শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণেভ্য নমঃ।
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ইত্যাদি শ্লোক।
প্রথমে বন্দিব গুরু গোবিন্দ চরণ।
কৃপা করি জ্ঞান অঞ্জন দিলা যেই জন।।
হেন (সব সেবনেতে) ভেদ না রাখিল।
জাতি কুল প্রাণধন সব নিবেদিল।।
শ্রীগুরুচরণে যার ভক্তি না জন্মিল।
সেই অপরাধী লোক তোমারে কহিল।।
কৃষ্ণসেবা হইতে ভাই গুরুসেবা মূল ।
সেবা বিনু কোন বস্তু নহে সমতুল।।
আর এক নিবেদন শুন ভক্তগণ।
সব নিবেদিনু ইবে (তোমার চরণ।।)
(সাদৃশ আদৃশ) আর যত ভক্তগণ।
একবারে বন্দো মুঞি সবার চরণ।।
মুঞি হীন মূঢ়মতি বন্দনা কি জানি।
গুরুকৃষ্ণ কৃপা করি যে কহায় বাণী।।
শুন শুন সর্ব্বলোক হয়্যা একমন।
(কি ভাব করিবে) পাই শ্রীকৃষ্ণ চরণ।।
তথাহি —
সর্ব্ব স্বামী পরে কৃষ্ণঃ কৃষ্ণ স্বামী পরে গুরু।
গুরু স্বামী পতিব্রতা ভজনং দৃঢ় নিশ্চয়ং যথা।।
অস্যার্থ —
গুরুকে করিঞা কৃষ্ণ করহ ভজন।
তবে সে পাইবে ব্রজে ব্রজেন্দ্র নন্দন।।

গুরুসেবা ছাড়ি যেবা অন্য দেবে পূজে।
বিধাতার ভালে যেন সিন্দুর না সাজে।।
গুরুসেবা ছাড়ি কৃষ্ণে ভজে যেই নরে।
নিজ স্বামী ছাড়ি কেন অন্য স্বামী করে।।
গুরুসেবা হইতে ভাই কৃষ্ণ সেবা হয়।
গুরু তুষ্টে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিহ নিশ্চয়।।
যেই জন গুরুদেব দৃঢ় করি জানে।
জগত নিছনি দিব তাহার চরণে।।
মুঞি মূঢ়মতি গুরুসেবা না জানিনু ।
সংসার বিষয় রসে ডুবিয়া রহিনু।।
গুরুদেবে ভক্তি করি ভজ কৃষ্ণ রাধা।
সংসার তরিবে কোন কালে নাহি বাধা।
সংসার আপদ বড় শুন সর্বজন।
তৎকাল করিয়া কর শ্রীকৃষ্ণ সাধন।।
তথাহি —
জীবনং কৃষ্ণ ভজস্য বরং পঞ্চদিনানি চ।
ন চ কল্প সহস্রানি ভক্তিহীনঞ্চ কেশব।।
অস্যার্থ —
শত বৎসব জিয়ে যদি কৃষ্ণ সেবা নাহি জানে।
সে জন জীয়ন্তে মরা শাস্ত্রের বিধানে।।
পঞ্চরাত্রি জিয়ে যদি কৃষ্ণ সেবা করে।
ভাগ্যবান বলি তারে সংসার ভিতরে।।
নানাদেবে সেবা করে কৃষ্ণে নাঞি রতি।
নিশ্চয় জানিহ সেই পাপিষ্ঠ মূঢ়মতি।।
নানা আভরণ যদি অঙ্গেতে পরয়ে।
বস্ত্র নাহি পরে যেন উপহাস্য হয়ে।।

এই নিবেদন করি কর অবধান।
সেবনে পাইলা (লক্ষ্মী) দেখ বিদ্যমান।।
একদিন নিত্যানন্দ চৈতন্যের সনে।
দুইজনে গিয়্যা তথা বসিল নির্জনে।।
নিত্যানন্দ বলে ভাই শুন দ্বিজমণি।
কেমনে তরিবে জীব কহ দেখি শুনি।।
