বিদ্যাপতি কিন্তু শুধুমাত্র একজন দ্রষ্টা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক কুশলী কলাকার এবং এমন কবিতার সৃজনকারী যা যুগ যুগ ধরে নানা বস্তুর সৌন্দর্য ও আনন্দের উৎসকে বর্ণনা করে এসেছে৷
বিদ্যাপতি কাব্যকুশলতার দুইটি দিক আছে যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ তাই আমি আর এই বিষয়ের পুনরুল্লেখ করতে চাই না যে বিদ্যাপতি তাঁর পদে লৌকিক ভাষা ব্যবহার করেন এবং তিনি এইভাবে মিথিলার সাধারণ নারীপুরুষকে কাব্যের প্রকৃত আনন্দ দান করেন যা একমাত্র সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যই দিতে পারত৷ এইভাবে তিনি মৌখিক বা কথ্য ভাষা ব্যবহার করে জাতি, বর্ণ, ধনী নির্ধন, বিদ্বান মুর্খ নির্বিশেষে দেশবাসীকে এক অকৃত্রিম মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেন৷
বিদ্যাপতির কাব্যের প্রথম দিকটি হল সঙ্গীত ও কাব্যের পূর্ণ একাত্মতা৷ সঙ্গীত মূলত ভাষায় সরসতা প্রদান করে এবং সুরসৌন্দর্য ছাড়া কাব্য পূর্ণ সৌন্দর্য পায় না৷ কিন্তু বিদ্যাপতি কখনও শুধুমাত্র সঙ্গীতের জন্য আমাদের গগনবিহারী সুরদান করেননি, তাঁর সঙ্গীতের বিষয়বস্তু সুর সংযোজনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি নিজস্ব ধ্যানধারণা ও বিষয়বস্তুর মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলেছেন৷ তাঁর গানে চিত্রিত মনোদশার সঙ্গে সঙ্গে সুরবৈভবও মিলিত হয়েছে৷
দ্বিতীয়ত বিদ্যাপতির ভাষায় কেবলমাত্র অর্থের উপযোগিতাই ছিল না, প্রযুক্ত শব্দের ধ্বনির বিষয়ে তাঁর শ্রবণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং সেই জন্যই তাঁর পদাবলী বাস্তবে হল সৌন্দর্যের ছন্দোবদ্ধ সৃষ্টি৷ তাঁর ভাষায় সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের দুটি গুণ বিশেষভাবে বর্তমান –মাধুর্য ও প্রসাদ৷ বিদ্যাপতির রচনায় মাধুর্য কেবলমাত্র ছন্দোবদ্ধ পদরচনা ও শব্দচয়নে নেই, তা পঠনমধুর, শ্রুতিমধুর ও হৃদয়ঙ্গমতায় মধুর৷ উপরন্তু বিদ্যাপতি এমন সব বাগধারা ব্যবহার করেছেন যার ব্যবহারগত বৈশিষ্ট্য আছে ও কাব্যে এগুলি প্রয়োগও করা যায় এবং হৃদয়কে তা প্রভাবিত করে আর অর্থ অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে আনন্দবন্যার লহর তোলে৷ উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা কথ্যভাষায় প্রবাদ প্রবচন ব্যবহার করি, তখন তা সেই ভাষার মানুষের অভিজ্ঞতা বা নিরীক্ষাপ্রসূত এবং যখন সেই প্রবাদ বিদ্যাপতি কবিতায় ব্যবহার করেন তখন তা প্রবাদটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পূর্ণভাব পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করতে সমর্থ হয়৷
মাধুর্য অবশ্য শৃঙ্গার কাব্যের বিশেষ গুণ এবং মৈথিলী সাহিত্যে এমন অনেক কবি আছেন যেমন গোবিন্দদাস, যাঁর পদ বিদ্যাপতির পদাবলীর মতোই মধুর৷ যে বিষয়টি বিদ্যাপতিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে তা হল সরল, সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গি যার সাহয্যে তিনি নিজস্ব ভাবধারা ব্যক্ত করেন এবং তাঁর সাবলীল ভাষাটি সাধারণ স্ত্রী পুরুষের ব্যবহৃত কথ্য ভাষা এবং সেই ভাষাটি ব্যবহার করে তাকে এমন অভিব্যক্তিময় করে তোলেন তিনি যা তদানীন্তন অপরাপর ভাষায় দুর্লভ৷ এই বিষয়টি তাঁর কাব্যের গুণাগুণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এটি তাঁর কাব্যের প্রামাণ্যতা বিষয়ে প্রধান নির্দেশক৷ এটি কেবল তাঁর মৈথিলী গীতির জন্যই নয়, সমগ্র কাব্যকৃতির জন্যই, তা সংস্কৃতেই হোক বা অবহট্টে, এবং সেই কারণেই ‘কীর্তিলতা’ বা ‘কীর্তিপতাকা’র দুরূহতা সন্দেহ জাগায় যে সত্যিই এগুলি বিদ্যাপতির নিজস্ব রচনা নাকি যেভাবে বিদ্যাপতি এগুলি লেখেন, সেইভাবেই পাওয়া গেছে ?
