নির্ণয়সাধ্যং বহুসাধনানি কুর্ব্বন্তি বিজ্ঞা পরমাদরেণ।
শ্রীরূপপাদাব্জ রজৌভিষেকং ব্রতঞ্চ এতৎ মম সাধনানি।।
এই মত গুরুশিষ্য একত্র বসিঞা।
প্রশ্নোত্তর গোষ্ঠী করে আনন্দিত হঞা।।
শিষ্য নিবেদন করে শ্রীগুরু গোসাঞি।
সুনিয়ম যে করিল শ্রীদাস গোসাঞি।।
তাহা যে শুনিতে মোর হরিষ অন্তরে।
সাধন নির্ণয় সেই কহিবা আমারে।।
শিষ্যের বচন শুনি গুরু মহাশয়।
কহিতে লাগিলা কিছু সাধন নির্ণয়।।
শুন শুন ওহে শিষ্য আমার বচন।
সাধ্য সাধন কহি করহ শ্রবণ।।
যে বস্তু সাধন কহি সেই হয়ে সাধ্য।
তবে সেই পক্ব মাত্র হয়ে সাধ্য বাক্য।।
অনন্য হঞা করে কৃষ্ণের ভজন।
প্রেমাঙ্কুরে প্রেমলতা ধরে প্রেমধন।।
অন্য বৃক্ষে অন্য ফল কভু নাঞি হয়।
শ্রীদাস গোসাঞির আজ্ঞা জানিহ নিশ্চয়।।
একদিন শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের সঙ্গে।
বসিঞা আছেন ভাসি প্রেমের তরঙ্গে।।
রাধাকুণ্ডের পূর্বে শ্যামকুণ্ডের উত্তরে।
বসতি কুটীর ঘর তাহার ভিতরে।।
হা রাধা হা কৃষ্ণ হা ললিতা বিশাখা।
হা স্বরূপ রূপ সনাতন কহে দৈন্য কথা।।
বৃন্দাবন নন্দীশ্বর জাবট গোবর্ধন।
রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড বলিয়া ক্রন্দন।।
রাধাকুণ্ড বলি সদা করে হাহাকার।
গোবর্ধন শিলা গুঞ্জা সেবা জানিবার।।
হেনকালে মথুরাদাস নামে মহাশয়।
পরম বৈরাগি তিহোঁ গৌর প্রেমময়।।
রাধাকুণ্ডে স্নান করি গোসাঞি সন্নিধানে।
প্রণাম করিয়া পড়ে হঞা সাবধানে।।
শ্রীদাস গোসাঞি আর কবিরাজ গোসাঞি।
দোহাঁর দরশন তিহোঁ পাঞা একঠাঞি।।
রাধাকুণ্ডের প্রেমকাষ্ঠা দর্শন পাইঞা।
আনন্দে পুলক-অশ্রু-ধারা যায় বঞা।।
পুনঃ পুনঃ উঠে পড়ে বন্দয়ে চরণ।
ফুকরি ফুকরি বহু করয়ে ক্রন্দন।।
স্থির করাইঞা তারে দোহেঁ বসাইলা।
তবে তিহোঁ জোড় হাথে কহিতে লাগিলা।।
সাধ্য সাধন তত্ত্ব কহিবে গোসাঞি।
তোমা বহি আর কেহো কহিবারে নাঞি।।
চৈতন্যের শেষ লীলা প্রেমার তরঙ্গ।
সে সব লীলায় প্রভু ছিলা তাঁর সঙ্গ।।
গৌরাঙ্গ-স্তব-কল্পতরু কড়চা অনুসারে।
বুঝিল সকল (লোক) প্রালাপ বিকারে।।
গোবর্ধন শৈল ভ্রমে চটকা গিরি শৈলে।
তেলঙ্গা গাবি মধ্যে নিম্ন গাঢ়ের ভিতরে।।
সমুদ্র-পতন-লীলা জলকেলি রঙ্গ।
এসব লীলায় ছিলা স্বরূপ তার সঙ্গ।।
তোমা বিনা চৈতন্যের অন্তরঙ্গ নাঞি।
বিশেষে করিলে শিক্ষা শ্রীরূপ গোসাঞি।।
শ্রীরূপের দ্বিতীয় তনু আপনে গোসাঞি।
