বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের প্রধান চরিত্র তিনটি, রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই। এর মধ্যে জন্মখণ্ড থেকে রাধাবিরহ খণ্ড পর্যন্ত রাধা ও কৃষ্ণ চরিত্রের বিকাশ ও পরিণতিতে যে চরিত্রের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকা, সে হলো বড়াই। সমগ্র কাব্য জুড়ে যে ঘটনাগুলি ঘটে যায়, তার প্রায় সবগুলিই এই বড়াই চরিত্রের প্ররোচনায় ও পরামর্শে। এই চরিত্রের যে পরিচয় এ কাব্যে আমরা পাই, তাতে করে, তাকে প্রাচীন কামশাস্ত্রের কুট্টিনী বা দূতী শ্রেণীর মধ্যে ফেলা যায় না কিছুতেই। কেন যায় না সেটি চরিত্রটিকে নিয়ে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।

রাধার দেখাশোনার জন্য আইহনের মা বড়াইকে পদ্মার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। সে পদুমা মানে রাধার মায়ের পিসি। অনেক বয়স তার। সাদা চুল, দু’পাশে কপাল ভাঙা। ভুরুও সাদা। চোখ কোটরে বসা। গাল তোবড়ানো, নাকের মাঝখান বসে গেছে, তোবড়ানো গালের হাড় উঁচু। উটের মতো ঠোঁট, বিকট দাঁত, কাঠির মতো সরু হাত। নাভিদেশ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে দুই স্তন। কথাবার্তা তার কপটতায় ভরা। এই হলো বড়াইয়ের বাইরের আকৃতি। বড়াইয়ের চেহারার এই বর্ণনা কাব্যের শুরুতে জন্মখণ্ডেই দিয়েছেন কবি। আবার এই জন্মখণ্ডেরই শেষে একটা সংস্কৃত শ্লোক আছে। তাতে রাধা বড়াইকে ডেকে বলছেন, মধুর ব্যবহারে নিপুণা, ওগো বড়াই, তুমি যে আমার দেখাশোনা করতে এসেছ, সে আমার পরম ভাগ্য।

যে বড়াইকে কবি ‘বিকট দন্ত কপট বাণী’ বলেন, তার কুটিল গমনের কথা আলোচনা করেন; সেই একই বড়াই রাধার কাছে ‘মধুরাচারকোবিদা’। কাব্যের একদম শুরুতেই কবি যে দৃষ্টিতে বড়াইকে দেখছেন, রাধা সেই দৃষ্টিতে দেখছেন না। দুজনের দেখার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

রাধাকে সঙ্গে নিয়ে বড়াই রোজ মথুরার হাটে দই-দুধ বেচতে যায়। একদিন পথ চলতে চলতে, বনের মধ্যে বড়াই রাধাকে হারিয়ে ফেলল। নানা স্থান খুঁজে নাতনিকে না পেয়ে, বড়াই বড়ই ব্যাকুল হলো। এই বনেই তখন গোরু চড়াচ্ছিলেন তার নাতি, কৃষ্ণ। রাধার বর্ণনা দিয়ে বড়াই কাহ্ণকে বলে তার নাতনিকে খুঁজে দিতে। কৃষ্ণ সন্ধান বলে দিতে সম্মত হন। কিন্তু তার বদলে কৃষ্ণ বড়াইকে তার প্রেম প্রস্তাব নিয়ে রাধার কাছে যেতে বলেন। বাড়াইও সেই মুহূর্তে রাধাকে ফিরে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণের সব রকম প্রস্তাবেই রাজি হয়ে যায়। কৃষ্ণ তখন বড়াইকে রাধার সন্ধান বলে দেন। আর বড়াই ‘ফুলতাম্বুলসহ’ কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব নিয়ে রাধার কাছে যায়।

বড়াইয়ের এই আচরণ লঘু বা কপট বা নিতান্তই মজা করা বলে মনে হতে পারে। তবে

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, বড়াই কিন্তু এমনি এমনি এই দুই কিশোর-কিশোরীর মিলন ঘটানোর দায়িত্ব নেয়নি। সে জানে, কৃষ্ণ শুধুমাত্র তার নাতি, নিছক এক রাখাল বালক নন। কৃষ্ণ ‘দেব সংসারের সার’; তাঁকে স্মরণ করলে পাপমুক্তি, তাঁর সঙ্গ করলে বিষ্ণুপুরে স্থিতি। কৃষ্ণের এই স্বরূপ জেনেই বড়াই রাধাকে কৃষ্ণের পাঠানো উপহার গ্রহণ করে কৃষ্ণের প্রেম স্বীকার করে নিতে পরামর্শ দেয়। রাধা এদিকে কৃষ্ণের স্বরূপ বা বড়াইয়ের সদুদ্দেশ্য কিছুই না বুঝে তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। কৃষ্ণের পাঠানো পানপাত্র পা দিয়ে দলে ফেলে দিলেন। বড়াই রাধার ভালো চেয়েই রাধাকে এই পরামর্শ দিয়েছিল। রাধার এমন আচরণে সে ক্ষুব্ধ হলো। অপমানে ক্ষিপ্ত বড়াই কৃষ্ণের কাছে গিয়ে সব কথা সব কথা খুলে বলল এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পেড়াপীড়ি করতে লাগল।

