শ্রীশ্রীবৈষ্ণবেভ্যঃ নমো নম।
আনন্দে বলহ কৃষ্ণ ভজ বৃন্দাবন।
ঠাকুর বৈষ্ণবের পায়ে মজাইয়া মন।।
বৈষ্ণব ঠাকুর বড় করুণার সিন্ধু।
ইহলোক পরলোক দুই লোকের বন্ধু।।
বৈষ্ণব জানিতে নারে দেবের শকতি।
কেমনে জানিব মুঞি শিশু অল্প মতি।।
বৈষ্ণবের গুণ শুনি অপার মহিমা।
আপনে না পারে প্রভু দিতে যার সীমা।।
বৈষ্ণব দেবতা মোর বৈষ্ণব ধিআন।
বৈষ্ণব ঠাকুর মোর বৈষ্ণব মোর জ্ঞান।।
বৈষ্ণবের পদধূলি লাগুক মোর গায়।
সবংশে বিকাইনু বৈষ্ণবের পায়।।
বৈষ্ণবের প্রেমানন্দ লাগুক মোর অঙ্গে।
জন্ম যাউক মোর বৈষ্ণবের সঙ্গে।।
বৈষ্ণব অধরামৃতে পুরুক মোর দেহ।
মোর বংশে বৈষ্ণবেরে না নিন্দিয় কেহ।।
বৈষ্ণব ভজরে ভাই বৈষ্ণব প্রাণধন।
বৈষ্ণব বিনে অন্য সঙ্গে নাহি মোর মন।।
বৈষ্ণব বিনে কেহো কৃষ্ণ নাহি পারে দিতে।
বৈষ্ণব বিনে কেহো নারে ভব তরাইতে।।
বৈষ্ণব মোর জপতপ বৈষ্ণব ধিআন।
বৈষ্ণব বিনে কেহো না চিন্তিহ আন।।
সংসারে গতি সার বৈষ্ণব ঠাকুর।
বৈষ্ণবের হঙ মুঞি নাছের কুকুর।।
প্রেমানন্দ হঞা যেবা করএ ক্রন্দন।
জন্মে জন্মে হঙ তার দাসির নন্দন।।
বৈষ্ণব যাহার আখ্যা কৃষ্ণ তার নাম।
জন্মে জন্মে গাইব তাঁর গুণ গান।।
শ্রীগুরু বৈষ্ণব কৃষ্ণ তিনে এক দেহ।
জীব তরাইতে ভেদ নাহি জানে কেহ।।
সমুখে আছেন গুরু জ্ঞান শক্তি লয়্যা।
সাধকের কৃপা সিদ্ধ করেত ধরিঞা।।
চরণ কমলে যত রহু ভক্ত বৃন্দে।
অভয় করুণাসিন্ধু ধরিয়া আনন্দে।।
নিত্য সিদ্ধি তৎ শক্তি ধরি ভগবান।
সিষ্টে তর হয় তিন হঞা অধিষ্ঠান।।
আগে গুরু তবে বৈষ্ণব তবে ভগবান।
তিন বস্ত্র এক হয় না করিহ আন।।
যেই গুরু উপদেশে জানয়ে বৈষ্ণবে।
বৈষ্ণব জানিলে তবে কৃষ্ণচন্দ্র লভে।।
এমন বৈষ্ণব কেহো না করিহ হেলা।
কেবল সংসার সিন্ধু তরিবার ভেলা।।
যুগে যুগে হঙ মুঞি বৈষ্ণবের দাস।
বৈষ্ণবের উচ্ছিষ্টে মোর রহু বিশ্বাস।।
ঠাকুর বৈষ্ণবের বাক্যে রহু মোর মন।
অটল হঞা হৃদে রহুক বৈষ্ণব চরণ।।
বিনতি করিআ মাগোঁ দেহত প্রসাদ।
উদ্ধার করহ মোরে খেম অপরাধ।।
ঠাকুর বৈষ্ণব যারে নেহালে করুণে।
অনন্ত জন্মের কার্য্য হয় সেইক্ষণে ।।
বৈষ্ণবের পদধূলি শিরে পড়ে যার।
তিন সপ্ত পুরুষ তার হএত উদ্ধার।।
যার ঘরে জন্মিলা পুত্র বৈষ্ণব নাম ধরে।
বাহু নাড়া দিয়া পিতৃলোক নৃত্য করে।।
