অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ।।
প্রথমে বন্দিব গুরু গোবিন্দ চরণ ।
যার কৃপালেশে হয় বাঞ্ছিত পূরণ।।
অন্ধতা ঘুচয়ে সার করুণা অঞ্জনে।
অজ্ঞান তিমির নাশ করায় যেই জনে।।
তবে বন্দো সাবধানে বৈষ্ণব যার নাম।
এ তিন লোকের পূজ্য দয়া গুণধাম।।
তবে বন্দো ভক্তবৃন্দ রসিক যার হিয়া।
বিকাইলু কিন মোরে পদরেণু দিয়া।।
অদ্বৈত গোসাঞি বন্দো পুষ্য তিনলোকে।
যার করুণায়ে লোক চৈতন্য বলে সুখে।।
দয়ার ঠাকুর বন্দো নিত্যানন্দ রায়।
যার দয়ায় চৈতন্য সুখে গায়।।
দামোদর স্বরূপ বন্দো ঊর্ধ্ব করি কর।
তিহো মহাপ্রভূর দ্বিতীয় কলেবর।।
রায় রামানন্দ বন্দো প্রেমের সাগর।
যাঁর মুখে লীলা শুনিলেন গৌরাঙ্গ নাগর।।
শ্রীবাস পণ্ডিত আদি জত ভক্তগণ।
ভূমিতে পড়িয়া বন্দো সভার চরণ।।
ইহার পর অতিরিক্ত
(শ্রীরূপ গোসাঞি বন্দো সানন্দিত মনে।
যাঁর আশা করি আমি জীবনে মরণে।)
সনাতন গোসাঞি বন্দো জাতি প্রাণধন।
বন্দিব গোপাল ভট্ট পতিত পাবন।।
রঘুনাথ ভট্ট বন্দো সানন্দিত মনে।
শ্রীলোকনাথ গোসাঞি বন্দিব জতনে।।
কর্ণপূর কবিরাজ বন্দো ভূগর্ভ ঠাকুর।
শ্রীজীব গোসাঞি বন্দো প্রেম রসপূর।।
শ্রীরূপ চরণ পদ্ম হৃদয়ে ধরিয়া।
জীবন মরণে লৈলু ইছিয়া নিছিয়া।।
শ্রীদাস গোসাঞির পদ কমলের রেণু।
জীবনে মরণে আর নাই ইহা বিনু ।।
দন্তে তৃণ করি করো এই নিবেদন।
করহ করুণা দৃষ্টি লইল সরণ ।।
বাঙন হইয়া চাঁদ ধরে সুখে গায় গীত।
পঙ্গুতে সাগর লঙ্ঘে অন্ধে করে চিত্র।
সাধুকৃপা লেশ যাহার প্রতি হয়।
এই সব সত্য হয় অসম্ভব নয়।।
তবে বন্দো আচার্য্য ঠাকুর শ্রীনিবাস।
তার পাদ পদ্ম রেণু মোর পঞ্চ গ্রাস।।
কবিরাজ গোসাঞি বন্দো ক্ষাতি কৃষ্ণদাস।
চৈতন্য চরিতামৃত জাঁহার প্রকাস।।
শ্রীঠাকুর মহাশয় বন্দো কবিরাজ ঠাকুর।
জন্মে জন্মে হঙ তোর উচ্ছিষ্ট কুকুর।।
চৈতন্যের ভক্তবৃন্দ অনন্ত অগাধ।
লঘু গুরু ক্রম ভঙ্গে ক্ষেম অপরাধ।।
ঊর্দ্ধবাহু করি করোঁ এই নিবেদন।
শরণ লইনু কর বাঞ্ছিত পূরণ।।
শ্রীব্রজমণ্ডল বন্দো গ্রাম নন্দীশ্বর।
বৃকভানু পুর বন্দো আর গিরিবর।।
কুণ্ড যুগল বন্দো করিয়া জতন।
রাধাকৃষ্ণ যাহা করেন বিলাসন।।
শ্রীবৃন্দাবন বন্দো সানন্দিত মনে।
যাহা আশা করে লোক জীবনে মরণে।।
যোগমায়া বন্দো ভগবতী পৌর্ণমাসী।
ব্রজের পূজিত তিহো সর্বগুণরাশি।।
যুগল কিশোর লীলা যত ইতি হয়।
তাঁহার ঘটনা সব জানিহ নিশ্চয়।।
তাঁর দুই শিষ্যা আছে নামে বীরা বৃন্দা।
বীরা ব্রজে থাকে বৃন্দাবনে বৃন্দা।।
সিন্ধমন্ত্র বৃন্দাকে দিয়াছেন পৌর্ণমাসী।
মন্ত্রবলে বনদেবগণ তাঁর দাসী।
ঐছে দিব্য শক্তি ধরে বৃন্দা ঠাকুরাণী।
দূতী সখী রূপে মিলান কৃষ্ণ জানি।।
রাধাকৃষ্ণ বিহার যতেক বৃন্দাবনে।
বৃন্দাদেবী যত ইতি করে সমাধানে।।
চিন্তামণি ভূমি কল্পবৃক্ষময় বন
নিকুঞ্জ কুটীর মধ্যে করে সুশোভন ।।
থরে থরে তমাল বৃক্ষ বকুলের শ্রেণী।
রত্নবেদী শোভা করে ত্রিভুবন জিনি।।
ষড়ঋতু মূর্ত্তিমান সেবা করে নিতি।
পক্ষিগণ শব্দ করে মনুষ্যের রীতি।।
নানা ফুলে ফলে পূর্ণ সর্ব তরুগণ।
যমুনার ঘাট বান্ধা মাণিক রতন।।
যতেক পুষ্পের শ্রেণী নিব কত নাম।
বৃক্ষমূল বান্ধা সব অতি অনুপাম।।
ময়ূরে করয়ে নৃত্য ভ্রমর ঝঙ্কার ।
শুকু শারি কথা কহে মনুষ্য আকার।।
কপোত ফুৎকার করে কোকিলে রবায়।
বরাগে ধূসর স্থান বহে মন্দ বায়।।
ষোল ক্রোশ বৃন্দাবন চিদানন্দ ময়ে।
বৈকুণ্ঠের পরাৎপর সর্বশাস্ত্রে কয়ে।।
নিরন্তর বৃন্দাদেবী করয়ে সেবন।
বৃন্দার সেবিত তেঞি কহি বৃন্দাবন।।
বৃন্দার কৃপা হইলে বৃন্দাবন প্রাপ্তি।
প্রেম সেবা প্রাপ্তি হয়ে সখি সঙ্গে স্থিতি।।
