বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তন নদীমাতৃকা সুজলা সুফলা বাংলাদেশের হৃদয় তন্ত্রীর সাথে ওতপ্রোতভাব জড়িত৷ বাংলার পদাবলীকীর্তন বাঙালী জাতির রসভাবসম্পৃক্ত হৃদয়াবেগ ও নিবিড় অন্তরানুভূতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। রসভাবসমৃদ্ধ ব্রজবুলিভাষা যেদিন বাংলার বৈষ্ণব-পদাবলীসাহিত্যের সবল সাবলীল বহিরাবরণ বা অলঙ্করণ সৃষ্টি করে ভাববিদগ্ধ প্রেরণা বৃহত্তর বাংলার জনগণের অন্তরে সচল প্রবাহ এনে দিয়েছিল, শাস্ত্রীয় রাগ, তাল ও বিচিত্র ছন্দের সম্ভার নিয়ে পরমনায়ক ও পরমনায়িকা শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার অপার্থিব মধুর চরিত্র বাঙালীজাতির চিত্তকে যেদিন মথিত ও উদ্বেলিত করেছিল ও বাংলার প্রেমের অবতার সর্বভাবঘনমূর্তি শ্রীচৈতন্যের নামকীর্তন বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবণিতার মনকে যেদিন রসাস্বাদনে নিবিষ্ট করে ধূলিধূসরিত পৃথিবীর বহুঊর্ধে শাশ্বত আনন্দলোকে বিধৃত করেছিল, ঠিক সেদিন হতেই স্বর্গীয় পদাবলীকীর্তনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল সাহিত্য ও সঙ্গীতরসপিয়াসী বাঙালীজাতির অন্তররাজ্যে ও দিব্যভাবের সাধনা ও লীলাক্ষেত্র রচিত হয়েছিল এই বাংলাদেশের শ্যামল বক্ষে৷ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার বিচিত্র আখ্যান ও প্রেমলীলার কাহিনী খ্রীষ্টীয় শতকের সূচনা থেকেই প্রাকৃত লৌকিক সাহিত্য ও সঙ্গীতের সামগ্রীকে নিয়ে দক্ষিণ দেশের আল্‌বার বা আড্‌বার বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের ও পশ্চিম-বাংলার স্থানে স্থানে ভক্তিভাবসম্পৃক্ত অনুন্নত ও অশিক্ষিত বাঙালীজাতির সমাজেও যে বিকাশলাভ করেছিল তার প্রমাণের অভাব নেই৷
শ্রদ্ধেয় শ্রীযতীন্দ্র রামানুজদাস ‘আড্‌বার’ ও ‘সহস্রপদাবলী’ গ্রন্থে সংগৃহীত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক ডক্টর শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্যকর্তৃক রচিত সুবৃহৎ ‘বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত-রত্নাকর’-গ্রন্থে সংকলিত গানগুলির মধ্যে সময় বা রচনাকালের যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশে অভিজাত রাগ ও তাল-সমন্বিত গান যে বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের সৃষ্টি ও বিকাশের বহুপূর্বেই বর্তমান ছিল তা আধুনিক ঐতিহাসিক গবেষকদের অনুসারে খ্রীষ্টীয় ১ম থেকে ৫ম শতকে দক্ষিণদেশীয় আড়্‌বার-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি-‘দিব্যপ্রবন্ধ’ এবং পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁশপাহাড়ী,মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি স্থানে সংগৃহীত ঝুমুরগানগুলির গঠনশৈলী ও প্রকশভঙ্গী লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়৷ ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের দানস্বরূপ ‘লোকসঙ্গীত-রত্নাকর’-গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে উদ্ধৃত করে বলি : ”কালক্রমে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর লৌকিক ধারাটি বৈষ্ণব-পদাবলী দ্বারাও প্রভাবিত হইয়াছে, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বৈষ্ণব পদাবলীর ধারার মধ্যে ইহা সম্পূর্ণ বিলীন হইয়া যাইতে পারে নাই (নিবেদন)৷” ”লৌকিক প্রেমসঙ্গীত একদিন প্রচলিত ছিল, তাহাতে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব বিস্তারিত হইবার ফলে রাধাকৃষ্ণের নাম গিয়া প্রবেশ করিয়াছিল৷” ”মহাজন-পদাবলী রচনার অনুকরণে এক শ্রেণীর লৌকিক পদাবলী রচিত হইয়াছিল, তাহাও ঝুমুর নামেই সাধারণভাবে পরিচিত ছিল৷ আদিবাসীর সঙ্গীতের নাম ঝুমুর৷ কিন্তু রাধাকৃষ্ণের বিষয়ক লৌকিক পদাবলীর সঙ্গে আদিবাসীর ঝুমুর অন্তর ও বহিমুর্খী নানা পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তাহা ঝুমুর বলিয়াই পরিচয় লাভ করিল৷ ক্রমে দেখিতে পাওয়া গেল, বৈষ্ণব-মহাজন-পদাবলী রচনার যে একটি বিশিষ্ট রীতি গড়িয়া উঠিয়াছিল, ইহাতেও