বাংলা-সাহিত্য ও পদাবলীকীর্তনের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমা ও পরিবেশ এবং তার সঙ্গীতের ইতিহাস কী ধরনের ছিল সে সম্বন্ধে আমাদের কিছুটা পরিচয় থাকা উচিত এবং সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্মের ক্রমবিকাশ ধারার ইতিবৃত্তও আমাদের জানা সমীচীন৷
বাংলাদেশ সঙ্গীতের দেশ৷ বাংলার নগর ও পল্লী (নাগর ও গ্রামীন) এই উভয় সমাজেই মানবজীবনযাত্রার প্রতিটি গতি ও ছন্দের সঙ্গে নৃত্য-গীত-বাদ্য বা সঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে৷ বৃহত্তর-বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ ও উপাদানই ছিল গীতি বা গান –তা সে ছড়ার আকারেই হোক, হেঁয়ালী বা প্রবাদের আকারেই হোক, ব্রতানুষ্ঠান, বিবাহ ও অন্যান্য মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানসম্পর্কেই হোক৷ গিরিব্রজ বা বিহার, কলিঙ্গ বা উড়িষ্যা এবং কামরূপ বা আসাম নিয়ে অখণ্ড বাংলাদেশ ছিল বৃহত্তর-বাংলার রূপ সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি৷ মিথিলা ছিল তখন বৃহৎ-বঙ্গের অপরিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং দ্বার-বঙ্গ (দ্বারভাঙ্গা) ছিল বাংলাদেশের প্রবেশপথ৷ উৎকল বা উড়িষ্যার কথাও তাই৷ এমন কি চতুর্দশ শতক পর্যন্ত বাংলা ও উড়িষ্যার মধ্যে পৃথক কোন সীমারেখার অস্তিত্ব ছিল না৷ পঞ্চগৌড়ের মধ্যে কলিঙ্গ>উৎকল >উড়িষ্যা ছিল অন্যতম৷ দক্ষিণরাঢ়ের সিংহপুর ছিল একসময়ে বৃহৎ-উড়িষ্যার প্রধান রাষ্ট্রকেন্দ্র৷ গৌড়ের সীমারেখাও বিস্তৃত ছিল লক্ষ্মণাবতী বা বর্তমান মালদহ জেলা পর্যন্ত৷ কামসূত্রের টীকাকার যশোধরের মতে, গৌড়-বঙ্গের বিস্তৃতি ছিল কলিঙ্গদেশ বা উড়িষ্যা পর্যন্ত৷ শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে বঙ্গের বা গৌড়বঙ্গের যে রূপের পরিচয় দেওয়া আছে তা থেকে জানা যায়, মধ্য ও পূর্ববাংলা থেকে শুরু করে ভুবনেশ্বর (উড়িষ্যা) পর্যন্ত বিশাল ভূমিখণ্ডই ছিল বঙ্গদেশ বা বাংলা, কেননা পঞ্চগৌড় বলতে তখন বোঝাতো সারস্বত বা পূর্বপঞ্জাব, কান্যকুব্জ, মিথিলা (উত্তর-বিহার) ও উৎকল (উত্তর-উড়িষ্যা)৷ স্কন্দপুরাণাদিতেও এইধরনের উল্লেখ পাওয়া যায়৷
“বাংলা” বা “বঙ্গাল” শব্দ বা নামটি নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে৷ “আইন-ই-আকবরী”–গ্রন্থে আবুল ফজল “বঙ্গ” ও “বঙ্গাল” এই দুটি শব্দেরই উল্লেখ করেছেন৷ তিনি বলেছেন ঃ “The original name of Bengal was Banga. Its former Rulers raised mounds, measuring ten yeards in height and twenty in breadth, throughout the province, which were called al. From this suffix (al),the name Bengal took its rise and currency”. (English translation)ভারতের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আক্‌বর ও লামা তারানাথের সময়ে “আল”-শব্দটি