বৃন্দার চরণ পদ্ম করি য়ারাধন।
তবে সে মঙ্গল হয়ে বাঞ্ছিত পূরণ।।
পৌর্ণমাসী ভগবতি মোরে কর দয়া।
শরণ লইনু মোরে দেহ পদছায়া।।

ইহার পর অতিরিক্ত —
(শ্রীলোকনাথ পাদপদ্ম মনে করি আশ।
স্মরণমঙ্গল কহে নরোত্তম দাস।)

সখির সঙ্গিনী হয়্যা ব্রজে নিত্য দেহ পায়্যা
বস্ত্র অলঙ্কারে বিভূষিত।
সখি সঙ্গে সদা স্থিতি অনুরাগে নিতি নিতি
সেবাতে লাগাব সদা চিত।।
উজ্জ্বল পরকিয়া প্রেম শতবান জিনি হেম
সর্ব শাস্ত্রগ্রন্থ তাহে সাক্ষি।
রাধিকার সখিগণ অসংক্ষ তার গণন
প্রিয় মর্ম্ম সখিগণ লিখি।।
ললিতা বিশাখা তথা চিত্রা চম্পকলতা
রঙ্গদেবী সুদেবিকা জানি।
তুঙ্গবিদ্যা ইন্দুরেখা অষ্ট জন এই লেখা
ইবে শুন প্রিয় সখি গণি।।
শ্রীরূপমঞ্জরি নাম শ্রীরতিমঞ্জরি প্রাণ
শ্রীরসমঞ্জরি মঞ্জলালী।
শ্রীরসমঞ্জরী সঙ্গে লবঙ্গমঞ্জরি রঙ্গে
অনঙ্গমঞ্জরী কুতুহলি।।
কস্তুরিকা আদি সঙ্গে সেবন করিব রঙ্গে
সময় বুঝিয়া অনুসারে।
অনুরাগি হব সদা ডগমগি প্রেম কথা
মনোহর কুঞ্জের মাঝারে।।
রাধিকা চরণ রেণু ভূষণ হউক তনু
তবে সে পাইব কৃষ্ণচন্দ্র।
ব্রহ্মা শিব হলধর লক্ষ্মী আদি অগোচর
যুগল কিশোর প্রেমানন্দ।।
বেদশাস্ত্র আগোচর তিন লোকে পরাৎপর
যোগেন্দ্র মুনীন্দ্র মনলোভা।
উদ্ধব নারদ আদি যাহা বাঞ্ছে নিরবধি
তাতে কি গণিএ অন্য দেবা।।
সখির সঙ্গিনী হই তবে প্রেম সেবা পাই
মনে মনে করিয়া ভাবনা।
সাধন করিব যাহা সিদ্ধ হইলে গাই তাহা
কহিলাঙ এই তত্ত্ব সীমা।।
শ্রীরূপমঞ্জরি সখি কৃপাদৃষ্টে চাহ দেখি
তবে হয় বাঞ্ছিত পূরণ।
দশনে করিয়া তৃণ করোঁ এই নিবেদন
তুয়া পদ লইনু সরণ।।
শ্রীরতিমঞ্জরি প্রাণ তুয়া পাদপদ্ম ধ্যান
দয়া কর লইনু শরণ।
তুয়া কৃপা দৃষ্টি পাই স্মরণ মঙ্গল গাই
কর মোর অভীষ্ট পূরণ।।
ঊর্ধ্ব বাহু করি তোতে যাচো এ অবিরতে
অজ্ঞান মুঞি ক্ষেম অপরাধ।
সকল সখির গণে হইয়া সদয় মনে
মুই জীবে করহ প্রসাদ।।
সূত্ররূপে কহিব ইবে স্মরণ মঙ্গল।
হৃদয়ে চিন্তিয়া রূপ -চরণ-কমল।।
রাত্রিশেষে বৃন্দাদেবি জাগি সখি সঙ্গে।
রাধাকৃষ্ণ রসালস দেখি নানা রঙ্গে।।
রজনি প্রভাত হৈল মনে শঙ্কা পায়্যা।
বৃন্দাদেবী পক্ষগণে বলেন ডাকিয়া।।
পক্ষগণ আজ্ঞা পায়্যা অঙ্গ প্রফুল্লিত।
ভ্রমর ঝঙ্কার শুনি আনন্দিত চিত।
শুকসারি কথা কহে মনুষ্য আকার।
কোকিল পঞ্চমগায় কপোত ফুৎকার।।
ময়ূরের শব্দ শুনি আনন্দিত হিয়া।
নানা পক্ষী শব্দ করে প্রেমে মত্ত হইয়া।।
অনেক যতনে জাগি বৈসে দুইজন।
বৃন্দা সঙ্গে নিকটে আইলা সখিগণ।।
কতেক রসের কথা উথলিল তথি।
বেশ বনাইল কত করিয়া আরতি।।
কক্ষটি বানরি কহে বৃক্ষডালে বসি।
জটিলা আইল হেন অনুমানে বাসি।।
নন্দের মন্দিরে বড় কোলাহল শুনি।
আজি কিবা পরমাদ হয় হেন জানি।।
একথা শুনিয়া সভে শঙ্কিত হৈল।
আশঙ্কায় দোহার বস্ত্র পরিবর্ত্ত করিলা।।
দোহার হৃদয়ে দোহে আকুল হৈল।
দোহার বিচ্ছেদে দোহে গমন করিলা।।
বস্ত্র অলঙ্কার জত সামিগ্র আছিল।
এক এক করি সব সখিগণ নিল।।
ছিন্নহার কেহ (নিল) আচঁলে বান্ধিয়া।
কেহ আনবাটি নিল আনন্দিত হয়্যা।।
কেহো স্বর্ণ ঝারি কেহো তাম্বুল সম্পূট।
স্বর্ণ পিঞ্জর কেহো নিল পুষ্প ঝুটি।।
এই মত সব দ্রব্য সখিগণ লয়্যা।
কুঞ্জের বাহির সভে মেলিল আসিয়া।।
বিচ্ছেদে আকুল দোহে নেত্রে জলধার।
দুহে দোহা আলিঙ্গন করে কত বার।।
কালোচিত কার্য্য তবে কৈল দুইজন।
দুই পথে দুইজন করিল গমন।।
সচকিত নয়নে মন্দিরে দোহে গেলা।
আলসে পালঙ্ক পরি শয়ন করিলা।।
সখিগণ আসি তবে শয়ন করিল।