বিদ্যাপতির কাব্যের প্রসাদগুণ বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল তাঁর অভিব্যক্তির স্বাভাবিকতা৷ বিশেষ প্রচেষ্টা ছাড়াই বিদ্যাপতি হৃদয়ানুভূতির সাহায্যে কল্পনা করতে পেরেছেন এবং তাঁর কাব্যের উৎকর্ষই সেই মননশীলতা ও অনুভূতির যথার্থতার চরম ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ৷ এটি তাঁর বর্ণনার পদ্ধতি ও বিষয় নির্বচনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ বিদ্যাপতি সংস্কৃত শৃঙ্গার কাব্য থেকে মূল ভাবটি গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁরা কাব্যে শৃঙ্গার রসাত্মক পুনর্নিমাণের যে আভাস পাই তা স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রতিভাবসম্ভুত৷ প্রকৃতি বিষয়ে তাঁর রচনা এই দিকটির প্রমাণ দেয়৷ তিনি প্রকৃতিকে সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করেছিলেন এবং অপর কোনো কবির প্রকৃতি বর্ণনাকে মুদ্রিত নেত্রে পুনঃকল্পনা করেননি৷ বর্ষা ও বসন্ত ঋতু বিষয়ে যে বর্ণনা তিনি করেছেন তা আর কোনো দ্বিতীয় কবির রচনায় পাওয়া যায় না৷ সংস্কৃত কবিরা ও তাঁদের অনুগামীরা মানবীয় ভাবনার প্রেক্ষাপটে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রকৃতি চিত্রণ করেছেন এবং বিদ্যাপতিও সে শৈলীর অনুসরণকারী৷ তাই আমরা প্রণয়ীযুগলের মিলন ও বিরহ বর্ণনার ক্ষেত্রে ঋতুর অতি সুন্দর বর্ণনা পাই৷ কিন্তু বসন্ত ঋতু বর্ণনার ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি ঋতুসৌন্দর্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, মানব-মানবীর প্রণয়ের প্রেক্ষাপটে তাকে বিচার করেননি৷ কিন্তু বর্ষাই হোক বা বসন্ত, বিদ্যাপতির বর্ণনা পরম্পরাগত নয়, বাস্তবাশ্রয়ী কারণ তা স্বতঃস্ফূর্ত ও অনুভূত৷ সেই কারণেই এগুলি পাঠকের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং তাকে ভাবোদ্দীপ্ত করে তুলতে সহায়তা করে৷ বর্ণময়তা বিষয়ে বিদ্যাপতির জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর ও সূক্ষ্ম এবং সে জন্যই তাঁর রচনার শব্দ-চিত্রিত রূপও বর্ণময় ও সজীব, জীবনাশ্রয়ী ও বৈপরীত্যগুণে উজ্জ্বল৷ তাঁব কাব্যে প্রতিফলিত চিত্ররূপ নিটোল ও স্পষ্ট, যা কিছু সুন্দর তাই তিনি অবলোকন করেছেন এবং তা এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করেছেন যে পাঠকও সে একই আনন্দ অনুভব করে যা কবি স্বয়ং অনুভব করেছেন৷
কিন্তু তাঁর সৌন্দর্যবোধ বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল তিনি কেবলমাত্র সেই সৌন্দর্যই অবলোকন করেননি যা বাহ্যত মনোমুগ্ধকর, — যা অন্তরের সৌন্দর্য ও মননের দৃষ্টিতে উজ্জ্বল তাকেও নিরীক্ষণ করেছেন; যার ফলস্বরূপ রমণীসমাজের মনোজগতের বিশদ বাস্তব অন্তর্ভেদী চিত্র তাঁর কাব্যে পরিস্ফুট৷