কৃপা করি কহ মোরে যে কিছু শুধাই।।
এতেক শুনিঞা তবে শ্রীরঘুনাথ দাস।
হা স্বরূপ রূপ বলি ছাড়েন নিশ্বাস।।
কহিব সকল কথা যাতে তোমার লোভ।
পশ্চাতে শুনিবে লীলা যত বস্তুক্ষোভ।।
সুনিয়ম কথা কহি সাধ্য সাধন।
বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণ প্রাপ্তির কারণ।।
গুরুপদে কৃষ্ণ নামে অভীষ্ট সরণ।
চৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত চরণ।।
স্বরূপ গোসাঞি আর গণের সহিতে।
সনাতন গোসাঞি আর গোবর্ধন গিরিতে।।
রাধাকুণ্ড মথুরা দ্বাদশাধিক বন।
ব্রজে অন্যগ্রাম আর অন্য ভক্ত জন।।
আর যত ব্রজবাসী বৈসে ব্রজভূমে।
পরম আস্থায় রতি হউ এই সব স্থানে।
কৃষ্ণের অনন্ত স্থান অনন্ত প্রকাশ।
অনন্ত ভক্ত লঞা তাহা করেন বিলাস।।
তথাপি সে সব স্থানে না যাব এক ক্ষণ।
গ্রাম্যবার্ত্তা কহি যদি ব্রজবাসিগণ ।।
আপনে তাদিগে সুখ হেতু যে কহিব ।
গ্রাম্য-কথা কহিয়াও ব্রজে সে রহিব।।
অন্যক্ষেত্রে কোটি যুগ কৃষ্ণ কথা রসে।
গ্রন্থ আস্বাদন সদা ভক্ত সঙ্গে বৈসে।।
ব্রজবাসি সঙ্গে যদি রহে একক্ষণ।
তথাপি দেখিএ কভু নহে তার সম।।
কোন কোন কথা ছলে মাত্র ব্রজে বাস।
উপাসনা ক্রমে প্রাপ্তি কহিল নির্য্যাস।।
রাধাকৃষ্ণ উজ্জ্বল প্রেম অতুল লিখন।
ব্রজে নানা স্থানে শোভা প্রত্যক্ষ আছেন।।
তাহা দেখি অন্য স্থানে ক্ষেণার্ধ মতি নয়।
এই সাধ্য সাধন সার করিল নিশ্চয়।।
কেহো বলে কৃষ্ণ গেলা দ্বারকা নগরী।
রুক্মী সত্যভামা সহ মহৈশ্বর্য্য ভরি।।
ব্রজভূমি ছাড়ি আমি তিলার্ধ না যাব।
ফুল ফল তৃণ লতায় পড়িয়া রহিব।।
তার মধ্যে যদি শুনি রাধা ঠাকুরাণী।
কেহো যদি কোন ছলে কহে এই বাণী।।
বৃন্দাবন ছাড়ি গেলা কৃষ্ণের নিকটে।
একবার ইহা যদি শুনি শ্রুতি পুটে।।
মনের অধিক চলে গরুড় মহামতি।
তাহা হইতে উড়িয়া চলিব শীঘ্রগতি।।
নহে এই ব্রজে মোর সাধ্য সাধন।
অবশ্য পাইব রাধা কৃষ্ণের চরণ।।
কেহো বলে অনাদি কৃষ্ণ কেহো বলে আদি।
কেহো বলে পটুরতি বিচক্ষণ সাধি ।।
কেহো বলে বড় মৃদু কেহো করুণাময়।
করুণাহীন কেহো কেহো তাহারে কহয়।।
নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ।
জীবনে বিকাইনু তার ভৃত্যের হাথ।।
বলরাম জ্যেষ্ঠ যার সুদাম বয়ঃসখা।
নন্দ ঘোষ পিতা সুবল প্রিয় নর্ম্মসখা।।
রাধিকার প্রাণ প্রিয় ঘর নন্দীশ্বর।
শিরে শোভে শিখি পাখা বেশ নটবর।।