এই মত এই রূপে প্রাতকাল হৈলা।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদ পদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল এক কালের আক্ষান।।
পৌর্ণমাসী ভগবতী প্রাতঃক্রিয়া করি।
নন্দীস্বরে নন্দালয়ে আইলা শীঘ্র করি।।
ব্রজেশ্বরী দেবী কৈল চরণ বন্দন।
রাণিরে আশিষ করি আনন্দিত মন।।
কৃষ্ণের দর্শন লাগি দুর্হু উৎকণ্ঠিত মন।
কৃষ্ণের শয়ন স্থানে করিল গমন।।
কপাট ঘুচাইয়া দুঁহে কৃষ্ণে জাগাইলা।
পৌর্ণমাসী প্রতি রাণী কহিতে লাথিলা।।
দেখ রামের নীল বসন কেমনে পরিলা।
কপালে গেঁড়ুর দাগ কেবা লাগাইলা।।
স্নেহেতে আকুল রাণি গদগদ বাণি।
দুগ্ধস্রবে বস্ত্রভিজে নেত্রে বহে পানি।।
সাতপাচ নাহি মোর আঁন্ধনার নড়ি।
বনে বনে ষ্ণিরে সদা কি উপায় করি।
বচন না মানে মোর কি করোঁ উপায়।
দারুণ কংসের চর ফিরয়ে সদায়।।
জাগহ গোকুল চান্দ প্রাতঃকাল হৈল।
সঙ্গের বালক সব আঙ্গিনা ভরিল ।।
শুনিয়া নাগরাজ জাগিয়া উঠিলা।
ভগবতী প্রণাম করি বাহিরে চলিলা।।
শ্রীদাম সুদাম দাম সুবল উজ্জ্বল।
বসন্ত কোকিলার্জুন শ্রীমধুমঙ্গল।।
স্তোক কৃষ্ণ ভদ্রাসন আদি জত সখা।
মেলিয়া চলিলা গোঠে তাহার নাঞি লেখা।।
এথা জাবট গ্রামে বৃন্দাবনেশ্বরী।
যেমতে জাগিলা তাহা কহিয়ে বিবরি।।
রাধার মাতার নাম কির্ত্তিকা ভাগ্যবতী।
তার মাতা মুখরা নামে সুস্নিগ্ধ যুবতী।।
বৃকভানু রাজার তিহো হয়েন সাসুড়ি।
রাধার মাতামহি যারে কহি বড়াই বুড়ি।।
অভিমন্যালয়ে আসি দিল দরশন।
নাতিনির দরশন লাগি উৎকণ্ঠিতা মন।।
তারে দেখি জটিলা প্রণাম করিল।
আদর করিয়া কিছু কহিতে লাগিল।।
ইহার পর অতিরিক্ত —
(পৌর্ণমাসীরে আমি কৈল নিবেদন।
পুত্রের পরমায়ু বাড়ে হয় প্রচুর গোধন।।
তাহা শুনি পৌর্ণমাসী উপদেশ দিল।
হেতু কহিতে তিহো বিরলে বসিল।।)
বধূ দিয়া সূর্য্য পূজা করাহ দ্বাদশ বৎসর।
অসংখ্য হইব ধেনু দিবাকর বরে।।
যশোদা রাণীর আজ্ঞা মানিহ যতনে।
পুত্রের পরমায়ু বৃদ্ধ হব ততক্ষণে ।।
তথা আমি সূর্য্য পূজা দিয়াছি বধুরে।
আপন নাতিনে শিক্ষা করাহ সত্ত্বরে।।
এত কহি দুহে গেলা শয়ন মন্দিরে।
কপাট ঘুচাঞা দুহে প্রবেশিলা ঘরে।।
বধুর অঙ্গেতে দেখি পিত বসন।
সসঙ্কিত হয়্যা বলে নিষ্ঠুর বচন।।
আরে আরে বিশাকা কি পরমাদ হৈল।
বধু অঙ্গে পিতবস্ত্র কেমনে আইল।।
কৃষ্ণের অঙ্গের বস্ত্র বধু অঙ্গে কেনে।
ভালে কানাকানি করে হাষে সর্বজনে।।
আমার পুত্রের গৃহে অগ্নি সে জ্বলিল।
এতবলি থরহরি কাঁপিতে লাগিল।।
জটিলার বচন শুনি রাধার সখিগণ।
কাষ্ঠ প্রায় হৈল সভে নাহিক চেতন।।
রাধাপানে দৃষ্টি করি বিশাখা সুন্দরি।
কহিল নয়ানকোনে করিয়া চাতুরি।।
জটিলারে আড় করি দাণ্ডাইল আসি।
রাই অঙ্গে নিলবস্ত্র পরাইল দাসি।।
তবে কহে বিশাখা শুন ঠাকুরাণি।
বৃদ্ধ হৈলে বুদ্ধি স্বল্প হয় (তাহা) জানি।।
পিতবস্ত্র কাঁহা তুমি দেখিলে বধু অঙ্গে।
বিচারিয়া নাঞি কহ কুবুদ্ধি তরঙ্গে।
তবেত লজ্জিত হৈলা দেখি নিলাম্বর।
নিঃশব্দ হইয়া তবে গেলা নিজ ঘর।।
সখি সব সুচতুরা হাসিতে লাগিল।
বৃষভানু সুতা তবে বাহিরে আইল।।
প্রেম সেবা পরমানন্দে কৈল সখিগণ।
মুখ প্রক্ষালন কৈল সুগন্ধি উর্দ্ধতন।।
নানা রস কথা কহি করাইল স্নান।
বস্ত্র অলঙ্কারে বেস কতেক বন্ধান।।
তবে ব্রজেস্বরি কুন্দলতা পাঠাইল।
বলিহ জটিলা আগে সন্দেশ কহিল।।
দুর্ব্বাসার বরে রাধার মিষ্ট হস্ত হয়।
তার হস্ত স্পর্শ খাইলে পরমায়ু বাঢ়য়।।
আমার বালকের মন্দক্ষুধা দেখি ।
কৃপায়ে কহিল মোরে গৌর্ণমাসি সখি।।
জটিলার পায়ে মোর করিহ নিবেদন।
আনহ রাধারে শীঘ্র সঙ্গে সখিগণ।।
যসোমতি আজ্ঞা পায়্যা আসি কুন্দলতা।
জটিলায়ে প্রণাম করি নিবেদিল কথা।।
তার আজ্ঞা পায়্যা রাধা সখিগণ সঙ্গে।