বৈষ্ণব উপায় মোর বৈষ্ণব উপায় ।
বৈষ্ণবরূপে প্রভু আপনে বেড়ায়।।
তিলার্দ্ধ পাদরবিন্দে নহে যার ধিয়ান।
কোটি ইন্দ্র পদ নহে তৃণজ্ঞান।।
তিলার্দ্ধ বৈষ্ণব সনে হয় উদাসীন।
সেজন ইন্দ্রের বড় পরিআ কৌপীন ।।
বৈষ্ণবের অন্ন ব্যঞ্জন ছিড়া পাতের ভাত।
তাহা খাঞা সুখ বড় পান জগন্নাথ।।
চারিবেদে লেখে শাস্ত্র ভাগবতে কয়।
বৈষ্ণব চরণোদক সর্ব্ব তীর্থময়।।
ঠাকুর বৈষ্ণবের ভাই অপার মহিমা।
আপনে প্রভু যার দিতে নারে সীমা।।
বিশেষে বৈষ্ণব যদি হএত ব্রাহ্মণ।
চতুর্বেদী বিপ্র নহে তাহার পদ সম।।
চণ্ডাল যবন যদি বৈষ্ণব হয়।
অভক্ত সন্ন্যাসী দ্বিজ তার সম নয়।।
বিশেষে বৈষ্ণব যদি হএত ব্রাহ্মণ।
হিমে বান্ধা যায় যেন গজেন্দ্র দশন।।
তথাহি–
ইক্ষুদণ্ড ফলং প্রাপ্য চন্দনঃ পুষ্পমেবচ
দুর্ল্লভং বিপ্রভক্তঞ্চ দুর্ল্লভো প্রতি দুর্ল্লভম্‌ ।।
মুনি দ্বিজ শূদ্র ভেদ নাহিক বৈষ্ণবে।
বৈষ্ণবগণের বাহ্য কৃষ্ণ গোত্র লভে।।
তথাহি —
পিতৃগোত্রেন যা কন্যা স্বামীগোত্রেন গোত্রিতা
তথা কৃষ্ণ ভক্ত মাত্রেণ অচ্যুত গোত্র ভবেৎ নৃণাং।।
তিন লোক হেলাএ পবিত্র করিলে।
হেন বৈষ্ণবের পায় সঁপ জাতিকুলে।।
বৈষ্ণবের পাদোদক পড়ে যেই স্থানে।
সহস্র যোজন হয় বৈকুণ্ঠ সমানে।।
মালা তিলক বালা আগে ধরিয়াছে ।
ইন্দ্রাদি দেবতাগণ ফিরে তার পাছে।।
যে বালা দেখিলে হয় বৈষ্ণব শুদ্ধি।
মোর বংশে না করিবে বৈষ্ণবে জাতি বুদ্ধি।।
জাতি বুদ্ধি করে যেই ঠাকুর বৈষ্ণবে।
যমের শাসন গিয়া সেই জনা লভে।।
যে পাপী কর নিন্দা বৈষ্ণবেতে ভেদ।
বিষ্ঠা ক্রিমি হয়্যা জন্মে কহে চারিবেদ।।
তথাহি স্কান্দে–
নিন্দাং কুর্ব্বন্তি যে মূঢ়া বৈষ্ণবানং মহাত্মানাং
পতন্তি পিতৃভিঃ সাঙ্গ মহা রৌরব সঙ্গতে।।*
*ইহার পর অতিরিক্ত —
(মহাঘোর নরকে হয় তাহার নিবাস।
বৈষ্ণব দেখিয়া যেবা না করে বিশ্বাস।।)
বৈষ্ণব দেখিয়া যেবা করএ সম্ভাষ।
(প্রভু বলে) তারে হঙ মুঞি নিজ দাস।।
বৈষ্ণবের অবশেষ যে মূঢ়ে না খায়।
কৃষ্ণ কোপানলে পড়ি সেই মূঢ় যায়।।
বৈষ্ণবের পাতের অন্ন খায় উদর পুরিয়া।
যে মূঢ়ে না খায় তারে যমে যায় লয়্যা।।
যে মূঢ় দেখিয়া নিন্দে মালা তিলকেতে ।
প্রভু তারে হয় বাম কহে ভাগবতে।।