”যে কোনো বক্তব্যকে চমৎকার উপায়ে বর্ণনা করবার ক্ষমতা” এবং তাকে অলঙ্কার প্রয়োগে বিশদ করার বাক্‌চাতুর্য বিদ্যাপতির অন্যতম প্রতিভা, যা তাঁকে কাব্যমাধুর্যের স্বাভাবিক দিকটিতে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল৷ সবেরই মূল হল কবির কল্পনার উর্বরতা৷ তার দুটি দিক-অপ্রকাশকে প্রকাশ করা এবং তাকে আরও সুসজ্জিত করে তোলা৷ বিদ্যাপতির কাব্য নিজস্ব স্পষ্টতাগুণে সর্বোৎকৃষ্ট৷ ক্ষিপ্রবুদ্ধি ও কল্পনাদক্ষতায় তাঁর কাব্য চিত্ররূপ পেয়েছে৷ বিদ্যাপতি ছিলেন এক মহান দ্রষ্টা কারণ যা তিনি দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন তার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন সৌন্দর্য৷ তিনি ছিলেন যথার্থ কবি কারণ সৌন্দর্যের এত মনোরম ছবি তিনি অঙ্কন করেছেন যে পাঠক তা স্পষ্ট অবলোকন করতে পারে৷ তাঁর কল্পনার পটভূমি ছিল অত্যন্ত বিশাল। যদি আমারা তাঁর প্রয়োগ-পটভূমি অন্য এক মৈথিলী পদকর্তা গোবিন্দদাসের রচনার পটভূমির সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখব গোবিন্দদাসের রূপক প্রয়োগ অত্যন্ত সুন্দর এবং যখন তিনি একটি বিষয়কে অন্য বিষয়ের ওপর আরোপ করেন তখন তা এতই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় যে একটির বিশিষ্ট গুণ অন্যটিতে প্রতীয়মান হয়৷ তাঁর অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে বর্ণনাচিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করা৷ কিন্তু বিদ্যাপতি কোনো একটি বিশেষ চিত্র বর্ণনায় সন্তুষ্ট ছিলেন না, একই গতিময়তায় তিনি একের পর এক দৃশ্যান্তরে চলে যেতেন এবং তা হত এতই দ্রুত সমস্ত গীতটি চিত্রময় ও সর্বাঙ্গসুন্দর হত৷ সুতরাং বিদ্যাপতি উৎপ্রেক্ষা প্রয়োগে অতি পারদর্শী ছিলেন৷ একইভাবে বিদ্যাপতির পরোক্ষ বর্ণনা বা অপ্রস্তুত প্রশংসাও ছিল চমৎকার৷ কিন্তু অলঙ্করণ যেমনই হোক না কেন, বিদ্যাপতি বর্ণিত চিত্র ছিল নিটোল, সহজবোধ্য, বর্ণনার গুণে স্বাভাবিক, সূক্ষ্মভাবে অনুভূতিগ্রাহ্য ও প্রামাণ্য৷
যদি আমরা বস্তুগত ভেদ নির্ণয়কারীর দৃষ্টিতে কাব্যের স্পষ্ট পরিভাষা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের পরিভাষা অলঙ্কারবোধের চারিদিকে আবর্তিত হবে, অলঙ্কার শব্দটির প্রয়োগ এখানে বিস্তৃত অর্থে করা হয়েছে৷ অলঙ্কার হল কাব্যের সৌন্দর্য, রূপময়তা৷ মহান কবিদের কাব্যে অলঙ্কারের অনিবার্য অবতারণা আছে যা বিভিন্ন ভাবপ্রকাশের ধারক৷ কিন্তু রূপমাধুর্যকে সরিয়ে রেখে আমরা আলঙ্কারিকতাকে কাব্য হিসেবে অভিহিত করতে পারি না৷ অলঙ্কারের বেদীতেই কাব্যের উৎসর্গ সম্ভব৷ ”ঔচিত্য”, সামঞ্জস্য বা সমানুপাতিকতাই কাব্যের চরম সৌন্দর্যের মাত্রা৷ এই ঔচিত্যের পটভূমি কাব্যের আত্মা বা রস যার পরিপ্রেক্ষিতে ঔচিত্যের গুণাগুণ বিচার কর হয়৷” আত্মার অনুপস্থিতিতে শরীর শবদেহ মাত্র এবং মৃতদেহের ওপর অলঙ্কার প্রায়োগ কি লাভ ?