আইলেন সখি সঙ্গে নানা কথা রঙ্গে।।
আসিয়া রাণির পায়ে প্রণাম করিল।
আশীর্ব্বাদ করি রাণি কহিতে লাগিল।।
রোহিনির সঙ্গে পুত্রী করহ রন্ধনে।
এতবলি চাঁদমুখে করিল চুম্বনে।।
ললিতা বিশাখা আদি সব সখিগণ।
আলিঙ্গন করি রাণী কহিল বচন।।
মিষ্টান্ন পক্কান্ব কর জত সিখিরিনি।
মনোহরা নাড়ু আদি করে শুভ্রফেনি।।
নিজজিয়া যশোদারানি করিল গমন।
রন্ধনে চলিল রাই আনন্দিত মন।।
আপন আপন কর্য্যে সভেই সত্তর।
কৃষ্ণ আনাইল রাণি আনন্দ অন্তর।।
ভৃত্যগণ লাগিল তবে করিতে সেবন।
স্নান করি পরাইল বস্ত্র বিভূষণ।।
ভোজন করিতে তবে করিলা গমন।
দেখি আনন্দিত হৈল সব সখিগণ।।
রামকৃষ্ণ সখাগনে ভোজনে বসিলা।
যশোদারানি মিষ্টান্ন পক্কান্ব আনাইলা।।
সুবর্ণ থালেতে করি সভাকারে দিল।
আনন্দ করিয়া তবে সখাগণ খাইল।।
তবে অন্নব্যঞ্জন আনি দিল রাধা।
নানা মত সুগন্ধিত কি কহিব কথা।।
তিল শড়শটি ব্যেঞ্জন কতেক প্রকার।
মধুমঙ্গলের হাস্যকৌতুক অপার।।
ব্যেঞ্জন প্রশংসা করি করিল ভোজন ।
আচমন করি কৈল তাম্বুল ভক্ষণ।।
রতন পালঙ্ক উপরি করিলা শয়ন।
আনন্দে প্রেম সেবা করে দাসগণ।।
তবে ব্রজেশ্বরী বহু আগ্রহ করিয়া।
সখি সঙ্গে রাইকে ভোজন করাইয়া।।
পুত্রের বিভার লাগি বস্ত্র অলঙ্কার।
অভিলাষ করে রানি কতেক প্রকার।।
সেইসব অলঙ্কার অমূল্য বসন।
রাধিকাকে পরাইল করিয়া যতন।।
প্রত্যেকে প্রত্যেকে দিলেন সখিগণে।
সিন্দুর তাম্বুল দিল আনন্দিত মনে।।
শ্রীরূপমঞ্জরি গাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল দুই কালের আখ্যান।।
হেনকালে সিঙ্গা বেণু বাজিতে লাগিল।
উৎকণ্ঠিত ব্রজবাসি দেখিতে আইল।।
কিবা সে মোহন বেশ ত্রিভুবন জিনি।
পুষ্প গুঞ্জা ময়ূর পুচ্ছ চুড়ার টালনি।।
অঙ্গ বিভূষিত কৈল রত্ন অভরণ।
কিঙ্কিণী কটিতে ধটি পীত বসন।।
চরণে নূপুর বাজে সবাঁঙ্গে চন্দন।
এই মত বেশ বনাইল সখিগণ।।
যশোদা আকুল হয়্যা কাঁদিতে লাগিলা।
কোলে করি চান্দ মুখে কোটি চুম্ব দিলা।।
বলরামের হাতে হাতে কৈল সমর্পণ।
সিঙ্গা বেণু আগে পিছে বাজায় সখাগণ।।
কৃষ্ণ বলরাম তবে করিল গমন।
এথা ব্রজবাসীগণে উঠিল ক্রন্দন।।
প্রাণধন বনে গেলা কি কাজ গৃহবাসে।
অন্যোন্বে প্রবোধিয়া লইল আত্তাসে ।।
ঘরে আসি ব্রাহ্মণ শতেক বোলাইল।
পুত্রের কল্যাণে দান করিতে লাগিল।।
বনে প্রবেশিয়া কৃষ্ণ সখাগণ সঙ্গে।
নানা খেলা গোচারণ করে নানা রঙ্গে।।
স্থানে স্থানে সখাগণে নিযুক্ত করিল।
সুবল মধুমঙ্গলে কহিতে লাগিল।।
আমরা মাধবী ফুল চল যায়্যা তুলি।
এতবলি কুণ্ডতীরে আইলা কুতূহলী।।
রাই দরশন লাগি বিষাদিত মন।
এথা নিজালয়ে রাই করিলা গমন।।
কুন্দলতার হাথে ধরি কহিল যশোদা।
জটিলার আগে মোর নিবেদিবে কথা।।
মোর পুত্রেরে যেন করেন আশীর্ব্বাদ।
পুত্রের কল্যাণ হয় তাহার প্রসাদ।।
রাণী আজ্ঞায় কুন্দলতা জাবট আসিলা।।
জটিলার আগে আসি কথা নিবেদিলা।।
বধুকে সমর্পিলু আমি তোমার হাতে ।
শীঘ্র যায়্যা সূর্য্যপূজা করাহ ত্বরিতে।।
এত কহি জটিলা নিজ কার্য্যে গেলা।
ললিতা তুলসী প্রতি কহিতে লাগিলা।।
বৃন্দাবনে যাহ তুমি কৃষ্ণ অন্বেষণে ।
আমরা আসিতেছি সূর্য্য পূজা স্থানে।।
মালা পান বিড়া তাঁরে করিল সমর্পণে।
মিলন সঙ্কেত কথা জানাবে জতনে।।
শীঘ্র আসি সমাচার কহিবে আমারে।
রাই লয়্যা জাই যেন সভে কুঞ্জান্তরে ।।
তারে পাঠাইঞা রাই সখিগণ সঙ্গে।
সূর্য্যপূজা ছলে রাই চলিলেন রঙ্গে।।
মদন কুতুহলি কুঞ্জে সঙ্কেত করিয়া।
তুলসী মিলিল আসি মালা বিড়া দিয়া।।
কৃষ্ণ অনুরাগে রাই মন্থর গমনে।
পাঞা হৃদ্য কথা কহে বিশাখার সনে।।
হেনকালে তুলসী আসিয়া মিলিল।