আগেই বলেছি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অধিকাংশ ঘটনাই বড়াইয়ের পরামর্শ- প্ররোচনায় ঘটেছে। এবার কদমের তলে বসে দানের অছিলায় আইহন-পত্নী রাধার দেহসম্ভোগ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলো কৃষ্ণ। এ বিষয়ে সে বড়াইয়ের সাহয্য চায়। বড়াই কৌশলে রাধাকে রাজি করালেন আবার মথুরায় যেতে। কিন্তু শুধু রাধার মত হলেই তো হবে না, শাশুড়ির মতও তো চাই। সে ব্যবস্থাও করলো বড়াই। তারপর একদিন রাধাকে সঙ্গে নিয়ে বড়াই রওনা দিলো মথুরার পানে। কবি এখানে বড়াইয়ের চরিত্র ও প্রকৃতিকে খুব সঠিকভাবেই ‘ঠেন্ঠালি’ অর্থাৎ চতুর, কুটিল ও কৌশলী বলে বর্ণনা করেছেন। বনের পথে যেতে যেতে হঠাৎ বড়াই অন্য পথে সরে গেল। সেই সুযোগে কৃষ্ণ রাধার রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন। চেয়ে বসলেন মহাদান। ঘটল মিলন (বলপূর্বক?)। দানখণ্ডে বড়াইয়ের সাহায্যেই কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলিত হতে পারলেন। এদিকে কৃষ্ণকে আত্মদান করে ঘৃণায়, অপমানে, ক্ষোভে দীর্ণ হয়ে রাধা কিন্তু এই বড়াইয়ের কাছেই কৃষ্ণের এই ‘অত্যাচার’এর কথা জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

এরপর নৌকাখণ্ড। এই নৌকাখণ্ডের ঘটনা পুরোটাই বড়াইয়ের পরিকল্পনা। দীর্ঘদিন রাধার অদর্শনে কৃষ্ণের মন উচাটন। একদিকে লাঞ্ছিতা রাধা ঘরের বাইরে পা রাখতে চান না। অন্যদিকে কৃষ্ণও রাধাকে না দেখে আর থাকতে পারেননা। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণকে সাহায্য করার জন্য বড়াই আবার সক্রিয় হলো। কপটপটু বড়াইবুড়ি মথুরায় যাওয়ার জন্য রাধাকে নানাভাবে উৎসাহ দিতে লাগলো। রাধা জানালেন, শাশুড়ি মানা করেছেন তাঁকে ঘরের বাইরে যেতে। বড়াই এবার নানা অনুরোধ উপরোধে রাধার শাশুড়ির মন ভিজিয়ে তাঁর অনুমতি আদায় করলো। এবং সেই দুধ-দই বেচার ছুতো করেই রাধাকে নিয়ে মথুরায় যাওয়ার ছলে কৃষ্ণের হাতে রাধাকে তুলে দিলো বড়াই। এবার কিন্তু কৃষ্ণের আচরণের সব কথা রাধা আর বড়াইকে বললেন না।

সমস্ত কাব্য জুড়ে দেখি কৃষ্ণ বারবার রাধাকে পাওয়ার জন্য বড়াইয়ের সাহায্য ও পরামর্শ চেয়েছেন, আর বড়াইও নিজের মতো করে কৃষ্ণকে উপদেশ দিয়েছে বা পথ দেখানোর চেষ্টা করেছে। তাই ছত্রখণ্ডে বড়াই কৃষ্ণকে বোঝায়, রাধার মাথায় ছাতা ধরলে কৃষ্ণের ক্ষতি তো কিছু নেইই, বরঞ্চ লাভই হবে। কেননা এর ঠিক আগেই ভারখণ্ডে রাধা কৃষ্ণকে দিয়ে দধিভার বওয়ানোয় কংসারির মানে লেগেছিল। ছত্রখণ্ডে বড়াই কৃষ্ণকে বুঝিয়ে বলে, লোকলজ্জার পরোয়া করলে কিন্তু রতিঅনুমতি পাওয়া যাবে না।

বস্ত্রহরণখণ্ডে দেখি কৃষ্ণ জলক্রীড়া করার সময় জলের তলায় লুকিয়ে পড়েন। রাধা আর তাঁর সখীদের নিয়ে বড়াই কৃষ্ণের সন্ধান করতে থাকেন। সেদিন রাত গভীর হয়ে গেলে আবার পরদিন সকালেও তাদের নিয়ে কৃষ্ণকে খুঁজতে আসে সে।