অন্য নামে অর্থাৎ “ভাটি” পরিচিত ছিল৷ দক্ষিণ-ভারতের ও অন্যান্যদেশের কতকগুলি তাম্রলিপি ও শিলালেখতে দেখা যায়, বঙ্গ বা বঙ্গলা (বাঙলা) এই শব্দ-দুটিকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে৷ খ্রীষ্টীয় এগারো শতকের পূর্বে বঙ্গ বা বঙ্গদেশ ঠিক বাঙ্গালা বা বাঙলা নামে পরিচিত ছিল কিনা তাঁর সুনির্দিষ্ট কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ সুতরাং মনে করা যেতে পারে যে, ১১শ-১২ শতকের বৃহৎ-বঙ্গের সীমানির্দেশ ছিল ঃ উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণ তাম্রলিপ্তের (বর্তমান তমলুক) সীমাচুম্বিত বিশাল সমুদ্র, পূর্বে আরাকানের নিবিড় অরণ্য ও পশ্চিমে মগধের প্রান্তদেশে ছোটনাগপুরের বিস্তৃত অরণ্য৷ শোনা যায়, আরাকানের রাজ্যসভায় তখন বাঙালী কবি ও সাহিত্যিকদের আলোচনা সভার আয়োজন হত৷ বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের সমন্বয়-নিদর্শনও বৃহৎ বঙ্গের মধ্যে কম ছিল না৷
শোনা যায়, খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকের আরবজাতীকে কেন্দ্র করে ইস্‌লামীয় সুফীধর্মের সম্প্রসারণ বাংলার বুকে সম্ভব হয়েছিল৷ অনেকের মতে, পারস্য, বোখারা ও সমরকন্দে সুফীমতবাদের কেন্দ্র নির্দিষ্ট থাকলেও বাংলায় প্রাচীন বৈষ্ণবদের আউল, বাউল, দরবীশ ও সাঁই (স্বামী) প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সুফীমতবাদের কিছুটা অনুপ্রবেশ বা সংমিশ্রণ ঘটেছিল ৷ (ডঃ মুহম্মদ এনামূল হক মনে করেন, খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে সুহ্‌ রববদীয়হ-সম্প্রদায়ভুক্ত শযখ জলালু-দ-দীন্‌ তব্‌বীযীর অভিযানের পর থেকেই বাংলাদেশে সুফীমতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে৷ অবশ্য এইসম্বন্ধে ভিন্ন মতেরও প্রচলন আছে ৷) কথিত যে, মুসলমান দরবীশদের মাধ্যমে আরবীয় সুফীধর্মের মিলন সংঘটিত হয়েছিল ( এ”সম্বন্ধে এড্‌ওয়ার্ড জে. ব্রাউনের (E.J.Browne)Dervish গ্রন্থে আলোচনা দ্রষ্টব্য৷) বাংলার বিচিত্র ধর্মমতের সঙ্গে এবং বিশেষ করে চারটি কেন্দ্রের মাধ্যমে তা সম্ভবপর হয়েছিল সেই চারটি কেন্দ্র হোল ঃ (১) বরেন্দ্রভূমি তথা মালদহ, দিনাজপুর, বঙ্গপুর বা বঙ্‌পুর, পূর্ণিয়া, রাজমহল ও তার চতুষ্পার্শ্বস্থ অঞ্চল, (২) বাঢ়ভূমি বা বর্ধমান, বীরভূমি বাকুড়া ও হুগলী (৩) বঙ্গভূমি তথা পাবনা, বগুড়া , রাজসাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর ও বাখরগত এবং (৪) চট্টলভূমি বা চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও নোয়াখালী৷ অবশ্য এই মতবাদের সমীচীনতাও নির্ধারণ করা উচিত ঐতিহাসিক দৃষ্টির কষ্টিপাথরে৷ বৌদ্ধ যোগ, তন্ত্র (হিন্দু ও বৌদ্ধ) ও বৈদিকধর্মের সংমিশ্রণে বাংলার বৈষ্ণবধর্মে যে এক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল সে আলোচনা পূর্বেই কিছুটা করেছি৷