কবি তখনই অলঙ্কারের সহায়তা নিতে পারেন যখন তা ভাব ও রসের অনুকূলে প্রযুক্ত হয়৷ শৈলী বিষয়ে লিখতে গিয়ে ওয়াল্টার পেটার ‘গ্রাহ্য অলঙ্কার’ বিষয়ে বলেন যে এটি ”রচনাত্মক বা আবশ্যক৷” যে কোনো প্রতিভাশালী কবি এটিকে এমনভাবে প্রয়োগ করেন যে তা রসের অভিব্যক্তির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায় এবং যথার্থ ক্ষেত্রে বিস্ময়ানুভূতির উদ্রেক করে৷ মনে হতে পারে যে অলঙ্কার কৃত্রিম, বিশদ ও বৌদ্ধিক অভ্যাস যা আয়ত্ত করতে গেলে প্রভূত যত্নবান হতে হয় কিন্তু প্রকৃত কবির কাছে তা বাস্তবে সত্যিই কঠিন নয়৷ ”তাঁর কাছে তো যেমন যেমন ভাবনার উদ্ভব হয় তেমন তেমন অভিব্যক্তির বিকাশ ঘটে ও অলঙ্কার উৎসারিত হয়৷” পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইচ্ছা জাগে অলঙ্কারের অধিক প্রয়োগের৷ কবি যখন প্রতিভাশালী ও রসমগ্ন হন, তখনই উৎকৃষ্ট অলঙ্কারের প্রয়োগ ঘটে৷ বিদ্যাপতির ক্ষেত্রে আমরা দেখি উদ্বেলিত রসপ্রবাহের প্রাচুর্যে কবির লেখনী থেকে অলঙ্কার-মাধুরী নিঃসৃত হয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ নারী সৌন্দর্যের বর্ণনামূলক পদ বা প্রণয়ীযুগলের মিলন বর্ণনামূলক পদ উল্লেখযাগ্য৷ এই দুই বিষয় বারবার কবিকে কাব্যকল্পনার শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে গেছে এবং তাঁর হৃদয়ে সত্যকারের কাব্যানন্দ উদ্ভূত করেছে৷ তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে বিদ্যাপতি বিরহের অনুভূতিপূর্ণ বর্ণনা করতে পারদর্শী ছিলেন না৷ বস্তুত বিরহের বিশেষ করে নায়িকাবিরহের বর্ণনাকারী অনেক গান এতই ভাবগ্রাহী যে অলঙ্কারের প্রয়োগ করা হয়েছে অত্যন্ত কম এবং পরিস্থিতির উদাত্ততা বা করুণরস আপন মহনীয়তা ও সৌন্দর্যেই আমাদের প্রভাবিত ও মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে৷

পরিশেষে, কিছু কিছু এমন পদ আছে — আজ পর্যন্ত ছয়টির সন্ধান পাওয়া গেছে — যাতে মানবজীবনের নিরর্থকতা, ক্ষণভঙ্গুরতা ও নিরাশা বর্ণনা করা হয়েছে৷ এগুলির মধ্যে পাঁচটি মাধব বা হরকে উদ্দেশ্য করে এবং একটি বয়সকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে যাতে জরাগ্রস্ত বার্ধ্যক্যাবস্থা ও অসহায়তাকে অত্যন্ত বাস্তবভাবে ও অনুভূতিসমৃদ্ধভাবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ এই গীতগুলিতে