কৃষ্ণের মিলন কথা সকল কহিল।।
কৃষ্ণ দিয়াছেন গলার গুঞ্জা হার।
সমর্পণ করিলেন হস্তে ললিতার।।
চন্দ্রাবলীর সখির কথা সকলি কহিল।
শুনিয়া যতেক সখি হাসিতে লাগিল।।
রাধিকার হিয়ায় হার দিলেন ললিতা।
হার স্পর্শে যত সুখ কি কহিব কথা।।
কৃষ্ণ অনুরাগ উথলিল শতগুণ।
সূর্য্যেরস মণ্ডপে আসি হৈয় উপসন্ব।।
সূর্য্যেরে প্রণাম করি বাহির হইলা।
সঙ্গের লোক সব কহিতে লাগিলা।।
তোমরা মণ্ডপে থাক সামিগ্র আগুলি।
আমরা পূজার লাগি আনি পুষ্প তুলি।।
এত কহি রাধা কুণ্ডে সখিসঙ্গে আইলা।
নানাভাবে ভেট ধরি কৃষ্ণের মেলিলা।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল তিন কালের আক্ষান।।
শ্রীরূপমঞ্জরি চারু চরণ কমল।
স্মরণ করিয়া কহি এই মোর বল।।
ছন্দ বন্ধ যত কিছু নাহি মোর জ্ঞান।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম এই মোর ধ্যান।।
কদর্য্য স্থানের জল কোন বা অজ্ঞানে ।
লোটাভরি শালগ্রামে করায়েন স্থানে ।।
সাধুজন সেই জল পাইয়া কুতুহলি ।
মস্তকে ধরয়ে তারা চরণামৃত বলি।।
সাধু পদধূলি মোর মস্তকে ভূষণ।
করহ করুণা মুই লইনু সরণ।।
মধ্যাহ্নকালের কথা কহিব সূত্ররূপে।
মধ্যাহ্ন মিলন দূঁহার হইল যে রূপে।।
দোহার দরশনে দ্বোহার আনন্দিত মন।
দরিদ্র পাইল যেন ঘরভরা ধন।।
পুষ্পদান ছলে দ্বোহার বচন চাতুরি ।
কিল-কিঞ্চিত ভাবে আনন্দ দোহারি।।
তবে কুন্দলতাছলে পুরোহিত হইল।
পূজার বিধান রাই অঙ্গে শিখাইল।।
কৃষ্ণচন্দ্র পূজা যে আছিল মনে।
ঝুলনা খেলিল তবে সঙ্গে সখিগণে ।।
অষ্টদিকে অষ্টকুঞ্জে সখি নামে খ্যাতি।
রক্তপিত চিত্র শ্বেত শ্যাম নীল জুতি।।
কৌতুকে যে কুঞ্জে যবে প্রবেশ করেন।
কুঞ্জের আভাষে তবে সে বরণ ধরেন।।
সখিগণ সেই বর্ণ পুষ্প ফল লতা।
প্রতি কুঞ্জে এই মত জানিহ সর্ব্বথা।।
উদ্যান বিহার করি জলক্রীড়া কৈল।
বস্ত্র অলংকার পরি কুঞ্জেরে আইল।।
সখিগণে ক্রীড়াছলে বংশী চুরি কৈল।
বংশী হারাইয়া কৃষ্ণ ব্যাকুল হইল।।
তবে বংশী পাইল কৃষ্ণ রাধিকার স্থানে।
মিষ্টান্ন পকান্ব আদি কৈল মধুপানে।।
তাম্বুল ভক্ষণ করি করিল শয়ন।
সখিগণ কৈল তবে বিবিধ সেবন।।
সতৃষ্ণ হইলা দুহেঁ ক্রীড়ারসে।
নিমগন ভেল দোঁহে মদন বিলাসে।।
রতন বেদীর পরে জাগিয়া বসিলা।
তবে সখিগণ সেবা করিতে লাগিলা।।
নানা রস নানা খেলা করে দুই জনে।
বৃন্দাদেবি সেবা করে বিবিধ সেবনে।।
সারি সুক কথা কহে বসি বৃক্ষডালে।
সখি সঙ্গে দুই জন শুনে কুতুহলে।।
তবে বিদায় হৈয়া রাই গেলা সূর্য্যালয়।
পুরোহিত না পাইলাঙ কুন্দলতা কয়।।
বৃদ্ধালোক বোলে এত বিলম্ব কেনবা।
ললিতা বলিল তুমি প্রত্যায় না যাবা।।
পথ হারাইয়া ফিরি কুঞ্জের মাঝারে।
বড় পুণ্যে আইলাঙ কহিলাঙ তোমারে।।
ব্রাহ্মণ আইলে হয় পূজার বিধান।
পূজা হৈলে গৃহে যাই হইল অবসান।।
তবে কুন্দলতা কহে কি করি উপায়।
এক ব্রহ্মচারি আছে বিশ্বকর্ম্মা রায়।।
মাথুর ব্রাহ্মণ সেই গর্গ মুনির শিষ্য।
বৃদ্ধালোক কহে যাহা তাহার উদ্দেশ্য।
তবে কুন্দলতা গিয়া তাহারে আনিল।
নাগরশেখর কৃষ্ণ ব্রহ্মচারি হৈল।।
তারে দেখি বৃদ্ধালোক দণ্ডবত কৈল।
ব্রহ্মচারি বৃদ্ধলোকে কহিতে লাগিল।।
তোমার বধুর নাম কহ দেখি শুনি।
বৃষভানু কুমারী রাধা কহিল বৃদ্ধানি।।
ব্রহ্মচারি বলে (আমি) আশ্চর্য্য শুনিল।
পতিব্রতা বলি যার ব্রজে খ্যাতি হইল।।
আমি ব্রহ্মচারি তিহো সাধ্বী পতিব্রতা ।
মিত্রপূজা করাব শুনাব ধর্মকথা।।
ব্রহ্মচারি দেখি বৃদ্ধলোক আনন্দিত।
ও রূপ লাবণ্য দেখি হইল বিস্মিত ।।
পূজা করি ব্রহ্মচারি বাহিরে আইলা ।
সভা উচ্চারি নাম আশীর্ব্বাদ দিলা।।