মুরলীর ধ্বনি পিত পট্ট পরিধান।
এই কৃষ্ণ উপাসনা মোর প্রাণঃ প্রাণ।।
জন্মে জন্মে এই কৃষ্ণ মোর উপাসন।
কহিল মনের কথা সাধ্য সাধন।।
বৃষভানু-কুমারী রাধা সুদাম-অনুজা।
অনঙ্গমঞ্জরী-জ্যেষ্ঠ কীর্ত্তিকা-গর্ভজা।।
পিতামহ মহী ভানু বৃদ্ধ মাতামহ।
মাতামহী মুখরা পিতামহী সুখদা শুনহ।।
রত্ন ভানু সুভানু যাহার দুই খুড়া ।
ভদ্রকীর্ত্তি চন্দ্রকীর্ত্তি মাতুল মাতুলা।।
ললিতা যাহার জ্যেষ্ঠ সখি মধ্যে গণি।
সপ্তবিংশতি দিনে তাহার জ্যেষ্ঠ জানি।।
অনুরাধা একনাম দ্বিতীয় আখ্যান।
বামতা প্রখরা গুণে সদা অভিমান।।
গোরোচনা অঙ্গ কান্তি শিখি পীতাম্বর।
সারোদি যাহার মাতা পিতা বিশোকর।।
কুসুমিতা সপ্তজিতা খুড়া মুরুত।
পরম শ্রেষ্ঠ সখি হয় প্রধান তার যূথ।।
পতি ভৈরব গোবর্ধন-মল্লের সখা ।
রত্ন প্রভা রতিকণা মুভদ্রা ভদ্ররেখা।।
সুমুখী ধনিষ্ঠা কলহংসী কলাপিনী।
অনুরাধা সঙ্গে এই অষ্ট সখী জানি।।
রাধিকার সমবয়া দ্বিতীয় বিশাখা।
যতগুণ রাধিকার শুন এই লেখা।।
বিদ্যুত ছটা জিনি অঙ্গ মিহির বসন।
মুখরার ভগ্নিপতি পিতা যে পাবন।।
জটিলার ভগ্নিকন্যা নাম যে দক্ষিণা।
বিশাখার মাতা তিহোঁ পতিবাহিকনামা।।
মাধবী মালতী চন্দ্ররেখিকা কুঞ্জরী ।
হরিণী চপলা শুভা নানা সহচরী।।
এই অষ্ট সখী হয় বিশাখার সঙ্গে।
চম্পকলতার গুণ কহি শুন রঙ্গে।।
রাধা হইতে চম্পকলতা ছোট একদিনে।
গুণেতে রাধিকার (সদৃশ) সানুমানে।।
চম্পক পুষ্পের বর্ণ সুন্দর অঙ্গ কান্তি।
চাস পক্ষী সম বস্ত্র তাহে শোভে অতি।।
কুরঞ্জাক্ষি সুচরিতা মণিকুন্তলা মণ্ডিনী।
চন্দ্রিকা চন্দ্র লতা কঞ্জরাক্ষি সুন্দরী।।
এই অষ্ট সখী রহে চম্পকলতার সঙ্গে।
চতুর্থে চিত্রার কথা শুন কহি রঙ্গে।।
ছাব্বিশ দিবসের জ্যেষ্ঠা যার মদীশ্বরী।
রাধিকার প্রিয় সখী চিত্রিকা বিহরি।।
কেসরি জিনিঞা অঙ্গ কাচলি ভাস্বর।
মৃদু চতুরাক্ষির কন্যা পতি পিঠর।।
মাতা চর্চ্চিকা সহচরীর সালিকা।
ত্রিলোকিনী সৌরসেনী আর সুগন্ধিকা।।
কামিনা কামিনা আর নাগর নাগরী।
নাগরিকা আদি এই অষ্ট সহচরী।।
তুঙ্গবিদ্যা রাধা হইতে জ্যেষ্ঠা পাঁচদিনে।
কর্পূর ভূষিত চন্দন কুঙ্কুম মিলনে।।
ঘষিতে যেমন বর্ণ তৈছে অঙ্গ কান্তি।
চন্দ্রের সমান বস্ত্র শোভা করে অতি।।
স্বভাবে দক্ষিণা প্রখরা মাতা তার মেধা।
পিতা পুষ্কর পতি বানিস সুভদা।।
মঞজু মেধা সুমধুরা মধুরেখা সুমেধা।
মধুষ্যন্দা গুণচূড়া বরঙ্গদা তনুমধ্যা।।