ঠাকুর বৈষ্ণব দেখি যেবা জন নিন্দে।
অর্জুনে কহিল কৃষ্ণ তার সর্ব্ব মন্দে।।**
**ইহার পর অতিরিক্ত —
(যে মূঢ় বৈষ্ণব দেখি জাতি শুধায় ।
যমের অধিকারে যে উদ্ধার না পায়।।)
যে মূঢ় বৈষ্ণব দেখি নয়ন ফিরায়।
…খলায় চক্ষু তার ভাজে যম রায়।।
চণ্ডাল যবন আর নাহিক ব্রাহ্মণ।
যে ভজে সেই হয় কৃষ্ণের প্রিয়তম।।
তথাহি শ্রীভাগবতে–
বিপ্রাদ্‌দ্বিষড়গুণ–যুতাদরবিন্দনাভ–
পাদারবিন্দং –বিমুখাৎ শ্বপচং বরিষ্ঠম্।
মন্যে তদপিত -মনোবচনেহিতার্থ–
প্রাণং পুনাতি স কুলং ন তু ভূরিমানঃ।।
ভজনের গুণে হয় কৃষ্ণ ভক্তি জানি।
ইহা যে নিন্দএ জন্মে চণ্ডালের যোনি।।
অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণ হয় চণ্ডাল সমান।
ইহার প্রমাণ দেখ নারদ পুরাণ।।
পদ্ম পুরাণ আর দেখ ভাগবতে।
অবৈষ্ণব ব্রাহ্মণের নাহি পরশিতে।।
নিগম আগম আর শাস্ত্র প্রমাণে।।
অবৈষ্ণব হইলে লেখে চণ্ডাল সমানে।।
মুনি হয় চণ্ডাল সম নারদেতে লেখে।
বিষ্ণু ভক্ত নহে দ্বিজ চণ্ডাল অধিকে।।
পদ্ম পুরাণে লেখে ভক্ত শূদ্র নহে।
অভক্ত জন হৈলে চণ্ডাল সম কহে।।
তথাহি —
মুখ-বাহূরু-পাদেভ্যঃ পুরুষস্যাশ্রমৈঃ সহ।
চত্বারো জজ্ঞিরে বর্ণা গুণৈর্বিপ্রাদয়ঃ পৃথক।।
য এষাং পুরুষং সাক্ষাদাত্মপ্রভবমীশ্বরং।
ন ভজন্ত্যজান্নতি স্থানাদ ভ্রষ্টাঃ পতন্ত্যধঃ।।
দূরে সাধু দেখি যদি নিকটে না যায়।
দ্বাদশ বৎসর পর্যন্ত কৃষ্ণ নাহি পায়।।
নিয়ম নাঞি ঐছে মোর বৈষ্ণব ঠাকুর।
যে ইহা না বুঝে সে শৃগাল কুকুর।।
অতি হীন জাতি যদি সে বৈভব হয়।
কৃষ্ণের করুণাপাত্র বলি সভে লয়।।
বৈষ্ণব হইলে নাহি পাণ্ডিত্য বিচার।
সেবক হইয়া কৃষ্ণ পাছে ফিরে তার।।
মহাকুল মুনিশ্রেষ্ঠ অভক্ত ব্রাহ্মণ।
কৃষ্ণভক্ত চণ্ডালের হাতে খায় অন্ন।।
অভক্ত জনের অন্ন কুকুরের বিষ্ঠা।
মদিরা সমান জল তার হয় নিষ্ঠা।।
তথাহি —
কৃষ্ণ মন্ত্র বিহীনস্য পাপিষ্ঠস্য দুরাত্মানাং
শ্বানবিষ্ঠা সমচান্ন জলঞ্চ মদিরা সম।।
হয় বা নয় দেখ ভাগবত পুরাণ।
অভক্তের চিহ্ন এই সর্ব্ব শাস্ত্রে গান।।
পরম উত্তম হয় ভক্ত জনের অন্ন।
জল পরশে তার গঙ্গা জল হেন ।।
…..থাকে যদি দেখি অকিঞ্চন।
সাক্ষাৎ জানিবে সেই হয় নারায়ণ।।
হেন বৈষ্ণব সব দাণ্ডাব যার কাছে ।
……..থাকে তার পাছে।।
তথাহি–