কলিযুগে কোন সর্পে জীবে গরাসিল।
সবংশ সহিত জীব বন্ধনে পড়িল।।
গুরু কৃষ্ণ সেবা নাহি করে মন দিয়া।
সতত রহিল জীব সংসারে পড়িয়া।।
মোর মোর করিয়া সংসার মায়া ঘোরে ।
মরিলে সে যম লৈয়্যা পরাভব করে।।
তিলেক না করে জীব কৃষ্ণের সাধন।
চৈতন্য বলেন ভাই শুনহ কারণ।।
যেমতে হইবে ভাই সংসার তারণ।
তাহার বৃত্তান্ত কিছু কহিয়ে কারণ।
তথাহি —
অদীক্ষা পুরুষ যস্য মালা কণ্ঠে ধারয়েৎ।
গুরুমন্ত্র ন জানন্তি নরকে যান্তি মনেশ্বরং।।
অস্যার্থ–
সংসারে জন্মিয়া জীব গুরু ত করিবে।
শ্রীগুরু করিয়া সেই মন্ত্র শেখাইবে।।

সেই জীব করে যদি কৃষ্ণের সাধন।
শ্রীগুরু চরণে মন রাখ অনুক্ষণ।।
কৃষ্ণ সেবা করে গুরু সেবা নাঞি করে ।
কখন না তরে সেই সংসার ভিতরে।।
বৈষ্ণব গুরু কৃষ্ণ নিন্দা না করিবে।
নিন্দা করিলে জীব নরকে পড়িবে।।
তথাহি —
গুরুপাদোদক নির্ম্মাল্য যো নরা ন ভক্ষয়েত।
কোটি কল্প সহ ভক্তি (… … …) ।।
অস্যার্থ–
শ্রীগুরুচরণামৃত নিত্য কর পান।
অধরামৃত খাঞা কৃষ্ণের ধ্যান।।
এমন একান্ত ভাব যার রহে মনে।
প্রেম ভক্তি পায় সেই কৃষ্ণের চরণে।।
গুরু বিনে কৃষ্ণ ভক্তি কভু নাহি হয়।
শুন শুন নিত্যানন্দ কহিলা তোমায়।।
নিত্যানন্দ বলে প্রভু সত্য ইহ বানি।
জীবের নিস্তার হেতু কহ দেখি শুনি।।
এ সব দৃষ্টান্ত যদি জীবে না মানিবে।
আপনার দোষে সে পরাভব পাবে।।
কেনে যায় ওরে ভাই সংসার বন্ধনে।
হেন প্রভু নাঞি ভজ কিসের কারণে।।*
*ইহার পর অতিরিক্ত–
(ধনজন পুত্র দারা ইহ কিছু নয়।
মরণ কালেতে কেহ রক্ষা না করয়।।
রক্ষা করে কৃষ্ণচন্দ্র জীবনে মরণে।
হেন প্রভু নাহি ভজ কিসের কারণে।।)

একজন যদি কৃষ্ণ ভজিবারে চায়।
সংসারের লোকে তারে টানিঞা ফেলায়।।
বলে ওরে ওরে ভাই না কর সাধন।
দেবের উচ্ছিষ্ট সেহ না কর‍্য ভক্ষণ।।
দেবের উচ্ছিষ্ট খায়্যা সুখেতে থাকিবে ।
ইহাত করিলে কূপে পড়ে অন্ত কালে ।।
বৈষ্ণবের সঙ্গ হইলে অঙ্কুর বাড়য়।
সাংসারিক লোক তারে টানিয়া ফেলায়।।
পূর্ব জন্মে যদি তার পিপাসা থাকয়।
সেই (…) জনার তবে উদয় করায়।।
জন্ম জন্মান্তরে যার না থাকে বাসনা।
কখন না পারে সে করিতে সাধনা।।
তথাহি —
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় শূদ্র বৈশ্য চারিবর্ণ।
কৃষ্ণ ভক্তি সম্বন্ধে ন(…)।।
যেই জন কৃষ্ণ ভজে কি দিব তুলনা।
ব্রহ্মাদি দেবগণ দিতে নারে সীমা।।
তাহরে করিল রক্ষা প্রভু কৃষ্ণচন্দ্র।