বৃহত্তর বঙ্গে এবং পরবর্তীকালে খণ্ডিত বাংলায়ও সংস্কৃতচর্চা বনাম বিদ্যাচর্চার বিশেষ প্রচলন ছিল৷ প্রাচীন ও নব্য ন্যায়, মীমাংসা, স্মৃতি, অলংকার, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্রের কথা ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশের সারস্বত আচার-ব্যবহার ও সঙ্গে সঙ্গে দেশসমৃদ্ধির পরিচায়করূপে পুণ্ড্রবর্ধনের অধিবাসী সন্ধ্যাকর নন্দী-রচিত “রামচরিত” বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ “রামচরিত” গৌড়রাজ রামপালদেব ও তদীয় পুত্র মদনপালদেবের অবিস্মণীয় কীর্তিগাথা ও অবদানের ইতিকথা৷ এই ইতিকথার পরিপ্রেক্ষিতে পালযুগে বাংলার সামাজিক ও পরিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক জীবনস্বাচ্ছন্দেরও সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়৷ নালন্দা, বিক্রমশিলা, ওদন্তপুরী প্রভৃতি বৌদ্ধ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঐ সকল মহাশিক্ষাতীর্থসংলগ্ন বৃহৎ গ্রন্থশালাগুলিও পালযুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির জ্বলন্ত নিদর্শন৷ বাঙালী বৌদ্ধধর্মাচার্য ও সুপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর, শীলভদ্র, শান্তিরক্ষিত ও অন্যান্য মনীষীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের অবদান বাংলার ইতিহাসকে গৌরবমণ্ডিত করেছে৷ “কবীন্দ্রসমুচ্চয়” ও “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থ দুটিতে প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের অনুলিখন ছাড়াও তদানীন্তন সমাজে আদি ও ভক্তিরসাত্মক ধর্মভাবসেবিত দৈনন্দিন জীবনচর্যার পরিচয় পাওয়া যায়৷ পালরাজাদের পূর্ববর্তী গুপ্ত ও সেন-রাজাদের শাসনকাল বাংলার সমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও সামাজিক জীবন দিনপঞ্জীপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়৷ রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতি ধর, গোবর্ধন ও শরণ এই পঞ্চরত্নের কাব্যপ্রতিভা দ্বাদশ শতকের বাঙালাকে গৌরবোজ্জ্বল করেছিল৷
ভক্তি ও ভক্তিবাদের প্রাণকেন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণু বা কৃষ্ণ-বাসুদেবকে অবলম্বন করে কীভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্মের গোড়াপত্তন সম্ভব ও সার্থক হয়েছিল তার বিবরণ আমরা আরো কিছু পরে দেবার চেষ্টা করবো৷ বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের আলোচনায় ভক্তিতত্ত্ব ও ভক্তিরসকেন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ বা কৃষ্ণবাসুদেবের প্রসঙ্গও অপরিহার্য৷ আচার্য শঙ্করের প্রমাণিত ও প্রচারিত অদ্বৈতব্রহ্মবাদ (মায়াবাদ নয়) পূর্বমীমাংসাদর্শন-নির্দিষ্ট ধর্ম ও কর্ম এবং ভগবান বুদ্ধ ও পরবর্তী বৌদ্ধাচার্যগণ-প্রচারিত বৌদ্ধমতকে বিশেষভাবে