ভক্তিমার্গে ভিন্ন ভিন্ন রসস্তর— আমরা সাধারণ মানুষ ভয়ে ভক্তি করি, আমরা যাঁর কৃপা প্রার্থনা করি তাঁকে ভক্তি করি, যাঁর অনুগ্রহ আমরা পাই কৃতজ্ঞতাবশেও তাঁকে ভক্তি করি ৷ বৈষ্ণব সাধনায় কোন প্রার্থনা নাই, কোন কৃপালাভের প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি মোক্ষ পর্যন্ত প্রার্থনীয় নয়— ‘মোক্ষবাঞ্ছা কৈতব প্রধান ৷ যাহা হইতে কৃষ্ণভক্তি হয় অন্তর্ধান ৷’ ভুক্তিবাঞ্ছার মত মুক্তিবাঞ্ছাও পরিত্যাজ্য ৷ কাজেই ভয়মিশ্রা ভক্তি, কৃতজ্ঞতামূলক ভক্তি, সকাম ভক্তি, মোক্ষমূলা ভক্তি ইত্যাদির স্থান বৈষ্ণব পদাবলীতে নেই৷
আমরা যাঁর মাহাত্ম্যে বা ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হই, বিনা প্রয়োজনের আমরা তাঁকে ভক্তি করি, তাঁর উপাসনা করি ৷ এটাই শান্তভাবের উপাসনা ৷ ঐশ্বর্যবোধ ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করছে, এতে উপাস্য আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠছেন না ৷ কাজেই, এটি পুরুষোত্তমে অহৈতুকী অব্যবহিতা ভক্তি নয় ৷ ভক্ত-ভগবানের এই সম্বন্ধে ভগবান্‌কে লীলাময় বলিয়া স্বীকার করা হয় না ৷ এই ভক্তির স্থান পদাবলীতে নাই ৷
দাস্যভাবে উপাস্যের সেবা করে আমরা আনন্দ পাই— এই আনন্দই পুরস্কার ৷ অন্য কিছু প্রার্থনীয় নাই ৷ এই দাস্যভাবকে বৈষ্ণব সাধক একপ্রকার প্রেম বলে স্বীকার করেন ৷ ভারতবর্ষের অধিকাংশ বৈষ্ণব এই ভাবেরই উপাসক৷ মন্দিরে মন্দিরে দেবসেবার মধ্য দিয়ে এই ভাবই প্রকটিত ৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণবভক্তিসাধনায় এটাও নিম্নস্তরের হলেও প্রেমই ৷ তবে, এতে ঐশ্বর্যবোধের ব্যবধান রয়েছে, ঐশ্বর্যবোধে রাগোদয়ের সঙ্কোচন হয় ৷ পদাবলীতে এই ভাবের স্বতন্ত্র স্থান নাই ৷ কিন্তু উচ্চতর স্তরের প্রেমের মধ্যে এই ভাব নিগূহিত আছে ৷ ঐশ্বর্যবোধ তিরোহিত হয় সখ্যভাবে, ভ্রাতৃভাবে বা সন্তাভাবে ভজনায় ৷ ব্রজজনের ভাব এই সখ্যভাব বা বাৎসল্যভাব ৷ কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন—
ব্রজলোকের ভাবে পাই তাঁহার চরণ,
তাঁরে ঈশ্বর করি না মানে ব্রজজন ৷
কেহ তাঁরে পুত্রজ্ঞানে উদূখলে বান্ধে,
কেহ সখাজ্ঞানে জিনি চড়ে তাঁর কান্ধে ৷
এই দুইটি ভাব পদাবলীতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে ৷ সবচেয়ে প্রশস্ত স্থান অধিকার করেছে মধুরভাব ৷ উপাস্যকে পতিভাবে নয়, দয়িতবল্লভ বা প্রেমাস্পদভাবে ভজনা করে আত্মবিস্মরণ ও আত্মসমর্পণই এই ভাব ৷ এই ভাবেরও দুইটি স্তর, একটি মোদনাখ্য— যেমন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি চন্দ্রাবলীর মনোভাব— আর একটি মাদনাখ্য, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার মনোভাব ৷ এই ভাবে ঐশ্বর্যবোধ নিশ্চিহ্নভাবে বিলুপ্ত ৷ দয়িতের সঙ্গে কোন ব্যবধানই নাই ৷ ইহাতে ‘না সো রমণ না হাম রমণী— নাসৌ রমণো নাহং রমণীতি’ ভাবই এই মহাপ্রেমের সারকথা ৷ কবিকর্ণপুর শ্রীরাধার মুখ দিয়া বলিয়েছেন—
অহং কান্তা কান্তস্ত্বমিতি তদানীং মতিরভূৎ
মনোবৃত্তির্লুপ্তা ত্বমহমপি নৌ ধীরপি হতা ৷

এই ভাবের লীলার চূড়ান্ত দেখানো হয়েছে জয়দেবের ‘দেহিপদপল্লবমুদারম্‌’ এই বাণীতে ৷
এইভাবে ভজনের নাম রাগানুগমার্গের ভজন ৷ চৈতন্যদেব এই ভাবকে জীবনে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন— তাঁর জীবনে এর সব লক্ষণগুলি প্রকট হয়েছিল ৷ এটা অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়—অন্যের পক্ষে এটাকেই চূড়ান্ত আদর্শ মনে করে সাধনপথে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে জীবনে উপলব্ধির প্রয়াসের নাম রাগানুগা ভক্তির সাধনা ৷ পদাবলীই এই ভজনের তন্ত্রমন্ত্র ৷ পদাবলীর কবিরা রাধার সখী, সহচরী বা দূতীর ভাবে আবিষ্ট হয়ে সাধনা করেছেন ৷ এই সাধনার বাঙ্ময় রূপ পদাবলী ৷
উপরে যে সকল রসের কথা বলা হল, তাদের মধ্যে শান্তরসের সাধনা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাধনার অঙ্গীভূত নয় ৷ এই সাধনা রামানুজ-সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের ৷ এই সাধনার উপাস্য দ্বিভুজ মুরলীধারী নন, চতুর্ভুজ গদাচক্রধারী বিষ্ণু ৷ বিদ্যাপতির এই ভাবের পদ আছে ৷ অন্যান্য কবিরও প্রার্থনার পদ আছে,— কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে ৷ সেগুলি শান্ত ও দাস্যভাব মিশ্রিত ৷