তবে বৃদ্ধালোক বলে শুন মহাশয়।
বধর হস্তখানি দেখ হইয়া সদয়।।
এত শুনি বিষ্ণু স্মরে ব্রহ্মচারী।
কুশাগ্রে স্ত্রীর স্পর্শ আমি নাহি করি।।
কিন্তু ঞিহো পতিব্রতা মিত্র পূজা রতা।
হস্ত পদ্ম দেখি কহি শাস্ত্রমত কথা।।
হস্ত দেখি কহে সব বিবরণ কথা।
দেখিয়া কহিল সব আনামত বার্ত্তা।।
শুনি বৃদ্ধালোক বলে আনন্দিত মনে।
সূর্য্য পূজা করাহ নিতি আসিয়া আপনে।।
রাধিকাকে জানিহ আপন দাসি করি ।
আশির্ব্বাদ করিবেন শুন ব্রহ্মচারি।।
এত বলি ব্রহ্মচারি বিদায় করিলা।
নৈবেদ্য কথক মধুমঙ্গলে বান্ধিল ।।
কৃষ্ণ গেলা গোবর্দ্ধন গোচারণ স্থানে।
এথা রাই নিজালয়ে করিলা গমনে।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল চারি কালের বিধান।।
তবে কৃষ্ণ গেলা নিজ সখার সহিতে।
মুরুলিতে গাভিগণ লাগিলা ডাকিতে।।
তৃণমুখে গাভিগণ নিকটে আইলা।
গাভিগণ চারিদিগে কৃষ্ণ মধ্যে হৈলা।।
বলরাম হাসি কহে মধুমঙ্গলেরে।
বস্ত্রে বান্ধা কিবা দেখি দেখাহ আমারে।।
তিহো কহে কোন দ্রব্য আছে মোর স্থানে ।
তাহা শুনি নিকট আইল সখাগণে।।
লুটিয়া লইল সব সূর্য্যের প্রসাদ।
মধুমঙ্গল পালাইল করি আর্ত্তনাদ।।
তবে কৃষ্ণচন্দ্র কাড়ি লৈতে নিষেধিল।
আনন্দ কৌতুকে সভে গৃহেতে চলিল।।
মধুমঙ্গল বলে শাপ দিব সভাকারে।
নহে পেট ভরি দুগ্ধ খাওাহ আমারে।।
বলরাম বলে এই বিটোল ব্রাহ্মণ।
নাহি জানে ক্রিয়া ধর্ম্ম উদর পরায়ণ।।
এইমত নানা কৌতুক সখাগণ সঙ্গে।
সিঙ্গাবেণু বাজাইয়া চলে নানা রঙ্গে।।
এথা রাই সখি সঙ্গে গৃহেতে আসিয়া।
কৃষ্ণ লাগি মালা গাথে আনন্দিত হয়্যা।।
না (না) উপহার কৈল সব সখিগণ।
ময়লাবিড়া মৃগমদ সুগন্ধি চন্দন।।
তবে রাই স্নান কৈল সুগন্ধিত জলে।
বস্ত্র অলঙ্কার সাজে মুক্তহার গলে।।
একত্র হইল সভে বেশের ভবনে।
কমনিয় বেশ বনাইল সখিগণে ।।
কৃষ্ণ অনুরাগে রাই বিশাখার সঙ্গে।
নানা ভাবে পুর্ণ তনু প্রেমের তরঙ্গে।।
তবে রাই করিলেন অট্টালিকা আরোহণ।
হেনকালে কৃষ্ণ আসি দিল দরশন।।
তবে কৃষ্ণ সখাসনে আনন্দিত মনে।
মনমথ মনমথ রূপে করেন গমনে।।
সিঙ্গা বাজে বেণু বাজে চলয়ে নিশান।
হামা রব বই কন নাহি শুনি আন।।
নানারস পরসঙ্গে কথার চাতুরি।
ত্রিভঙ্গ হইয়া খেলে বাজায় মুরুলি।।
সখাগণ সঙ্গে কৃষ্ণ রসের সাগর।
গরগর ভাবিনি ভাবেতে অন্তর।।
মোহন মুখের শোভা দেখিয়া ভাবিনী।
নাহি জানি কিবা হইল দিবস রজনী।।
রাইমুখ হেরি কৃষ্ণ গরগর হিয়া।
দুহুক অন্তর সুখ লইলু নিছিয়া।।
নয়ানের কোলে কত রসের চাতুরি ।
প্রফুল্লিত সখিগণ দুহু মুখ হেরি।।
তবে কৃষ্ণ নন্দীশ্বরে করিলা গমন।
কৃষ্ণ হেরি ব্রজবাসী আনন্দিত মন।।
নাছে আনি পুন চিত্র সুবর্ণ কলসি।
রত্ন পরি আম্রশাখা দিয়া ব্রজবাসী।।
কাঞ্চন থালির উপর জ্বালি দীপ শ্রেণী।
বাদ্যভাণ্ড বাজে আনন্দিত যশোরাণী।।
কৃষ্ণ বলরাম হেরি আনন্দ অন্তর।
কত কত লক্ষ লক্ষ চুম্ব দিল বদন উপর।।
মঙ্গল আরতি তবে আনন্দে করিল।
রামকৃষ্ণ রত্ন সিংহাসনে বসাইল।।
উত্তম আসনে বসিলা সখাসনে।
ভৃত্যগণ লাগি গেল বিবিধ সেবনে।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল পঞ্চ কালের আখ্যান।।
কৃষ্ণ গেল নিজালয়ে সখি সঙ্গে রাই।
যে ক্রিয়া কৈল তাহা সূত্ররূপে গাই।।
অট্টালিকা হৈতে রাই আইল নিজগৃহে ।
বিশাখার সঙ্গে কৃষ্ণ অনুরাগ কহে।।
অমৃত কোন আদি যত মিষ্টান্ব পক্কান্ব।
মালবিড়া চন্দন লাড়ু কতেক বন্ধান।।
তুলসির হাথে দিয়া ললিতা পাঠাইলা।
ধনিষ্টার হাতে দিহ তাহারে কহিলা।।
সঙ্কেত তত্ত্ব জানি আসিবে সকালে।
নিজ সখীসনে তিঁহো গেলা কুতুহলে।।
ধনিষ্ঠার হাতে হাতে সব সমর্পিলা।