নিরস্ত করলেও ভক্তিবাদের বিরুদ্ধে কোনদিন কেউ সংগ্রাম ঘোষণা করেন নি৷ বিশেষ করে প্রখর জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সরস ভক্তিচর্চার স্পর্শ বাংলার মানসক্ষেত্রে এক নূতন জীবনস্পন্দন সৃষ্টি করেছিল৷ আচার্য রামানুজ, নিম্বার্ক, মধ্ব, বল্লভাচার্য কিংবা দক্ষিণ-ভারতে আল্‌বার বা আলোয়ার-সম্প্রদায় প্রচারিত ভক্তিবাদ ও বৈষ্ণবধর্ম বাংলার জনগণের মনে ততো প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হলেও শাণ্ডিল্যসূত্র, নারদীয়ভক্তিসূত্র, শ্রীমদ্ভাগবতের প্রাণকেন্দ্র বিভিন্ন পঞ্চরাত্রসংহিতা ও পুরাণসাহিত্য-প্রতিপাদিত ঈশ্বরপ্রেম ও ভক্তিধর্ম বাঙালীর সচল ও রসসিক্ত মনকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল৷ অবশ্য গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের নবজন্ম তখনও বাংলার বুকে সার্থক হয়ে ওঠে নি৷ বাংলার ইতিহাসের পথযাত্রীমাত্রেরই জানা আছে যে, পরমভাগবত গুপ্তরাজাদের সময়ে বাংলার শিব, গণপতি ও কার্তিকেয়ের মন্দির এবং স্থানে স্থানে শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠিত থাকলেও সাধারণ সমাজে বিষ্ণু-উপাসনার অনুষ্ঠান ও নিষ্ঠাই বৈষ্ণবধর্মের ভাবপ্রবাহকে অব্যাহত রেখেছিল৷ রাজতরঙ্গিণীকার কহ্লণের ঐতিহাসিক বিবরণে পাওয়া যায়, শিব ও কার্তিকেয়ের বিভিন্ন মন্দিরে নৃত্য-গীত -অনুষ্ঠানের জন্য দেবদাসীরা নিযুক্ত থাকত এবং তাদের নৃত্যছন্দ ছিল সম্পূর্ণভাবে ভরতের নাট্যশাস্ত্র-অনুমোদিত৷
গুপ্ত ও পালোত্তর সেন-রাজাদের মধ্যে শিব ও বিষ্ণু এই উভয় দেবতারই উপাসনা প্রচলিত ছিল৷ তবে রাজা লক্ষ্মণসেন নিজে ছিলেন পরমবৈষ্ণব ও বিষ্ণুর উপাসক৷ তাঁর রাজত্বকালে বাংলার সমাজে যে রাধাকৃষ্ণলীলাসেবিত ভক্তিবাদের প্রচলন ছিল তা বাংলার ইতিহাসই বিশেষভাবে প্রমাণ করেন৷ খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত কৃষ্ণলীলাবিষয়ক মূর্তির নিদর্শন সেকথা আরো বিশেষভাবে প্রমাণ করে৷ অবশ্য পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত ধ্বংসস্তূপে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ছাড়াও বিষ্ণু, বলরাম, ত্রিশূলধারী শিব, গণেশ, ইন্দ্র, যমুনা ও রামায়ণ কাহিনীর মূর্তি পাওয়া গেছে৷ রায় বাহাদুর কে. এন. দীক্ষিত ১৯২০ -২১, ১৯২৬-২৭ এবং ১৯২৭-২৮ খ্রীষ্টাব্দের বার্ষিক প্রত্নতাত্ত্বিকী বিবরণীতে (Annual Report of the Archaeological Survey of India for 1920-21, 1926-27, 1927-28) পাহাড়পুর-স্তূপের ও স্তূপ থেকে আবিষ্কৃত বিচিত্র উপাদান-সামগ্রী ও মূর্তির পরিচয় তিনি দিয়েছেন ( Excavations of Paharpur, Bengal,Memories,ASI, No.55 দ্রষ্টব্য) ৷ অধুনা ডঃ চারুচরণ দাশগুপ্ত Paharpur and Its Monuments(1961) নামক ক্ষুদ্র পুস্তিকায় কৃষ্ণ ও রাধাকৃষ্ণ-মূর্তির পরিচয়ে গোকুলে গিরিগোবর্ধন ধারী কৃষ্ণ, রাধাকষ্ণের