তুঙ্গবিদ্যার অষ্ট সখী করিল গণন।।
ষষ্ঠে ইন্দুরেখার কিছু শুনহ বর্ণন।।
রাধা হৈতে তিনদিনের ছোট ইন্দুরেখা।
কনক পুষ্পের বর্ণ অঙ্গে শোভে তথা।।
হরিতাল ঘৃষ্ট অঙ্গ বেলা যার মাতা।
বামা প্রখরা গুণ সাগর নাম পিতা।।
ভর্ত্তা দুর্ব্বলা নাম সখি তুঙ্গভদ্রা।
রঙ্গবাটি চিত্ররেখা বিচিত্রা সুসঙ্গদা।।
মোদনী মদনালসা আর রসতুঙ্গ।
অষ্ট সখীর সঙ্গে ইন্দুরেখার সদা রঙ্গ।।
সপ্তমে রঙ্গদেবী হয় সপ্তদিনের ছোট।
পদ্ম কিঞ্জল্ক বর্ণ অঙ্গের সদৃশ।।
জবারাগি বস্ত্র চম্পকলতার সমগুণ।
মাতা করুণা পিতা রঙ্গ বসন।।
পতি তার বক্রক্ষণ ললিতার দেবর।
ভৈরবের ছোট ভাই গুণের সাগর।।
কলকণ্ঠ শশিকলা কমলা মধুরা।
কামলতিকা কন্দর্প সুন্দরী ইন্দিরা।।
প্রেমমঞ্জরী সখী অষ্টমে কহিল ।
অষ্টসখী সঙ্গে রঙ্গদেবী প্রকাশিল।।
রাধিকার অষ্টম সখী সুদেবিকা নাম।
রঙ্গদেবী যমজা ভগ্নী যাহার আখ্যান।।
রঙ্গদেবীর ভ্রম হয় সুদেবী দেখিতে।
বক্রক্ষণের ছোট ভাই পতি এ বিখ্যাতে।।
কাবেরী সুকেশী আর চারু কবোরা ।
মঞ্জুকেশী কামহারি আর মহাহিরা।।
হারাকণ্ঠী মনোহরা এই অষ্ট সখী।
অষ্ট অষ্ট লেখি এই চতুঃষষ্ঠী সখী।।
রাধিকার সঙ্গে হয় এই যূথেশ্বরী।
এমন কতেক আছে গণিতে না পারি।।
গণোদ্দেশদীপিকায় গোসাঞি লিখিল।
সেই অনুসারে আমি দশম রচিল।।
প্রাণসখী রাধিকার শুন মন করি।
নাসিকা কেলি কদলী আর কাদম্বরী।।
শশিক লা চন্দ্ররেখা আর প্রিয়ম্বদা।
মধুরতি বাসন্তী কালভাসি মদন্মদা।।
রত্নাবলী মণি রতি কর্পূর লতিকা।
বৃন্দাবনেশ্বরী হয় সমান বয়কা।।
নিত্য সখী কস্তুরিকা মনোজ্ঞা মণিমঞ্জরী।
শিশুরা চন্দ্রাবতী কৌমুদী সুন্দরী।।
কলানাদি গতা সখী বৃন্দা কুন্দলতা ।
ধনিষ্ঠা গুণমালা নন্দের ঘরে স্থিতা।।
কামদা ধাইর কন্যার নাম ধরি।
শ্রীরাধিকার নিজ দাসি শ্রীগুণ মঞ্জরী।।
প্রিয়নর্ম্ম সখী কহি সেবা পরায়ণি।
দাসি ভাব অভিমান সখি মধ্যে গণি।।
শ্রীরূপমঞ্জরী রঙ্গমালা যার নাম।
রঙ্গবল্লী কহি আর তৃতীয় আখ্যান।।
লবঙ্গ মঞ্জরী আর শ্রীরতিমঞ্জরী।
শ্রীরসমঞ্জরী আর কস্তুরি মঞ্জরী।।
রাগলেখা কলাকেসি তুলসী ভানুবতী।
নান্দীমুখী মঞ্জলালী আর বিন্দুমতী।।
সুহৃৎ পক্ষ সখি খ্যাতি শ্যামলা মঙ্গলা।
প্রতিপক্ষ চন্দ্রাবলি সতিনী ঈর্ষা ধরা।।
গন্ধর্ব কন্যকা নানা নৃত্য গান রঙ্গে।
কলকণ্ঠী সুকণ্ঠিকা সিদ্ধ কণ্ঠী সঙ্গে।।
কলাঙত-কন্যা গায় বিশাখার গীত।
