বৈষ্ণব কবির রূপানুরাগ প্রাকৃত প্রেমের রূপানুরাগের মত নয় ৷ যে রূপ দেখে রাধা মুগ্ধ, সে রূপ কামনাময় দেহকে-ত আশ্রয় করেনি— তা দেহকে অতিক্রম করে বিশ্বপ্রকৃতিময় ছড়িয়ে পড়েছে ৷ সে রূপ আকাশে, মেঘমালায়, বনের তমালশ্রীতে, যমুনার জলোচ্ছ্বাসে, ময়ূর-ময়ূরীর কাণ্ঠের চিক্কণতায় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করেছে ৷ শ্যামরূপের এই বিশ্বাত্মকতা বহু কবিতাতেই দেখা যায় ৷ চণ্ডীদাসের রাধা বলেন— ‘দিক্‌ নেহারিতে সব শ্যামময় দেখি ৷’
এই রূপদর্শনের অনুরাগ প্রাকৃত অনুরাগের মত নয় ৷ এই অনুরাগের বিভাবও স্বতন্ত্র ৷ এই অনুরাগের যে বেদনা তা প্রেমার্তি মাত্র নয় ৷ প্রেমার্তির বর্ণনা আমরা সংস্কৃত সাহিত্যে যথেষ্টই পড়েছি ৷ এর সঙ্গে সে সবের মিল হয় না ৷ এ বেদনার কবি কালিদাস নন, চণ্ডীদাস ৷ এই যে অনুরাগ এটা একের প্রতি অনুরাগ, কিন্তু সমগ্র সংসারের প্রতি — নিজের দেহের প্রতি— নিজের জীবনের প্রতিও বিরাগ ৷ রাধা তাই যোগিনী, মহাবৈরাগিণী ৷ এই দিক থেকে চিন্তা করলে পদাবলী শৃঙ্গার বা করুণরসেরই কাব্য নয়, শান্তরসের কাব্য— বৈরাগ্যেরই কাব্য ৷ বৈরাগ্যের কাব্য বলেই এর আধ্যাত্মিক সার্থকতা আছে ৷ বৈরাগ্যের কাব্য বলেই বৈরাগীদের দ্বারা রচিত হয়ে বৈরাগীদের উপভোগ্য হয়ে আছে ৷