যুগলমূর্তি এবং বসুদেব ও শিশুকৃষ্ণমূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন৷ রাধাকৃষ্ণের মূর্তিপ্রসঙ্গে তিন বলেছেন ঃ “In the wall on south-east angle facing south there is a sculpture which represents two standign figures-one, male and the other, a female (PL. VIII,b). The right arm of the male figure clasps the female figure whose left arm clasps the male figures. The female figure has a halo behing its head. This sculpture probably represents Radha and Krishna. It is undoubtedly one of the best sculptures that have been found at Paharpur” (p.26) ৷ (অন্যান্য কৃষ্ণলীলাকাহিনীর মূর্তিসম্বন্ধে (Krishna-legend-scenes) Paharpur and Its Monuments (1961) pp.25, 27 দ্রষ্টব্য৷ পাহাড়পুরের-স্তূপ থেকে আবিষ্কৃত বাদ্যযন্ত্রের যে বিচিত্র নিদর্শন পাওয়া গেছে সেই সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করবো ৷)
পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত মূর্তি প্রভৃতি ছাড়া মহারাজ লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে কবি জয়দেব -রচিত “গীতগোবিন্দ”-পদগান শ্রীরাধাকৃষ্ণলীলামাধুর্যের বর্ণনায় মুখর৷ ডঃ শ্রীঅসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুলিখিত “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” (বাংলা -সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” ১ম খণ্ড (১৯৫৯), পৃঃ ২০৪৷ তাছাড়া তার “বৈষ্ণব ধর্মের ক্রমবিকাশধারা” আলোচিত অংশটি এইপ্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য (৭ম অধ্যায়, পৃঃ ২৫৮- ২৭৮ ৷) -গ্রন্থে চৈতন্যপূর্ব যুগে বাংলাদেশে যে সকল গ্রন্থ বৈষ্ণবধর্মানুপ্রবেশ ও তার পরিপুষ্টির পটভূমিকা রচনা করেছিল তাদের নামোল্লেখ করেছেন এবং সেগুলি হোল ঃ”(ক) জয়দেবের গীতগোবিন্দ, (খ) বিল্বমঙ্গলের (লীলাশুক) কৃষ্ণকর্ণামৃত, (গ) ব্রহ্মসংহিতা, (ঘ) বোপদেবের মুক্তাফল, (ঙ) বিষ্ণুপুরীর শ্রীশ্রীভক্তিরত্নাবলী, (চ) লক্ষ্মীধরের ভগবন্নামকৌমূদী, (ছ) শ্রীধরস্বামীর ভাগবতের টীকা, (জ) ঈশ্বরপুরীর কৃষ্ণলীলামৃত”৷ অবশ্য এগুলি ছাড়া “সংগীতমাধব”, “শ্রীচৈতন্যচন্দ্রামৃত” প্রভৃতি গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য৷
এখানে আলোচনার বিষয় হোল প্রাক্‌-জয়দেব যুগে রাধাকৃষ্ণলীলানুশীলনের মাধ্যমে বৈষ্ণবধর্ম বাংলাদেশে কতটুকু প্রসারতা লাভ করেছিল তা প্রতিপালন করা এবং সেক্ষেত্রে “গীতগোবিন্দ” বা অষ্টপদীর কথা বাদ দিলেও গীতা শ্রীমদ্ভাগবত ও অন্যান্য ভক্তিগ্রন্থ -নির্দেশিত ভক্তিতত্ত্ব বাংলার মানসক্ষেত্রকে বিশেষভাবে রসসিঞ্চিত ও প্রবুদ্ধ করেছিল৷ শোনা যায়, খ্রীষ্টীয় ১৪শ শতকে মাধবেন্দ্রপুরীই বাংলাদেশে শ্রীমদ্ভাগবত প্রচার করেছিলেন, সুতরাং “শ্রীমদ্ভাগবত” লিখিত