রসোল্লাসা আর সুগন্ধিরার সহিত।।
মালিনীর কন্যা নর্মদা কুসুম সেপলা।
সুগন্ধা নলিনী নাম নাপিত-কন্যকা।।
রজক কিশোরী মঞ্জিষ্ঠা তার নাম।
মানিনী চিত্রানি দুই বণিক আখ্যান।।
মান্ত্রিকী তান্ত্রিকী নাম দৈবজ্ঞ -বনিতা।
কাত্যায়নী নামে সুতি বৃন্দাবনে স্থিতা।।
গ্রামের বাহিরে রহে ভিন্ন কন্যাগণ।
ভৃঙ্গমল্লি মনল্লি পুলিন্দ কন্যাগণ।।
গার্গিমুখী ভৃঙ্গারিকা ব্রাহ্মণের কন্যা।
এই সব সঙ্গে রাধা বৃন্দাবনে ধন্যা।।
সুবল মধুমঙ্গল অর্জুন রক্তক।
রাধাগণে কৃষ্ণগণে সদাই ব্যাপক।।
হেন রাধিকার সহ গোবিন্দচরণ।
যেই জন ভজে সেই মহা ভাগ্যবান।।
তাহার চরণ আমি সদা করি ধ্যান।
তাহার চরণ জল সদা করি পান।।
তাঁর পদরেণু করোঁ মস্তক ভূষণ।
তাঁর ভৃত্য হঞা যেন গোঙাঙ জনম।।
হেন রাধা নাঞি ভজে কৃষ্ণে করে ভক্তি।
সে বড়ি কপটী দম্ভী অতি মূঢ়মতি।।
তিলার্ধেক যেন তার সঙ্গে নাঞি হয়।
আপন নিয়ম কথা কহিল নিশ্চয়।।
এই ব্রজে পাই যেন রাধাকৃষ্ণের চরণ।
সখি সঙ্গে করোঁ যেন চরণ সেবন।।
ওহে প্রাণেশ্বরী মোরে কর অঙ্গীকার।
ব্রজে বাস দিঞা দূর কর দুঃখভার।।
জন্মে জন্মে হয় যেন ব্রজপুরে স্থিতি।
ব্রজের উজ্জ্বল রসে মোর রতি মতি।।
অমৃত সমান ব্রজে যত দ্রব্য হয়।
তাতে লুব্ধ হউ সদা আমার হৃদয়।।
পরম নিভৃত স্থল গোবর্ধন নিকটে ।
সদা বাস করি যেন রাধাকুণ্ড তটে।।
কবিরাজ গোসাঞি আর শ্রীজীব গোসাঞি।
এ সভার অগ্রে যেন মরি এই ঠাঞি।।
ওহে রাধাকুণ্ড আমি করো পরিহার।
একবার মো পাপীরে কর অঙ্গীকার।।
নাম সেবা গুঞ্জা মালা প্রভু যবে দিলা।
সাধ্যসাধন মোরে ইঙ্গিতে কহিলা।।
এই ব্রজলীলা মোর সাধ্য সাধন।
এই রাধাকুণ্ডে বাস পরম কারণ।।
এই কথা সদা মোর জাতি প্রাণধন।
রাধাকৃষ্ণ ধ্যান করি তেজিব জীবন।।
কৃষ্ণের রাসলীলা বৈকুণ্ঠাদি স্থল।
তার মধ্যে সর্ব্বোত্তম মথুরামণ্ডল।।
তার মধ্যে ব্রজভূমি শ্রীবৃন্দাবন।
তার মধ্যে প্রিয় সদা গিরি গোবর্ধন।।
ময়ূর আকৃতি এই গিরি গোবর্ধন।
রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড যুগল লোচন।।
গিরিতটে রাধাকুণ্ড পরম কৌতুকী।
করহ সেবন সদা যে জন বিবেকী।।
অষ্ট সখির অষ্ট কুঞ্জ শোভে অষ্ট দিশা।
ললিতা উত্তর দিশা ঈশানে বিশাখা।।
চিত্রা সখির কুঞ্জ শোভে পূর্ব দিশাতে।
দক্ষিপে চম্পকলতার কুঞ্জ শোভে তাতে।।
রঙ্গদেবীর কুঞ্জ শোভে নৈঋত কোণে।