গোবিন্দ আনন্দ কুঞ্জে সংকেত জানিলা।।
পালঙ্কে বসাইয়া রাই পান খান রঙ্গে।
রসকথা সখি সঙ্গে প্রেমের তরঙ্গে।।
তবে কৃষ্ণ চন্দ্র মুখ দেখে যশোরানী।।
গদগদ কথা কহে নেত্রে বহে পানি।
কোন বন গিয়াছিলে বাপু গুণমণি।
না দেখিয়া তোমার মুখ আকুল পরাণী।।
যশোদার স্নেহ দেখি পাষাণ বিদরে ।
তাহার প্রেমের কথা কে কহিতে পারে।।
তবে কৃষ্ণ স্নান কৈল সুবাসিত জলে।
বস্ত্র অলঙ্কার পরিলেন কুতুহলে।।
তবে রাণী রামকৃষ্ণ হস্তে ধরি নিলা।
গৃহমধ্যে সিংহাসনে দোহে বসাইলা।।
সখাগণ বসিলেন চৌদিগে বেড়িয়া।
যশোদা খাবার দ্রব্য দিলেন আনিয়া।।
নানা হাস্য পরসঙ্গে ভোজন করিলা।
তাম্বুল ভক্ষণ করি তুরিতে চলিলা।।
গঙ্গা যমুনা গাভি আপনে দুহিলা।
যেই গাভি যেমত তেমত দুহিলা।।
নানারস পরসঙ্গে সখাগণ সঙ্গে মিলি।
পুনরূপি গৃহে আইলেন কুতুহলী।।
যত্ন করিয়া রাণী করাল্যা ভোজন।
পালঙ্কে বসিলা তবে সঙ্গে সখাগণ।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল ষষ্ট কালের আক্ষান।।
তবে কৃষ্ণ সখাসঙ্গে সানন্দিত মনে।
রাজসভা প্রতি গেলা বলরাম সনে।।
নন্দ আনন্দিত হৈল দেখি পুত্র মুখ।
সভা সহ পাত্র মিত্র পাইল বড় সুখ।।
কৃষ্ণ রামে নন্দরাজ কোলে বসাইল।
গুণীগণ নৃত্যগীত করিতে লাগিল।।
নানা যন্ত্র তাল বাজে শুনিতে মধুর।
ভাটগণ ছন্দ পড়ে অমৃতের পুর।
সেই সুখে নন্দ প্রেম সমুদ্রে ডুবিলা।
হেনকালে যশোরাণী মনুষ্য পাঠাইলা।।
যশোদার সমাচার সকল কহিল।
যত্ন করি দুই ভাই গৃহে আনাইল।।
অনেক জতনে করাইল্য ভোজন।
তাম্বুল ভক্ষণ করে সব সখাগণ।।
আসন করি তবে বসিলা আসনে।
পরিচর্য্যা করিতে লাগিল দাসগণে।।
রত্ন টুঙ্গি মধ্যে তবে করিল গমন।
ফুল শয্যা পরি তবে করিলা শয়ন।।
ভৃত্যগণ পরিচর্য্যা করিতে লাগিল।
মধুমঙ্গল শয়ন করিলা বলরাম সঙ্গে।
দুইজন বাক্য যুদ্ধ প্রেমের তরঙ্গে।।
তবে রাণী বিদায় দিল দাস দাসীগণে।
নিজালয়ে দাস দাসী করিলা শয়নে।।
দশদণ্ড রাত্রি শেষে রসিক শেখর।
করিলেন অভিসার কুঞ্জের ভিতর।।
বৃন্দাবনে আসি কৃষ্ণ সঙ্কেত স্থানে।
নানা মনোরথে কৈল শর্য্যার রচনে।
প্রেমে আকুল চিত্ত উৎকণ্ঠিতা হয়্যা।
রাই আগমন পথে রহিল বসিয়া।।
এথা বিনোদিনী রাই সখিগণ সঙ্গে।
সখি সব বেশ বনাইল নানারঙ্গে।।
জ্যোৎস্না অন্ধকার রাত্রি যখন যে হয়।
সেই অনুরূপ বেশ সখিতে রচয়।।
ও চান্দ মুখের হাসি কনক দাপুনি।
সুরঙ্গ নয়ান কোনে চঞ্চল চাহনি।।
অধর সুরঙ্গিম বান্ধুলি ফুল জিনি।
তিল পুষ্প সম নাসা বেষর দুলনি।।
মৃগমদ বিন্দু চিকুরে গোবিন্দ চিত চোরা।
হেমাব্দ দান যেন অলি সিসু ভোরা।।
কর্ণ যুগলে মণি অটঙ্গ বিরাজে।
মৃগমদ চিত্র কপালে ভাল সাজে।।
কপালে সিন্দুর বিন্দু চন্দনের রেখা।
কালিন্দি কিনারে যেন অর্ক বিন্দু দেখা।।
চিকুরে বনয়্যা পাটি বেণি ফনা খানি।
ফণা ধরি রহে যেন এ কাল সাপিনী।।
পিঠে লটকায় বেনী রঙ্গ আধ গাঁথা।
কনক কপালে যেন নিলমণি বাতা।।
গলাতে হাঁসুলি গাছা মণি মনোহর।
জিঁজির পদক আদি কতেক প্রকার।।
কনক কেশর জিনি তনু বিরাজিত।
নীলমণি শোভে কত ভূষণে ভূষিত।।
গুঞ্জরী ঘুঁমুর বঙ্ক মল পাতা মলে।
জাবক বিচিত্র শোভা চরণ কমলে ।।
কৃষ্ণ প্রেমে ডগমগি নীলপদ্ম হাথে।
কৃষ্ণ-প্রেম -মই রাই কি বলিব তাথে।।
নবীন যৌবনী ধনি ত্রিভূবন জিনি।
রম্ভা গৌরী শচী রতি রূপের নিছনি।।
সঙ্গোপনে সখিসনে চলিলা সুন্দরী।
বৃন্দাবন কুঞ্জমধ্যে যথা গিরিধারী।।
নানামত মিষ্টান্ন চন্দন বনমালা।
সুবাসিত জল নিল সুবর্ণ পিঞ্জরা।।
রতন ঝাঝরি নিল জত ইতি হয় ।
কৃষ্ণ অভিসারে রাই করিলা বিজয়।।
দশদণ্ড রাত্রি শেষে গুপতে চলিলা।
অনুরাগি হয়্যা বৃন্দাবনে প্রবেসিলা।।