বা সংকলিত হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ১৩শ -১৪শ শতকের পূর্বে৷ পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত রাধাকৃষ্ণের মূর্তিগুলি নিঃসংশয়ে বাংলার ভাগবতধর্মের প্রভাব প্রমাণ করে একথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি৷ খ্রীষ্টীয় শতকের গোড়ার দিকে রচিত পুরাণগুলিতে বর্ণিত ভক্তিতত্ত্বও বাংলার প্রেমধর্মপ্রেরণাকে প্রাণবান করেছিল৷ সাতবাহন নরপতি হালের “গাঁথা সপ্তশর্তী” গ্রন্থে (১ম বা ১ম-২য় শতক) রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনীর বর্ণনা আছে৷ কবি জয়দেবের আবির্ভাব খ্রীষ্টীয় ১২শ-১৩শ শতকে৷ তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমনই এক সময়ে যখন বাংলাদেশে ভাগবতধর্মের ছিল লীলাচঞ্চল যৌবনকাল৷ জয়দেব শ্রীরাধাকৃষ্ণলীলাতত্ত্বের প্রচারব্রত নিয়েই যেন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং একদিক থেকে বলা যায় বৈষ্ণব -পদাবলী-কীর্তনের পটভূমিকা-রচনার সূচনাও হয়েছিল ঠিক তখন থেকে বাংলাদেশে৷ যদিও চর্যাগীতির অবদান পদকীর্তনের ভাণ্ডারে কম নয়৷ সংস্কৃতায়িত বাংলা পদ্যছন্দে রচিত জয়দেবের “গীতগোবিন্দ”-পদগানের ছত্রে ছত্রে রাধাকৃষ্ণলীলাতত্ত্বগানই সুস্পষ্ট৷ কবি নিজে তার পরিচয় দিয়ে প্রথম সর্গের তৃতীয় শ্লোকে বলেছেন —
যদি হরিস্মরণে সবসং মনো যদি বিলাসকলাসু-কুতূঽলম্‌৷
মধুরকোমলকান্তপদাবলীং শৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম্‌ ৷৷
ভক্তজনচিত্তে কৃষ্ণভক্তিরতি সঞ্চারের জন্য যেন জয়দেব কবির পদ-রচনার প্রধান অভিপ্রায় ছিল৷ পণ্ডিত প্রবর শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সত্যই বলেছেন ঃ “মহাভারতে, পুরাণে বিশেষ করিয়া শ্রীমদ্ভাগবতে যে গোবিন্দলীলা বর্ণিত হইয়াছে, কবি জয়দেব শ্রীগীতগোবিন্দে সে গোবিন্দের লীলাই বর্ণিত হইয়াছে, কবি জয়দেব শ্রীগীতগোবিন্দে সেই গোবিন্দের লীলাই বর্ণনা করিয়াছেন৷ লীলাপুরুষোত্তম শ্রীগোবিন্দই তাঁহার প্রেয়সীশ্রেষ্ঠা শ্রীরাধার সঙ্গে শ্রীগীতগোবিন্দের আদাবন্তে কীর্তিত হইয়াছেন৷”
কাব্য ও সাহিত্যের দিক দিয়াও গীতগোবিন্দের একটি বিশেষ মূল্য আছে, –যদিও আখ্যান, নাটকীয়তা ও সঙ্গীত এই ত্রিবেণীসঙ্গমের মিলিত ধারা এর মধ্যে প্রবাহিত৷ তাঞ্জোরের সরস্বতী-মহল-গ্রন্থাগারে গীতাগোবিন্দের একটি নাট্যরূপসম্বলিত পুঁথি পাওয়া গেছে এবং গ্রন্থাকারেও ছাপা হয়েছে৷ বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ গীতগোবিন্দের আখ্যানভাগ রচনা করেছে এবং বিচিত্র রাগ ও তাল এর সঙ্গীতরূপ সৃষ্টি করেছে৷ এজন্য অনেকে গীতগোবিন্দকে বাহ্যতঃ “আখ্যানকেন্দ্রিক খণ্ডকাব্য” বা গীতিকাগ্রন্থ বলে অভিমত প্রকাশ করেন৷ তবে গীতগোবিন্দে সঙ্গীতাংশের যে যোজনা আছে ও বিশেষ করে যে যে রাগগুলির পরিচয় দেওয়া আছে, গীতগোবিন্দে তাদের