কবি অনুতাপ করেছেন যে তিনি সারাজীবন ধরে সেই সব বস্তুর বেসাতি করে এসেছেন যা তাঁর অন্তিম সময়ে কোনো স্থায়ী লাভের সহায়তা করবে না, সারা জীবনটাই ‘আমার আমার’ করে এসেছেন কিন্তু যখন এই সংসার থেকে বিদায় নেবার সময় এসেছে তখন অনুভব করেছেন কিছুই তাঁর আপন হয়নি৷ যুবক বয়সে তিনি পরস্ত্রী ও অপরের সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন; এই জীবন তপ্ত বালুকাবেলায় একবিন্দু জলের মতোই এবং যখন তিনি মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন তাঁর পত্নী, পুত্র, বন্ধু কেউই তাঁর সাহায্যে আসছে না৷ তাঁর অর্ধেক জীবন তো ঘুমিয়েই কেটে গেছে, বাল্যকাল ও বৃদ্ধাবস্থাতেও কতদিন কেটে গেছে, যৌবনেও তিনি দেহজ প্রণয়ে এতই মগ্ন ছিলেন যে ঈশ্বরচিন্তার জন্য তাঁর কেনো অবকাশই ছিল না অথচ তা এখন তাঁর শেষ জীবনের একমাত্র পাথেয় হতে পারত৷ জীবনের দুঃখময় দিকগুলি নিয়ে তিনি সারাজীবন কাটিয়ে গেছেন, কিন্তু আজ জীবনসায়াহ্নে যখন তিনি ভগবানের কাছে যাচ্ছেন তখন সবই তাঁর কাছে হাস্যকর ও মূর্খতাপূর্ণ মনে হচ্ছে ঠিক যেমন কোনো মজুর সন্ধ্যাবেলায় মালিকের কাছে গিয়ে কাজ চায় যখন কাজের সময় পার হয়ে গেছে৷ তিনি নিজেকে ভগবানের চরণে এই আশায় সমর্পণ করেছেন যে ঈশ্বর তাঁর গুনাগুন বিচার না করে তাঁকে করুণার আশ্রয়ে গ্রহণ করবেন৷ বিদ্যাপতি বার্ধক্যের অতি করুণ চিত্র অঙ্কন করেছেন যাতে প্রতিদিনের শেষে মানুষ নিজের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা প্রথম থেকেই অনুমান করতে পারে৷ এতে জীবনের বাস্তব দিকটির প্রতি তার দৃষ্টি স্বচ্ছ হবে এবং সে ঈশ্বরের ধ্যান করবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে যা অন্তিম সময়ে হবে তার সহায়ক৷
এই সব পদগুলি শান্তরসাশ্রয়ী, যার মূল ভাব নির্বেদ বা বৈরাগ্য৷ এগুলির অনুভূতি অত্যন্ত গভীর এবং বর্ণনা খুবই প্রামাণ্য৷ এই পদগুলি বহু আলোচিত এবং যথার্থ আত্মপ্রকাশক কারণ নিজের জীবন পরস্ত্রীর প্রীতি ও পরধনলোভী হয়ে কাটিয়ে বিদ্যাপতি বার্ধক্যে অনুশোচনা করেছেন৷ একথা ভাবা অযৌক্তিক নয় যে শিবসিংহের স্নেহচ্ছায়ায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় বৈভবশালী বিদ্যাপতি শিবসিংহের আকস্মিক ও রহস্যজনক অন্তর্ধানে নিরাশ ও বিচলিত হয়ে পড়েন ও তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ এই পদগুলি রচিত হয়৷
