাল রসপ্রবাহের কতগুলি হিল্লোল, রসধারার প্রবাহরক্ষাই সে কালের রসিক-ভাবুকদের মতো কবিদেরও লক্ষ্য ছিল ৷ রসপ্রবাহের সোনার তরীতে সোনার কমল তুলে দিয়েই কবিরা দায়মুক্ত ৷ কবিগুরুর ভাষায় ‘রাতের তারা স্বপ্ন-প্রদীপখানি ভোরের আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে যায় চ’লে তার দেয় না ঠিকানা ৷’
কবিদের নিজস্ব যা ছিল সেটুকুকেও রচনার রূপ দেওয়ার সুযোগ-সুবিধা হয়নি ৷ প্রচলিত আদর্শ ও বিধিবিধনের অনুগত হয়েই তাঁদের চলতে হত ৷ পূর্ববর্তী মহাজনগণ যা বলেননি, তা বলতে কারও সাহসও হয়নি, বলা সঙ্গত নয় বলেও বোধ হয় ধারণা ছিল ৷ তাঁরা জানতেন মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ ৷ পাছে রসাভাস ঘটে, পাছে সুরসৌষম্য (harmony)নষ্ট হয়, পাছে গোষ্ঠিধর্ম্ম ক্ষুণ্ণ হয়—পাছে বৈষ্ণবাচার্যগণের অনুশাসন লঙ্ঘিত হয়, এ আশঙ্কাও ছিল। একালের মত তখন তো আর সাধারণ পাঠকসমাজ ছিল না— কাজেই বৈষ্ণব সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁদের পদগুলি রচনা করতে হয়েছে। একটা বিরাট মহাসঙ্কীর্তনে দুই একজন মূল কণ্ঠের সঙ্গেই সকলে সুর মিলিয়ে গিয়েছেন।