যাত্রাপথে ভারতীয় প্রাচীন ও নবীন রাগরূপের একটি বিবর্তনময় ধারা লক্ষ্য করা যায় এবং সেই বিবর্তনের মুখে মেবারের রাণা কুম্ভা ১৫শ শতক “সঙ্গীতরাজ”-গ্রন্থে গীতগোবিন্দের “রসিকপ্রিয়া” টীকার রাগগঠনে বা রাগরূপের প্রকাশশৈলীতে কিছুটা নূতনতর বিকাশের পরিচয় দিয়েছেন৷ অনেকে আবার মধ্যযুগীয় সাধু-সম্প্রদায়ের ও বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের আধার ও উৎসভূমি রূপে গণ্য করে গীতগোবিন্দকে “ভক্তিকাব্য” বলেও অভিহিত করেন৷ মোট কথা রাধাকৃষ্ণের আদিরসাত্মকও উজ্জ্বলবেশাত্মক অপার্থিব লীলাবৈচিত্র্যের সাক্ষ্যবহনকারী এই “গীতগোবিন্দ” -পদগান৷ পুরীতে জগন্নাথদেবের মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫শ শতকে কলিঙ্গসম্রাট প্রতাপরুদ্রদেব (যিনি পরে শ্রীচৈতন্যের কৃপাশ্রিত হয়েছিলেন) গীতগোবিন্দগান জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রচলন করেছিলেন৷ শোনা যায়, দেবদাসীদের নৃত্য সম্বলিত হোয়ে মৃদঙ্গবাদ্যের সহযোগে জগন্নাথদেবের মন্দিরে গীতগোবিন্দ গান করা হত৷
লীলাশুক বা বিল্বমঙ্গল ঠাকুরের “শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত” গ্রন্থে পদগানের মাধুর্য নিয়ে আলোচনা করবো পরে৷ তবে “গীতগোবিন্দ” ও “কৃষ্ণকর্ণামৃত” ভক্তিগ্রন্থদুটি নিয়ে মোটামুটিভাবে অনুশীলন করলে দেখা যায় যে, গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেব বিল্বমঙ্গল-রচিত কৃষ্ণকর্ণামৃতের ভাব ও কাব্যসম্পদ দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন৷ ডঃ শ্রী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ঃ” জয়দেব লীলাশুকের কৃষ্ণকর্ণামৃতের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিলেন কিনা বুঝা যাইতেছে না৷ “কৃষ্ণকর্ণামৃত” জয়দেবের সময়ে নিতান্ত অপরিচিত ছিল না, কারণ শ্রীধরদাস সদুক্তিকর্ণামৃতে কৃষ্ণকর্ণামৃত হইতে শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন৷ তবে লীলাশুক যেমন সখীভাবে রাধাকৃষ্ণের সেবা করিয়াছেন, জয়দেবের মধ্যে ঠিক সেই জাতীয় অনুভূতি পাওয়া যায় না৷ লীলাশুক আপনাকে কৃষ্ণলীলার সহায়তায় ( “মঞ্জরী”-ভাবের৷) নিয়োগ করিয়া ধন্য হইয়াছেন৷ কিন্তু গীতগোবিন্দের কবির মধ্যে ঠিক সেই জাতীয় পরিকরবৃত্তি বা সখী সাধনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না৷” (“বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” (১ম খণ্ড, ২য় সংস্করণ, ১৯৬৩), পৃঃ ৯৩) যাহা হউক শ্রীচৈতন্য নিভৃতে নির্জনে গম্ভীরায় “গীতিগোবিন্দ” দিবারাত্র আস্বাদন করতেন বলে সহজিয়া বৈষ্ণবগণ কবি জয়দেবকে “নবরসিক”-এর অন্যতম ও “আদিগুরু” বলে নির্দেশ করেছেন৷ তবে গীতগোবিন্দের ছন্দ,ভাব ও মাধুর্য যে পরবর্তী বৈষ্ণব-ভক্তিসাহিত্যকে রস-ভাবসমৃদ্ধ করেছিল এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই৷