নানা বৃক্ষ বন শোভা তমালের ছায়া।
নিঃশব্দে চলিল রাই বনে প্রবেসিয়া।।
নন্দীস্বরের পূর্ব্বভাগে বৃন্দাবন স্থান।
আঠার ক্রোশ পথ তাথে আছে পরমান।।
তথি বৃন্দাবনে হয় আশ্চর্য চরিত।
লীলা অনুসারে হয় স্থান সঙ্কোচিত।।
কতরূপে ফলমূল দেখিতে সুন্দর।
নানা শব্দ পক্ষিগণের শুনিতে মধুর।।
মধ্যে মধ্যে রত্ন বেদী বিচিত্র বন্ধান।
কুঞ্জে দাসীগণে সেবা করে অবিশ্রাম।।
কৃষ্ণ কথা পরসঙ্গে মন্থর গামিনী।
নিকুঞ্জের মাঝে প্রবেশিলা বিনোদিনী ।।
কৃষ্ণর দরশন পায়্যা আনন্দিত মন।
পুষ্প বরিসন কৈল জত সখিগণ ।।
দুহুঁ মুখ হেরি দোহে কৈল আলিঙ্গন ।
দরিদ্র পাইল যেন ঘরভরা ধন।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল সপ্ত কালের বিধান।।
দুহুঁ দ্বোহা দরশনে নিমগন ভেলি।
দরশ পরশ দুহু করু কত কেলি।।
বদন চাঁদ দুহুঁ নয়ন চকোর।
অধর মধুপ সুখ কমলিনি ভোর।।
স্তনযুগ কলস সম জান।
শ্যাম হৃদয়ে করু চকোর সন্ধান।।
এইরূপে নানামত মনমথ কেলি।
শ্যাম মরকত রাই চম্পক কলি।।
তবে রত্ন বেদি পর বসিলা দুইজন।
করিতে লাগিলা বৃন্দা বিবিধ সেবন।।
ললিতা বিশাখা আদি জত সখিগণ।
হাস পরিহাস কথা প্রেম আলাপন।।
তবে বন বিহরণ করিলা দুইজন।
পুষ্প বরিষণ কৈল সব সখিগণ।।
রাইর দক্ষিণ কর ধরি বনমালি।
কুঞ্জে কুঞ্জে উদ্যান করয়ে নানা কেলি।।
কতেক প্রকার নৃত্য করিলা দুইজন।
বসিয়া দেখেন নৃত্য করে সখিগণ।।
পুনরূপি সখিগণ রাইকে নাচাইলা।
কত জন্ত্রে তান কৃষ্ণ আপনে বাজাইলা।।
শ্রমভরে দুইজন বসিলা আসনে।
নানা সেবা করিতে লাগিলা সখিগণে।।
তাম্বুল জোগায় কেহ চামর ঢুলায়।
দুহুঁরূপ নিরখিয়া কেহ গুন গায়।।
পরম আনন্দে দোহেঁ চরণ পাখালে।
বহু বহু করি সেবা মোছায় অঞ্চলে।।
কমনীয় বসনে করু শ্রীঅঙ্গ মার্জন।
কেহ কেহ মালা দেই সুগন্ধি চন্দন।।
নানা বিধি মিষ্টান্ন পক্কান্ব দিয়া।
আম্র পনস রম্ভা অর দুগ্ধ খোয়া।।
নারিকেল সস্য ছেনা অমৃত মধুর।
কমলা নারেঙ্গ আর মধুর খর্জ্জুর।।
দধি দুগ্ধ মাঠা সিখরিনি আদি করি।
নানারূপে ভোজন করিলা কুতুহলি ।।
আচমন করিয়া বসিলা দিব্যাসনে।
অবশেষে ভোজন করিলা সখিগণে।।
তবে কুঞ্জ কুটিরে বসিলা সর্য্যোপরি।
রসালষে তাহাতে বসিলা গিরিধারি।।
রাইসঙ্গে সখিগণ তাহাই আইলা।
কুটিরের মধ্যে শর্য্যা বৃন্দাদেবী কৈলা।।
তাহাতে বসিয়া দোহার কৌতুক বাড়িল ।
চারিদিগে সখিগণ আসিয়া রহিল।।
সখিগণ গবাক্ষে নেত্র আরোপিয়া ।
দোহার কৌতুক দেখে আনন্দ করিয়া।।
মদন আলসে তবে ষুতিলা দুইজন।
শ্রীরূপমঞ্জরি করে চরণ সেবন।।
শ্রীরতি মঞ্জরি করে চামর বাতাস।
উথলিল কত কত মদন বিলাস।।
বিদগদ নাগর রসময় হাস।
মধুকর মধু পিয়ে কমলিনি পাশ।।
দুহুঁ মুখ চুম্বনে দুহুঁ ভেল ভোর।
জনু কাঞ্চন মণি লাগল জোর।।
দুহুঁ মুখ কমল দুহুঁ করু পান।
দুহুঁ অধর অলি চতুর সুজান।।
দুহুঁ রূপ পরশে দুহুঁ ভেল ভোর।
নীলমণি কাঞ্চনে লাগিল জোড়।।
বৃন্দাবনে বনকুঞ্জ নিকুঞ্জ কুটির।
বিলসয়ে রস দোহে রতি রণ ধীর।।
দুহুঁ তনু ভোর দুহুঁ ধরু ধীর।
ফিরি ফিরি এইমত করএ রস বীর।।
সখি বিনা এই লীলা নাঞি জানে আন।
সখি ভাব যার হয় সেই করে পান।।
যুগল কিশোর লীলা অমৃতের সিন্ধু।
দুর্দৈব করম দোষে না পাঙ এক বিন্দু।।
উদ্দেশ করিয়া মাত্র লীলা অনুসারে ।
নানাবিধ করিএ স্তুতি দয়া কর মোরে।।
শ্রীরূপমঞ্জরি পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল অষ্ট কালের আক্ষান।।
শ্রীরূপ চরণ পদ্ম মনে করি আস।
স্মরণ মঙ্গল কহে নরোত্তম দাস।।

ইতি স্মরণমঙ্গল গ্রন্থ সমাপ্ত।
(এ. সো. ৩৭৩0 পুথি হইতে আদর্শ পাঠ গৃহীত।)