যৌবনে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিতার উপর একটি কবিতা লেখেন— তার প্রথম পংক্তি ‘শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান ?’ প্রশ্নচ্ছলে তিনি আধ্যাত্মিকতাকেই বৈষ্ণব কবিতার মুখ্য উপজীব্য বলে স্বীকার করে নিয়েই একথা বলেছিলেন— প্রাকৃত প্রেমের লীলাবিলাসরূপে এর গৌণ সার্থকতাও আছে ৷
রবীন্দ্রনাথের দুইটি পংক্তি পদাবলীর রসব্যাখ্যায় মূলসূত্রস্বরূপ এবং তাঁর প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ ধরা যেতে পারে :
১৷ দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা ৷
২৷ যারে বলে ভালোবাসা তারে বলে পূজা ৷
তিনি বলেছেন, এটা ‘বড় শক্ত বুঝা ৷’ বড় শক্ত বোঝা বলেই বৈষ্ণব পদাবলীর প্রকৃত অর্থ আধুনিক পাঠক বুঝতে পারে না ৷
যে সব পাঠক ‘বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গানকে’ পাদবলীর মুখ্য উপজীব্য মনে করেন না— তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগবে— শুধু যৌবনের (বা সংসারের) তরে বৈষ্ণবের গান?—উত্তর কিন্তু একই ৷ রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে সে তত্ত্ব এযুগের পাঠকদের অতি অল্প কথায় যেভাবে বুঝিয়েছেন— সেভাবে কোন বৈষ্ণব গোস্বামী বোঝাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না ৷ ”অসীমকে সীমার মধ্যে আনিয়া ভক্ত তাহাকে উপলব্ধি করিয়াছেন ৷ আকাশ যেমন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ হইয়াও অসীম এবং আকাশই, সেইরূপ রাধাকৃষ্ণের মধ্যে পরিচ্ছিন্ন হইয়াও অসীম ব্রহ্ম ব্রহ্মই আছেন ৷ মানবমনে অসীমের সার্থকতা সীমা-বন্ধনে আসিয়া ৷ তাহার মধ্যে আসিলেই অসীম প্রেমের বস্তু হয় ৷ নতুবা প্রেমাস্বাদ সম্ভবই নয় ৷ অসীমার মধ্যে সীমাও নাই, প্রেমাও নাই ৷ সঙ্গীহারা অসীম সীমার নিবিড় সঙ্গ লাভ করিতে চায় — প্রেমের জন্য ৷ ব্রহ্মের কৃষ্ণরূপ ও রাধারূপের মধ্যে এই তত্ত্বই নিহিত ৷ অসীম ও সীমার মিলনের আনন্দই পদাবলীর রূপ ধরিয়াছে— সৃষ্টিতে সার্থক হইয়াছে ৷”
বৈষ্ণব পদাবলীকে প্রাকৃত প্রেমের বিভিন্ন স্তরের অভিব্যক্তি মনে করলেও সাহিত্যরস উপভোগ করা যে যায় না তা নয়— তবে তা অসম্যক্‌রূপে চর্ব্যমাণ হওয়ায় পরিপূর্ণ রসদান করে না ৷ রসজ্ঞ পাঠকের মন তাতেই বিশ্রান্ত হতে পারে না ৷ সব পদের না হোক, কোন কোন পদের সুর (যেমন চণ্ডীদাসের প্রধান পদের ) বাচ্যার্থ ছেড়ে দেশকাল উত্তরণ করে উঠেছে ৷ বহু পদের ভণিতাতেও লোকোত্তর ইঙ্গিত আছে একথা পূর্বেই বলেছি ৷ তার উপর আছে লীলারসাবিষ্ট কবিমানসের সৃষ্ট অপ্রাকৃত বৃন্দাবনের আবেষ্টনী ৷ কাজেই পাঠকের চিত্ত সহজেই বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে ওঠে ৷ এজন্য কোন পাঠক ব্রজলীলাকে রূপক, কোন পাঠক সিম্বল, কোন পাঠক অপূর্ণের পূর্ণতালাভের আকুল আগ্রহ (yearning for something afar from the sphere of our sorrow)প্রাকৃত প্রেমের ভাষায় অভিব্যক্ত বলে মনে করেন ৷ আবার কেউ কেউ কবিগুরুর মত বলবেন— ”অসীম সে চায় সীমার নিবিড় সঙ্গ, সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা ৷”— এই সত্যই পদাবলীতে বাণীরূপ লাভ করেছে ৷ পাঠক যাই মনে করুন— তিনি এইগুলোতে একটি লোকোত্তর ব্যঞ্জনা না খুঁজে নিশ্চিন্ত হতে পারবেন না ৷ সাহিত্য-রসবোধের পক্ষে এটাই যথেষ্ট ৷ এঁদের অনেকের মতে পদাবলী transcendental কাব্যসাহিত্য ৷ এই ধরণের সুর বর্ণিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিম্নলিখিত চরণগুলিতে—

আজো আছে বৃন্দাবন মানবের মনে ৷
শরতের পূর্ণিমায় শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে ৷
এখনো যে বাঁশী বাজে যমুনার তীরে
এখনো প্রেমের খেলা সারাদিন সারা বেলা
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়-কুটীরে ৷