আমার মনে হয় এক ব্যক্তি বা কবিরূপে বিদ্যাপতির বিষয়ে এই ধরনেরর ধারণা করা ভ্রান্ত৷ তিনি সেই পরম্পরা বা ঐতিহ্যের অনুসারী যা কবিতাকে মানবজীবনের সার্বজনীন তত্ত্বের অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে৷ অন্যভাবে বলতে গেলে এটি মানবজীবনচরিত্র, ভাবনা ও কার্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আদর্শ প্রতিবিম্ব এবং আর সবই ‘মিথ্যা’৷ শৃঙ্গার রসের গান বা শান্তরসের গান– উভয়ক্ষেত্রেই বিদ্যাপতি বস্তুনিষ্ঠ ছিলেন এবং কখনই নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতির আশ্রয় গ্রহণ করেননি৷ ‘পরকীয়া’ প্রেমের সঙ্গে আমরা কি করে জীবনের ধার্মিকতার সামঞ্জস্যবিধান করতে পারি ? এই পদগুলি বা তাঁর প্রেমপদাবলী — কোনোটিতেই অতীত জীবনের ছায়া খুঁজতে যাওয়া উচিত হবে না৷ শান্তরসের দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলি মানবজীবনের অতি সাধারণ চিত্র৷ বিদ্যাপতির গীত বিশেষ মনোদশাসম্ভূত৷ কবি হিসেবে তিনি নিজের পছন্দসই যে কোনো বিষয়ে গভীর অনুভূতি নিয়ে লিখেছেন এবং তা লিখেছেন আপন হৃদয়ের মাধুরী মিশিয়ে আর সেই রসমাধুরী কবির তখনকার মনোজগতে সঞ্জাত৷ এই পদাবলীতে ব্যক্ত ভাবনাগুলি এই পৃথিবীর সাধারণ মানুষের সাধারণ অনুভূতিমাত্র এবং একথা বলাই যথেষ্ট যে বিদ্যাপতির প্রতিভা এই সাধারণ অনুভূতিগুলিকে দেখতে ও অনুধাবন করতে এবং তার সার্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল৷ অনুতাপ, গ্লানি , জীবনের অসারতা –এ সবই শান্তরসের অন্তর্গত৷ বিদ্যাপতি তাঁর কাব্যে যে ঐতিহ্যের অনুগামী এবং বিদ্যাপতির জীবনের যে ঘটনা আমাদের জানা তাতে আমার মনে হয় না যে এই শান্তরসের পদগুলিতে তিনি আত্মনিষ্ঠ বা ভাবুক এবং শৃঙ্গাররসের পদগুলিতে তিনি বস্তুনিষ্ঠ৷ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই গানগুলিতে শান্তরসের ততটাই পরিপূর্ণ চিত্র আছে যতটা তাঁর প্রেমপদাবলীতে স্থান পেয়েছে শৃঙ্গাররস৷ বিদ্যাপতি মানবজীবনের অসারতা ও ক্ষুদ্রতা সমানভাবে অনুভব করেন৷ নায়িকার জন্য নায়কের প্রেমাবেগ যেমন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, তেমনই এই গানগুলির অন্তর্গত আত্মাবমাননাও তাঁর জীবনের কাহিনী নয়৷ কোনো বিশেষ বিষয়কে নিয়ে সার্বজনীন আবেদন চিত্রিত করা কাব্যের উচ্চতম লক্ষ্য এবং বিদ্যাপতি এই লক্ষ্য অর্জন করার বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারেন; সে বিষয়টি কামজ প্রেমই হোক বা আধ্যাত্মপ্রেমই হোক, জীবনের আনন্দই হোক কিংবা অসারতা, চঞ্চলতা, ক্ষুদ্রতা ও নিরাশাই হোক অথবা হোক আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্ম-অবমাননা৷ সংস্কৃত কাব্যের য৷বতীয় সৌন্দর্যের আধার, মধুর, সুরসমৃদ্ধ গীতরচয়িতা হিসেবে বিদ্যাপতির খ্যাতি আশ্চর্যজনকভাবে সর্বত্র বিস্তারলাভ করেছে৷ যারাই এই গীত শ্রবণ করছে তারাই মধুর সুরে মোহিত হয়েছে এবং এই গীতের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত ভাবনার এতই সার্বজনীন আবেদন আছে যে এ সৌন্দর্যানুভূতির আনন্দ যাদের কাছে এতদিন অনাস্বাদিত ছিল সেই সাধারণ স্ত্রী পুরুষকেও আকর্ষণ করে আনন্দদান করে৷ এই সময়ে, যখন সংস্কৃতই ছিল কৃষ্টিবান মানুষের ভাষা এবং বিশেষত মিথিলায়, যেখানে সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষার রচনা পবিত্রতা হরণদোষে দুষ্ট হত, তখন লৌকিক বা কথ্য ভাষাকে রচনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার মতো সৎসাহস ও আত্মবিশ্বাস বিদ্যাপতির ছিল৷ তদানীন্তন প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতবর্গ বিদ্যাপতির লোকভাষার ব্যবহারকে তিরস্কার করেন কিন্তু যখন তাঁরা দেখেন যে এই নতুন ধরনের কাব্য বিদ্যাপতিকে বিপুল জনপ্রিয়তা ও অভূতপূর্ব কীর্তিস্থাপনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন ‘সেই মহৎ জনের মননশক্তির অন্তিম দুর্বলতা’ তাঁদের বিদ্যাপতির পন্থা অনুসরণে বাধ্য করে৷ বিদ্যাপতির অনুকরণে গীতরচনা মিথিলার প্রতিভাশালী পণ্ডিতদের কাছে লোকাচারস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়৷ একথা সত্যি যে তাঁরা বিদ্যাপতির অনুকরণ ছাড়া আর বেশী কিছু করতে পারেননি, কিন্তু অনুকরণ প্রক্রিয়াটি অবিকৃতরূপে ক্রম-অগ্রসর হয়েছে এবং বিদ্যাপতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য এবং রচনাবৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে মৈথিলী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে৷
মিথিলার বাইরে মৈথিলী সাহিত্য নেপালে তিন শতাব্দী ধরে বিদ্যাপতির রচনা দ্বারা প্রভাবিত৷ মিথিলার কর্ণাট রাজাদের বংশোদ্ভূত বলে পরিচিত ভাটগাঁও এবং কাঠমাণ্ডুর মল্লরাজারা মৈথিলী সাহিত্য সংরক্ষণ করতে উৎসাহী হন এবং ঐনবরা রাজবংশের পতনের পর মিথিলার রাজনৈতিক দূরবস্থাও মৈথিলী বিদ্বান ব্যক্তি ও কবিদের প্রতিবেশী রাজ্য নেপালের মল্ল রাজাদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করে৷ বিদ্যাপতির অনুকরণে এঁরা এক বিশাল সাহিত্যের পটভূমি নির্মাণ করেন যার অন্যতম অঙ্গ হল বিশুদ্ধ মৈথিলী ভাষায় রচিত বহু নাটক যা নিয়মিত অভিনীত হত এবং এগুলি যে কোনো আধুনিক ভারতীয় ভাষাশ্রয়ী নাটকের জনকস্বরূপ৷ অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত যখন মল্লরাজাদের শাসন অপসারিত, মৈথিলী ছিল নেপাল রাজদরবারের সাহিত্যের ভাষা এবং বিদ্যাপতি ছিলেন সাহিত্যপ্রেরণার উৎস৷ পরিতাপের বিষয় এই যে এই সময়ের বেশীরভাগ সাহিত্য এখনও পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপিত হয় নি এবং সেই কারণে অপরিচিতও বটে কিন্তু এগুলি নানা গ্রন্থাগারে সযত্নরক্ষিত৷