বায়ব্যে সুদেবী কুঞ্জ অত্যন্ত শোভনে।।
পশ্চিমে তুঙ্গবিদ্যার কুঞ্জ অগন্যে ইন্দুরেখা।
অনঙ্গ মঙ্গরীর কুঞ্জ মধ্যকুণ্ডে দেখা।।
সেই কুঞ্জে নিত্য কৃষ্ণ রাধিকা সহিতে।
জলে জলকেলি করে রাস রসেতে।।
সেই কুঞ্জে একবার যেবা করে স্নান।
তারে রাধাসম প্রেম কৃষ্ণ দেন দান।।
যুগল কিশোর প্রেম সখিগণ সঙ্গে।
কুণ্ডতীরে কুঞ্জমাঝে খেলে নানারঙ্গে।।
ওহে রাধাকুণ্ড মোরে কর অবধান।
শ্রীরূপমঞ্জরী সঙ্গ মোরে দেহ দান।।
তাহার সঙ্গতি হঞা করোঁ কুঞ্জসেবা।
অবশ্য করুণানিধি এই মোরে দিবা।।
নাহি জানো বেদবিধি সাধ্য সাধন।
এই রাধাকুণ্ড মোর সাধন ভজন।।
এই ব্রজে নিত্যলীলা মোর প্রাণধন।
কহিল সুনিয়ম কথা শুন বন্ধুজন।।
গুরুবলে শিষ্য তুমি শুন সাবধানে।
শ্রীদাসগোসোঞির বাক্য পরম কারণে।।
শ্রীদাসগোসাঞি আর রঘুনাথ ভট্ট।
কবিরাজ গোসাঞি হৈলা তার অনুগত।।
কবিরাজ গোসাঞি সব সুখ আস্বাদিলা।
শ্রীদাসগোসাঞির সেবা প্রথমেই কৈলা।।
তাঁর সঙ্গে আমি তবে শ্রীরূপচরণে।
গ্রন্থের নির্য্যাস অর্থ শুনিল তাঁর স্থানে।।
তাঁর অপ্রকটে আসি রাধাকুণ্ড তীরে।
মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলা বুঝিল বিস্তারে।।
শ্রীদাসগোসাঞির গ্রন্থস্তব কল্পবৃক্ষ।
পাইঞা তাহার অর্থ সুধাসার সূক্ষ্ম।।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত তাহার বর্ণন।
শুদ্ধ রাগে গোবিন্দলীলামৃত কথন।।
শিষ্য নিবেদন করে চরণে ধরিঞা।
সেই বৃন্দাবন স্থান চল দেখি যাঞা।
গোলোক কেমন স্থান চল যাঞা দেখি।
বাক্যসাধ্য কিবা হয় শাস্ত্রমাত্র লেখি।।
বৃন্দাবন ব্রজভূম সাক্ষাতে দেখি এ ।
গোলোক হইতে আসি কেবা বিহরয়ে।।
কেবা বৃন্দাবন হৈতে সব অবতীর্ণ।
এই সব কথামৃতে স্নিগ্ধ কর কর্ণ।।
গুরু বলে শিষ্য তুমি শুন একচিত্তে।
বৃ্ন্দাবন ছাড়ি কৃষ্ণ না যান কোথাতে।।
কৃষহন্য যদুসম্ভূতঃ যস্তু গোপেন্দ্রনন্দনঃ।
বৃন্দাবনং পরিত্যজ্য পাদমেকং নর্গচ্ছতি।
যদি এই শ্লোক দৃঢ় করি জান মনে।
সর্ব সংর্ত্তি হয় তার উপাসনা ক্রমে।।
বৃন্দাবনে কৃষ্ণ প্রকট আছেন সদত।
উপাসনা ক্রমে দেখি সিন্ধান্ত বিমত।।
শাস্ত্র আজ্ঞা কোনো কোনো বিপাক ক্রমেতে।
গোলোকে সদত বাস লেথে চরিতামৃতে।।
বড়ই দুর্গম সেই বুঝনে না যায়।
বড়ই নিগূঢ় যাতে রূপের আশ্রয়।।
পূর্ণ ভগবান কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রকুমার।
গোলোক বৃন্দাবন সহ নিত্য বিহার।।