মুহূর্ত্তং মুহূর্ত্তার্দ্ধং যত্র তিষ্ঠন্তি বৈষ্ণবাঃ
তত্রস্থানং পরিত্যজৎ নরো যান্তি …..।।
দিনে একবার যদি বৈষ্ণব সভা যায়।
আপনে পিয়াদা কৃষ্ণ তার পাছে ধায়।।
বৈষ্ণব যাহার গৃহে ভুঞ্জে একবার।
তার গৃহে নাহি ভাই যমের অধিকার।।
এক বৈষ্ণবের যদি তুষ্ট করে মন।
প্রভু কহে আমা হেন হয় কোটি গুণ।।
যত তুষ্ট হই আমি শালগ্রাম পূজায়।
তত তুষ্ট হই আমি বৈষ্ণব সেবায়।।
বৈষ্ণব সেবার ফল চারিবেদে গায়।
জন্মে জন্মে রহু মন বৈষ্ণবের পায়।।
দেখ ঠাকুর বৈষ্ণব বিনে নাহিক উপায়।
ধনে জনে বিকাইনু বৈষ্ণবের পায়।।
দুঃখে……সর্ব্ব পরিবারে।
বৈষ্ণব চরণ ভজ হইবে উদ্ধারে।।
বৈষ্ণবের মহিমা গুণ কে পারে বর্ণিতে।
(আপনি শ্রীকৃষ্ণ) কহে বেদ মুখেতে ।।
বৈষ্ণব গোসাঞির ভাই অপার মহিমা।
ব্রহ্মা আদি দেব যার দিতে নারে সীমা।।
ইহাতে (যাহার চিত্তে না থাকে) অন্যথা।
পাণ্ডবের বনবাসে দেখহ সর্ব্বথা।।
সহস্র ব্রাহ্মণ ভোজন কর‍্যাছে নিয়মে।।
সহস্র (পুণ্য হইলে রাজা করএ ভোজন)।।
বৈষ্ণব ভোজন আর মন শুধিবারে।
এক বৈষ্ণব না আইল চিন্তিত অন্তরে।।
হেনকালে … … বৈষ্ণব আইল্য।
আনন্দিত হৈঞা তারে ভোজনে বস্যাইল্য।।
প্রভু দিয়াছে রাজা সংখ্যা পূর্ণ তরে।
সহ … … বাজে একবারে।।
সেই বৈষ্ণব এক গ্রাস করেন ভোজনে।
সঘনে শঙ্খধ্বনি হয় রাজা বিস্ময় মনে।।
যদ্যাপি … … … ।
উপস্থিত হৈলা কৃষ্ণ রাজার উপনিত।।
কৃষ্ণ দেখি সভে মিলি পড়িলা চরণে।
অনাথের নাথ কৃষ্ণ করোঁ নিবেদনে।।
তোমার মায়া প্রভু বুঝিতে কে পারে।
ইহার বিষয় প্রভু কহিবে আমারে।।
সহস্র ব্রাহ্মণ আসি করএ নিয়ম।
সহস্র পূর্ণ হইলে আমি করিএ ভোজন।।
আজি কেনে দেখি প্রভু তোমার বিড়ম্বনা।
এক ব্রাহ্মণ না আইল (মনেতে যন্ত্রণা)।।
কৃষ্ণ কহেন রাজা তুমি দুঃখ কেনে মনে।
আজি তোমার ভাগ্যের সীমা কে করে গণনে।।
দেখ এক বৈষ্ণব আজি করিল ভোজন।
শতকোটি বিপ্র নহে বৈষ্ণবের সম।।
কৃষ্ণের বাক্য শুনি রাজার মন তুষ্ট হৈল।
বৈষ্ণব মহিমাগুণ গাইতে লাগিল।।
বৈষ্ণব ভজরে ভাই দেখ বৈষ্ণব মহিমা।।
আপনে প্রভু যার দিতে নারে সীমা।।
শ্রীযুত আচার্য্য প্রভূর চরণ করি আশ।
বৈষ্ণবামৃত কহে নরোত্তম দাস।।

ইতি বৈষ্ণবামৃত সম্পূণ।।

(সা. প. ৫0৮ পুথি হতে আদর্শ পাঠ গৃহীত।)