সংসারে বিহরে সেই হইয়া আনন্দ।।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় যদি করয়ে পীড়ন।
কৃষ্ণকথা শুনে তার স্থির নহে মন।।
যত কথা কহে সেই কৃষ্ণের প্রসঙ্গ।
কহিতে কহিতে সে পুলক হয় অঙ্গ।।
রসিক যে জন তার কৃষ্ণকথায় মন।
সংসারী অজ্ঞান লোক না করে সাধন।।
অন্য কথায় মন দিয়া থাকে অনুক্ষণ।
শূকর কুকুর যেন করয়ে ভক্ষণ।।

তথাহি । সুরদাস কি বাক্যং —
সাকটজনা দুহুঁরি ভক্তি নাহি কৃষ্ণকথায় স্বহায়।
মেখিকো চন্দন নাহিঁ জাহাঁ … তাহাঁ ধায়।।
অস্যার্থ —
বৈষ্ণব জন যদি কহে কৃষ্ণকথা।
অন্য কথা প্রসঙ্গেতে তাহে দেই ব্যথা।।
সেজনার কি হব শুন সর্ব্ব জন।
অমৃত ছাড়িয়া বিষ করয়ে ভক্ষণ।।
মন দিয়া কর সবে কৃষ্ণের সাধন।
দুর্লভ মনুষ্য জন্ম না হবে এমন।।
তথাহি —
নলিনী দলগত জলবৎ তরলম্‌ তদ্বৎ জীবনমতিশয় চপলম্‌ ইত্যাদি
চিরকাল নহে ভাই মনুষ্য সকল।
টলমল করে যেন পদ্ম পত্রের জল।।
এমন মনুষ্য (খেনে কে ভুরুভঙ্গ)।।
মন দিয়া শুন তবে কৃষ্ণের প্রসঙ্গ।।
রসিক জনের সঙ্গ কর অনুক্ষণ।
সমর্পণ কর যদি কুল প্রাণ ধন।।
অবিশ্বাস না করিহ শুনহ সর্ব্বথা।
ঠাকুর বৈষ্ণব তবে যে কহেন কথা।
বৈষ্ণব গোস্বামী আজ্ঞা হয় বলবান।
পাষণ্ড যে জন সেহ আজ্ঞা করে আন।।*
*ইহার পর অতিরিক্ত–
(বৈষ্ণব গুরু কৃষ্ণ এক দেহ হয়।
অধম যে জন সেই দুই বিচারয়।।
বৈষ্ণব বিমুখ হৈলে কৃষ্ণেতে বঞ্চিত।
সংসার বিমুখ তারে বিধি বিড়ম্বিত।।)
তথাহি —
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বদনস্য অন্যদেবমুপাশ্রিতা ।
বিপচারি মমাং গঙ্গোদকে সুরা যথা।।
এক কলসীতে যদি থাকে গঙ্গাজল।
একবিন্দু সুরাস্পর্শে নষ্ট (ত) সকল ।।
তিলে আধ না করিহ পাষণ্ডের সঙ্গ।
যে কিছু ভক্তি থাকে সব করে ভঙ্গ।।
রসিকের সঙ্গ হইলে আনন্দ বাড়য়।
সুবর্ণ দাহনে যেন মলা করে ক্ষয়।।
বৈষ্ণব পরশে ইহা সর্ব্ব শাস্ত্রে কয়।
স্পর্শমণির স্পর্শে যৈছে লৌহ স্বর্ণ হয়।।
ইহা বুঝি করে যেই রসিকের সঙ্গ।
দিনে দিনে বাড়ে তার প্রেমের তরঙ্গ।।
সে জন কৃষ্ণের দাস জানিহ নিশ্চয়।
রাধাকৃষ্ণ দুইজন করুণা করয়।।
তাহারে আপন করি দেন পদচিহ্ন।
সখীর সঙ্গিনী হয়্যা থাকে সর্ব্বক্ষণ।।
মুঞি মূঢ়মতি হেলাতে হারাইনু।
মিছা মায়াবন্ধে পড়ি জন্ম গুঙাইনু।।
সতত হইল মোর পাষণ্ডের সঙ্গ।
যে কিছু ভক্তি ছিল সব হইল ভঙ্গ।।
মো বড় অধম মোরে দয়া কর গুরু।