ব্রহ্মার একদিনে তিহোঁ একবার।
অবতীর্ণ হঞা করে প্রকট বিহার।।
ব্রহ্মার একদিনে তিহোঁ প্রকট হইঞা।
বিহার করয়ে ব্রজে ব্রজবাসী লঞা।।
এই গৌণ অর্থ মুখ্য অর্থ শুন কহি।
মুখ্য কৃষ্ণ ভগবান পূর্ণত্তম সেহি।।
পূর্ণত্তমৈশ্বর্য্য লোলোক প্রবেশই ।
প্রকটাপ্রকট এই বৃন্দাবনে রই।।
সূর্য্য আচ্ছাদয়ে যেন দারুণ গ্রহেতে।
বৃন্দাবনে অন্তর্ভুত রহে তেন মতে।।
বিবস্বত নাম এই সপ্তম মন্বন্তরে।
সাতাইশ চতুর্যুগ গেল তাহার অন্তরে।।
অষ্ট বিংশ চতুর্যুগ দ্বাপরের শেষে।
ব্রজের সহিত হয় কৃষ্ণের প্রকাশে।।
তবেত ত্রিবিধ লোক জানয়ে আনন্দে।
নন্দঘোষ পুত্র কৃষ্ণ এই অনুবন্ধে।।
উপাসনা ক্রমে জানি তাঁহার মহিমা।
অতএব সূর্য্য তার দিয়েত উপামা।।
শাস্ত্রে বলে পৃথিবীর ভার সহিবারে।
অবতীর্ণ হৈলা কৃঞ্চ বসু নন্দ ঘরে।।
অতএব বৃন্দাবন সামান্য জ্ঞান করি।
ক্ষিরোদবশায়ী যেই শ্রেষ্ঠ করি ধরি।।
ভগবান জন্ম তাথে লোক ব্যাকুল হঞা।
বৃন্দাবনে লীলা শুনে বিশ্বাস করিঞা।।
সরোবরে নানা পুষ্প পদ্ম উৎপল আদি।
বকের শম্বুক ভক্ষ্য আস্বাদি বিবাদি।।*
*ইহার পর অতিরিক্ত–
(আর এক কৃষ্ণের আজ্ঞা বড়ই প্রমাদ।
বৃন্দাবন প্রাপ্তি কারো নহে অবসাদ।।)
কৃষ্ণের যদ্যাপি ইচ্ছা ভক্তি মুক্তি দিঞা।
কভু প্রেমভক্তি না দেন রাখে লুকাইঞা।।
কোনো ভাগ্যে রূপে কৃপা করে রঘুনাথে।
শ্রীগোপাল লোকনাথ দাস রঘুনাথে।
শ্রীসনাতন গোসাঞির করুণা হয়ে যারে।
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ যদি কৃপা করে।।
শ্রী (জীব) গোসাঞির চরণ মাত্র সার।
তবে পাবে ব্রজলীলা রস বুঝিবার।।
নহে এক ফের আছে বুঝনে না যায়।
গোলোকে বৃন্দাবনে কেহো কেহো পায়।।
অন্যের কি কথা রাধাকৃষ্ণ ভজন যে করে।
সেহ রাধাকৃষ্ণ দেখে গোলোক ভিতরে।।
দৈবকীর উদরে (মাত্র) জন্মিলা ভগবান।
বসুদেব লঞা গেল যশো সন্নিধান।।
রাত্রে মাইতে যমুনার জলে প্রবেশিলা।
বসুদেব ইচ্ছায় শিশু কোলে পুন আইলা।।
যশোগর্ভ ধরিয়াছে সর্বলোক মতে।
উদর পূর্ণিত কিবা নাহিক তাহাতে।।
মায়াদেবী রোদন করে নিদ্রাতে যশোদা।
বসুদেব ঘরে দেখি কন্যকা প্রমদা।।
কাহারে রাখিল ইহা কিছুই না জানে।
কন্যা লঞা বসুদেব করিলা গমনে।।
পূর্ণত্তম হই তবে তাহে প্রবেশিলা।
সহজ মানুষ যেন দেবী আরোহিলা।।
ধরা নামে যশোমতী সর্বলোক কহে।
ভাদ্র অষ্টমীতে কৃষ্ণ তাঁর পৃষ্ঠে ছোঁয়ে।।