বাহিরের দিক হইতে সেই রীতিকে অনুসরণ করা হইতেছে৷” ”এই ভাবে এই অঞ্চলে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক এক নূতন পদাবলী-সাহিত্য গড়িয়া উঠিল৷” ”ইহা বৈষ্ণব-পদাবলীর যথার্থ উত্তরাধিকারী নহে * * বৈষ্ণব-পদাবলীতে যে ব্রজবুলিভাষা ব্যবহৃত হইয়াছে, ইহাতে তাহা ব্যবহৃত হয় নাই * * ৷” পরিশেষে ডক্টর ভট্টাচার্য লিখেছেন ঃ ”কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে, বৈষ্ণব-রসশাস্ত্র অনুযায়ী ইহা রচিত হয় নাই, সুতরাং গৌরচন্দ্রিকা , পূর্বরাগ, অনুরাগ বলিতে বৈষ্ণব-রসশাস্ত্র যাহা বুঝিয়াছে, ইহাতে তাহার সন্ধান পাওয়া যাইবে না৷”
কিন্তু সে যাই হোক, বাঁশপাহাড়ী (মেদিনীপুর) থেকে সংগৃহীত ‘গৌরচন্দ্রিকায়’—
”এসো গৌর হে, গৌর হে, গৌর হে,
তোমার ভাই নিতাইকে
সঙ্গে লয়ে একবার এসো হে ৷”
ইত্যাদি গানেরও উল্লেখ পাওয়া যায়৷ তাছাড়া ‘বংশীখণ্ড’, ‘শ্রীরাধার পূর্বরাগ’, ‘শ্রীরাধার অনুরাগ’ ‘বাসকসজ্জা’, ‘খণ্ডিতা’ শীর্ষক ঝুমুরগানেরও উল্লেখ দেখা যায়৷ ঠিক সেভাবেই শ্রদ্ধেয় শ্রীযতীন্দ্র রামানুজদাস দক্ষিণ দেশীয় (south Indian) বৈষ্ণব-সাধকসম্প্রদায়’ আড্‌বার’-দের গানযুক্ত ‘সহস্র-পদাবলী’ নামে যে সংগ্রহগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তার পরিশেষেও ‘অভিসারোৎকণ্ঠা’, ‘অভিসারিকা’, ‘মান’, ‘কলহান্তরিতা’, ‘গোষ্ঠকালীন বিরহ’ প্রভৃতি পালাগান এবং মায়ূর, বরাড়ি, বিহগ্‌ড়া, বেহাগ, মল্লার প্রভৃতি শাস্ত্রীয় রাগ এবং ডাঁসপেডে, জপতাল, কাটাদশকুশী, একতাল, ছুটা প্রভৃতি শাস্ত্রীয় কীর্তনাঙ্গ তালের সমাবেশ দেখা যায়৷ অবশ্য এ’ধরনের রাগ ও তাল-সমাবেশের পূর্বাপরসম্পর্ক উভয় গীতশ্রেণীর (বাংলার বৈষ্ণব পদাবলী ও দক্ষিণদেশীয় আড্‌বারদের ভক্তিপদাবলীর) মধ্যে কতটুকু ও কীভাবে আছে তা নির্ণয়সাপেক্ষ৷ তবে সকল বাদানুবাদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ছেড়ে দিলেও উভয় দেশের শ্রীকৃষ্ণলীলাকাহিনীর মধ্যে ভাব, রস ও মাধুর্য-উপলব্ধির নিদর্শনের অভাব নাই৷ বর্তমান ‘পদাবলীকীর্তনের ইতিহাস’-গ্রন্থে ঐ সকল-কিছুর সমাবেশ থাকবে তুলনামূলক আলোচনার শৈলী অনুসরণ করে৷
পরিশেষে একথা সত্য যে, বাংলার বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তন কেবলই রসমাধুর্যপূর্ণ ছন্দায়িত রাগ ও তালের এবং সঙ্গে সঙ্গে কীর্তনগানের সামগ্রীক আঙ্গিকের সমাবেশপূর্ণ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার অপার্থিব প্রেমলীলা ও প্রেমাস্বাদনের রূপায়ণই সব-কিছু নয়, পরন্তু এই পদকীর্তন সাহিত্য, ছন্দ, রাগ, তাল, রস ও ভাবসম্পদের সমাবেশের সঙ্গে গৌড়ীয় মহাজন ও বৈষ্ণবাচার্যগণের রচিত গান বা কীর্তন যে অধ্যাত্মসাধনা ও রসানুভূতির অপূর্ব অবদান একথা স্বীকার করতেই হবে৷ সেজন্য কীর্তনপদাবলীর অপার্থিব নায়ক-নায়িকা শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার বিচিত্র লীলাচরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সেই লীলাচরিত্রকে সাধক-হৃদয়ের নিবিড় অন্তরানুভূতি দিয়ে গ্রহণ করতে হবে, সুতরাং গ্রহণ করার কাহিনীকেও গৌড়ীয় বৈষ্ণবপ্রেমসাধনা ও বৈষ্ণবদর্শনতত্ত্বের মধ্য দিয়ে পদাবলীর ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পরিস্ফুট করার সার্থকতা অবশ্যই থাকবে৷ মোটকথা বাংলার বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের রস ও ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গে বৈষ্ণবসাধক মরমিয়া মহাজনগণের ও পদকর্তাদের প্রেমনিবিড় জীবনানুভূতির দিব্যস্পর্শই পদাবলীকীর্তনের ইতিহাসকে সার্থক করে তুলবে, কেননা পরমরসস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ-ভগবানেরই নিবিড়ানুভূতির প্রতিচ্ছায়া বা প্রতিধ্বনিমাত্র এই পদাবলীকীর্তন৷ সকল আঙ্গিক, সাহিত্য, লীলাকাহিনী এবং রাগ ও তালের সমাবেশ ইহবাহ্য, প্রেমানুভূতি ও কীর্তনের রসানুভূতিই পদাবলীকীর্তনের প্রাণকেন্দ্র ও ইহসর্বস্ব, সুতরাং কীর্তনের ইতিহাসের পাতায় সে সকল সাক্ষ্যই বাংলার সরস ও প্রেমনিবিড় মরমী অন্তরের পরিচয় দান করবে৷