বাণখণ্ডে বড়াই চরিত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসে। এখানে কৃষ্ণ রাধাকে পুষ্পবাণে আহত করে বড়াইয়ের পরামর্শে ও সম্মতিতেই। তবুও রাধা মূর্ছিতা হয়ে পড়লে বড়াই অবিবেচকের মতো কাজ করার জন্য কৃষ্ণকে তিরস্কার ও শাপশাপান্ত করতে থাকে। এত দিন পর্যন্ত বড়াই কৃষ্ণকেই তার সমস্ত কাজে সাহায্য করে এসেছে। কিন্তু আজ কৃষ্ণের শরের আঘাতে মূর্ছিতা রাধাকে দেখে বড়াই কৃষ্ণের ওপর খুব রেগে যায়। বড়াইয়ের অভিশাপ ও তিরস্কারে ভয় পেয়ে কৃষ্ণ নানা ভাবে চেষ্টা করে রাধার চেতনা ফিরিয়ে আনেন। এরপর বৃন্দাবনকুঞ্জে সযতনে রচিত হয় নবকিশলয়শয্যা। সেখানে রাধা-মাধবকে শুইয়ে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বড়াই।

বংশীখণ্ড আর রাধাবিরহখণ্ডে বড়াইয়ের পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়। বিরহব্যাকুল রাধার কাছে কৃষ্ণকে ফিরিয়ে আনার জন্য এই সময় থেকে বড়াই চেষ্টার ত্রুটি করে না। দানখণ্ডে যে বড়াই ছলনা করে মাঝবৃন্দাবনে কৃষ্ণের হাতে রাধাকে তুলে দিয়েছিল, বংশীখণ্ডে দেখি ঠিক তার উল্টো ছবি। বিরহব্যাকুলা রাধার কাছে কৃষ্ণকে ফেরানোর জন্য এই বড়াইই কদমতলায় নিন্দাউলি মন্ত্রে কৃষ্ণকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আর তারই পরামর্শে রাধা তখন কৃষ্ণের বাঁশী চুরি করেন। বাঁশী ফেরত পাওয়ার শর্ত হিসেবে রাধা আর ষোলশ’ গোপিনীর কাছে কৃষ্ণকে হাতজোড় করিয়ে ছাড়ে বড়াই। এরপর রাধাও বড়াইয়ের পরামর্শে কৃষ্ণকে তাঁর বাঁশীটি ফিরিয়ে দেন।

রাধাবিরহখণ্ডে বড়াই বলহীন দেহ, চলতে অক্ষম। তবুও রাধার বিরহযন্ত্রণায় সেও কাতর। অশক্ত শরীর নিয়েও সে কৃষ্ণের কাছে ছুটে গিয়ে বিরহকাতরা রাধার যন্ত্রণার কথা জানায়। বহুবার কৃষ্ণকে মথুরা না যাওয়ার জন্য কাতর মিনতি করতে থাকে বড়াই।

সমস্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়া শেষ হলে দেখা যায়, কাব্যটির ব্যস্ততম চরিত্র হলো বড়াই। জন্মখণ্ডে এই বড়াইকে যে কবি ‘কুটিল’ বা কপটকুশলা বলেছেন, এই কপটতা নেহাৎই তার বাইরের রূপ। তার এই কপটতা আগাগোড়াই রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটানোর জন্য। প্রথম থেকে নৌকাখণ্ড পর্যন্ত অত্যন্ত প্রকটভাবে বড়াই এই কপটতার আশ্রয় নিয়েছে কৃষ্ণের জন্য। কিন্তু তার পর থেকেই বড়াইয়ের চরিত্রে একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সমস্ত কপটতার সঙ্গে স্নেহ-মমতা মিশে গিয়ে চরিত্রটিকে এক মানবিক উত্তরণে সমৃদ্ধ করেছে। রাধার যন্ত্রণা তাকেও কষ্ট দিয়েছে। তখন সে প্রয়োজনে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছে, তিরস্কার করেছে, রাধার দূতিয়ালি করেছে। তখনও তার উদ্দেশ্য সেই রাধাকৃষ্ণের মিলনই। তাই বড়ু চণ্ডীদাস কাব্য রচনার সূচনায় বড়াইকে কুট্টিনী চরিত্ররূপে আঁকতে শুরু করলেও ঘটনার পরম্পরা শেষ পর্যন্ত তাকে স্নেহ-প্রীতি-মমত্ব ভরা এক মানবিক চরিত্র হিসেবে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। আর এইখানেই বড়াই চরিত্র ও তার সৃষ্টিকর্তা একই সঙ্গে সার্থকতা লাভ করে রসসিদ্ধ হয়।