দ্রোণ নামে নন্দ ঘোষ আবির্ভূত হএ।
এই নন্দ যশোদা সর্বলোকে কহে।।
গর্ভবাস নাহি করে স্বতন্ত্র ভগবান।
শাস্ত্রের অশেষ অর্থ লোকের বুঝান।।
যমের যাতনা দুঃখ অল্প করি জানি।
যোনি মুদ্র গর্ভবাস ততোধিক মানি।।
মহা পূণিত পাপ জীবে সদা করে ।
তে কারণে গর্ভবাস পুনঃ পুনঃ ধরে।।
হেন গর্ভবাস যদি ধরিব ঈশ্বর ।
এ সিদ্ধান্ত যে করিল সে বড়ি বর্বর।।
যদি কহে যশো গর্ভে কৃষ্ণ না জন্মিলে।
মাধুর্য্য লীলানুক্রম সিদ্ধান্ত কৈছে বলে।।
অখিল ব্রহ্মাণ্ডেশ্বর সর্বেশ্বর যে।
তার গর্ভবাস ইহা মনে করে কে।।
তার সাক্ষ্য শ্রীভাগবত দশম স্কন্ধে।
দৈবকী উদরে জন্ম সেই লাগে বন্ধে।।
ভূমিষ্ঠ হইলে রূপ চতুর্ভুজ হঞা।
বসুদেব দৈবকীরে কহে প্রবোধিয়া।
বসুদেব দৈবকীর সন্দেহ দূরে গেল।
পায়ের শৃঙ্খল তার খসিঞা পড়িল।।
দ্বারী প্রহরী নিদ্রা যায় অচেতন ।
পুত্রকোলে বসুদেব করিলা গমন।।
ঘোর অন্ধকার রাত্রি মেঘের দুর্দুর।
যমুনা তরঙ্গ দেখি মনে হৈল ডর।।
শৃগালী রূপে চলে আগে মহামায়।
ফণা এতে হুত্র ধরি বাসুকী পাছে ধায়।।
প্রসএ সুত (যেই) সে কি নিদ্রা যায়।
যদি কেহে এই বাক্যে প্রতীত না হয়।।
নিদ্রায় আবিষ্ট যশো বসুদেব ঘরে।
পুত্র রাখি কন্যা লঞা গেলা মধুপুরে।।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত শাস্ত্র পূরাণে ডাকিয়া।।
কহিল যে সব শ্লোক শুন মন দিয়া।।
তস্মাৎ ভগবান কৃষ্ণ যশোদা-গর্ভ-সম্ভবঃ।
তস্যাংশ দৈবকীপুত্রো ভবিষ্যতি চতুর্ভুজঃ।।
গর্ভ সম্ভব কৃষ্ণ এই বাক্য মাত্র।
জন্মিলা উদরে ইহা কহে কোন পাত্র।।
রক্তমাংস ক্লেশ আদি গর্ভ সংমিলনে।
মহাপাপীর গর্ভবাস শুন বন্ধুগণে।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু স্বয়ং ভগবান।
সভে কহে শচীগর্ভে জন্ম তাহান।।
সন্দেহ ছেদন কৈল কবিরাজ গোসাঞি।
সেই কথা মন দিঞা শুন ভক্ত ভাই।।
নবদ্বীপে শচীগর্ভ পূর্ণ দুগ্ধ সিন্ধু।
তাহাতে প্রকট হৈলা কৃষ্ণ পূর্ণ ইন্দু।।
এই সব বাক্যামৃতে যার লোভ হয়।
ব্রজেন্দ্রনন্দন কৃষ্ণ সেই সত্য পায়।।
ঈশ্বরের অচিন্ত্য শক্তি কে বুঝিতে পারে।
ঐশ্বর্য্য প্রকাশ তাতে মাধুর্য্য বিহরে।।
শ্রীলোকনাথ-চরণ স্মরণ অভিলাষ।
গুরু শিষ্য সংবাদ কহে নরোত্তম দাস।।

ইতি শ্রীগুরুশিষ্য সংবাদে উপাস্য উপাসনা তত্ত্বনিরূপণং নাম দশম পট্টল সম্পূর্ণম্‌।।

(ক. বি. ৩২৬ পুথি হইতে আদর্শ পাঠ গৃহীত)