পুরাণে শুন্যাছি নাম বাঞ্ছাকল্পতরু।।
রাখ রাখ মহাপ্রভু জোড় করি হাত।
লক্ষ লক্ষ তোমার চরণে প্রণিপাত।।
যদি করোঁ অপরাধ আমি সে অজ্ঞান ।
তুমি মোর জাতি কুল তুমি মোর প্রাণ।।
সব নিবেদিনু ইবে তোমার চরণে।
সত্য সত্য ইহ বাক্য তোমার চরণে।।
তুমি মোর ধাতা কর্তা শাস্ত্রের বচন।
তোমার চরণ বিনে অন্য নাহি মনে।।
সর্ব্ব শাস্ত্রে শুনি তুমি পতিত পাবন।
মো সম পতিত প্রভু নাহিক ভুবন।।
যদি না করিবে দয়া পতিত দেখিয়া।
পতিতপাবন বলাইবে কেমন করিয়া।।
বিদ্যা শাস্ত্র নাঞি জানি (মন্ত্র মুল হিন)।
(সেবা) সাধন নাহিঁ সংসারের দিন।।
আপনার দোষে প্রভু (ডুবিলাম) জলে।
না জানি সাঁতার প্রভু রাখ লইয়া কূলে।।
বহুত অসার মুঞি করহ তারণ।
আমারে তারিলে প্রভু না হবে দোষণ।।
মোর অপরাধ যত শুন সর্বজন ।
জন্মাবধি লেখি যদি না যায় লিখন।।
সংক্ষেপ করিয়া কিছু করিনু বিচার।
সংসারের মধ্যে বুঝি মোর নাহি পার।।
পাতকের ভরে আমি উঠিতে না পারি।
কৃপা করি মোরে পার কর গৌরহরি।
(দু)কর যুড়িয়া কহি শুন সাধুজন।
আমার যতেক পাপ করিনু নিবেদন।।
পায় পায় অপরাধ মোরে কর ক্ষেমা।
দীন হীন মুঞি কিছূ না জানি মহিমা।।
মোরে কৃপা করহ রসিক ভক্তগণ।
আর কৃপা কর মোরে রূপ সনাতন।।
গোপাল ভট্ট রঘুনাথ দাস দুইজন।
কেবল ভরসা (মোর) তোমার চরণ।।
রঘুনাথ ভট্ট (আর) কৃষ্ণদাস কবিরাজ।
শ্রীজীব গোসাঞি রাখ হৃদয়ের মাঝ।।
লোকনাথ গোসাঞির চরণ কমল।
জীবনে মরণে মোর ভরসা কেবল।।
হৃদে মুঞি রাখি সদা জীবনে মরণে।
তুহুঁ পাদপদ্ম ভজন জনমে জনমে।।
তোমা সভা কৃপা কর সদয় হইলা।
জীবনে মরণে যাঙ নিছিয়া নিছিয়া।।
তোমা সবার কৃপা দৃষ্টে করিনু বিচার।
যে কহিলে তাহা লিখি করুণা তোমার।।
শুদ্ধ অশুদ্ধ যেই না জানি মেলানি।
লাজ বিজ খায়্যা তবু করি টানাটানি।।
নিবেদন করি এই চরণ কমলে ।
যে কিছু লিখন হইল রূপের কৃপা বলে।
শ্রীআচার্য পদতলে করি অভিলাষ ।
যে কিছু কহিল এই বালকের ভাষ।।
দোষ না লইবে সবে মোর নমস্কার।
তোমার কৃপাবলে লেখি ভরসা তোমার।।
জানি বা না জানি তবু লিখি কৃষ্ণ নাম।
নিত্য যেই শুনে ইহা সেই ভাগ্যবান।।
যেই জন শুনে ইহা বিশ্বাস করিয়া।
তারে কৃষ্ণ কৃপা করেন সদয় হইয়া।।
শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ।
গুরুভক্তিচন্দ্রিকা কহে নরোত্তম দাস।।
ইতি গুরুভক্তি-চিন্তামণি সম্পূর্ণ।

(ক. বি.১৬৬৫ পুথি হইতে আদর্শ পাঠ গৃহীত)