পূর্বে আমরা তাঞ্জোর-সরস্বতীমহল-প্রকাশিত Gitagobinda with Abhinaya-গ্রন্থ থেকে “গীতগোবিন্দ” – পদগানের নৃত্যসম্পৃক্ত নাট্যরূপের কিছুটা পরিচয় দিয়েছি এবং সেই নৃত্যসম্পৃক্ত নাট্যশাস্ত্রকার মুনি ভরত ( ভরত-এর সঙ্গে “মুনি” শব্দ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য এই যে, “ভরত” একটি উপাধি (title)-বিশেষ এবং এই উপাধিধারী শাস্ত্রকার বা গ্রন্থকার আরও অনেক ছিলেন৷ নাট্যশাস্ত্র রচয়িতা ভরতকে তাঁদের থেকে পৃথক করার জন্য তাই “মুনি” শব্দ তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷) ও অভিনয়দর্পণকার নন্দীকেশর -সমর্থিত নিয়ম-নীতির অনুরূপ তা স্পষ্ট বোঝা যায়৷ Gitagobinda with Abhinaya-গ্রন্থে সম্পাদক বিদ্বান্‌ শ্রীবাসুদেব শাস্ত্রী মুখবন্ধে লিখেছেন ঃ “Having thus been composed for the express purpose of Nritya, the Abhinaya for all the pieces must have been determined and preserved by tradition. But the traditional practice has suffered by the general break of tradition due to the foreign invasion and foreign influence. Fortunately for us, however, the Abhinaya for every word is found in two manuscripts, preserved in the Sraswats-Mahal. * * The fact that the Abhinaya, given in here, agrees well with the Art in the Tanjore District, which is now the home of the purest tradition of Bharata-natya. It is itself sufficient to conclude that the work is pretty old”৷
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, গীতগোবিন্দ বা “অষ্টপদী”-গানের গোত্র বা পর্যায়-নির্ধারণব্যাপারে মতবাদ এবং মতভেদেরও অন্ত নাই৷ গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, অতিনাটক, আখ্যান-নাটক, অপেরা, যাত্রা, খণ্ডকাব্যে এই
ধরনের বিচিত্র মন্তব্য গীতসম্বন্ধে করা হয়েছে৷ বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ উভয় বিচার বিশ্লেষণভঙ্গীতে গীতগোবিন্দে সংগীত ও কাব্যের মিশ্রণই স্পষ্ট এবং তা থেকে গীতগোবিন্দ যে নাট্যগীতি ও খণ্ডকাব্য এই সিদ্ধান্তই অধিকাংশ মনীষী গ্রহণ করেছেন৷ কিন্তু জানি না,কেন তাঁরা এই গীতিকাব্যের নৃত্যসম্বলিত নাট্যরূপটির আলোচনা থেকে বিরত৷ একথা সত্য যে বিশেষ করে আখ্যান, নাটকীয়তা ও সংগীত ত্রিধাতু অথবা ত্রিবৈশিষ্ট্য-সম্বলিত এই পদগান, কিন্তু এর নৃত্যসম্পৃক্ত নাট্যরূপের বৈশিষ্ট্যও কোন অংশে অবহেলার যোগ্য নয়৷
আমরা পদাবলীকীর্তনের প্রাণকেন্দ্র ও উৎসস্বরূপ “গীতগোবিন্দ” -পদগানের নৃত্যসম্পৃক্ত নাট্যরূপের নিদর্শনসূচক বিশদ আলোচনা না করে কবি জয়দেব প্রদর্শিত একটিমাত্র সংকেত শব্দেরই উল্লেখ করবো৷ কবি চতুর্থ সর্গের ৯ম গানের প্রথম চরণে বলেছেন ঃ “শ্রীজয়দেবভণিতমিদমধিকং যদি মনসা নটনীযম”৷ পূজারী গোস্বামী প্রভৃতি ভাষ্য ও টীকাদারদের অধিকাংশই “নটনীযম্‌ –শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন “নর্তয়িতব্যম্‌” বা “নর্তিতব্যম”, কিন্তু রাণা কুম্ভা “রসিকপ্রিয়া”-টীকায় এর সঠিক মর্ম-বিশ্লেষণ করেছেন বলে মনে হয়৷ রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “শ্রীজয়দেবেতি৷ হে বৈষ্ণবাঃ; ইদং শ্রীজয়দেবভণিতং যদি মনসাধিকং নটনীযমভিনেতব্যম৷ “নট”-শব্দেনাত্র নাট্যস্যাভিনয়প্রাধান্যাদভিনয়ো বিবক্ষিতঃ৷ অথবা, নটনীয়মিত্যাস্বাদনীযম, বসনীয়মিতি যাবৎ৷ “নাট্যশব্দো বসে মুখ্যঃ ” ইতি ভবতীয়ে৷” (নিণর্য়সাগর প্রেস, বোম্বাই প্রকাশিত “গীতগোবিন্দ” (নবম সংস্করণ, ১৯৪৯), পৃঃ ৮১)৷ তাছাড়া গীতগোবিন্দের রাগ-বিশ্লেষণে আমরা লক্ষ্য করি যে, কবি জয়দেব প্রধানভাবে সংগীত-প্রকৃতির নির্দেশ দিয়ে যেভাবে সকল গানের প্রবন্ধরূপ ও বিচিত্র রাগরূপের উল্লেখ করেছেন–সেই সংকেতের পূর্ণপরিচয় দিয়েছেন রাণা কুম্ভা “রসিকপ্রিয়া” টীকায় ৷ “গীতগোবিন্দ”-পদগান যদি সত্যই রাখালী নাটগীতি বা যাত্রার পূর্বসূত্র নাটগীতি অথবা অপেরা হত তাহলে তাতে শাস্ত্রনির্দিষ্ট অভিজাত তথা ক্ল্যাসিক্যাল পর্যায়ের রাগ, তাল ও প্রবন্ধ -নির্বাচনের কোন সার্থকতাই থাকত না এবং সেই সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করবো কীর্তনে রাগ ও তালের বিশ্লেষণপ্রসঙ্গে ৷ অবশ্য গীতিরস ও সাহিত্যরস-আবেদনের দিক থেকে অনেকে গীতিগোবিন্দকে গীতিরসার্দ্র “আখ্যানকাব্য” বলে সিদ্ধান্ত করেন এবং সে সিদ্ধান্ত সাহিত্যের রূপ ও রসদৃষ্টির দিক থেকে কিছুটা সত্য৷ মনে হয়, “গীতগোবিন্দ”- পদগানের গোত্র বা পর্যায়-নির্ধারণব্যাপারে কেবলই রস ও ছন্দানুবিদ্ধ সাহিত্যদৃষ্টি কিংবা সংগীতদৃষ্টি নিয়ে বিচার না করে সামগ্রিকভাবে এবং বিশেষ করে এর আনুসঙ্গিক অথবা অপরিহার্য সহায়কসামগ্রী শাস্ত্রীয় প্রবন্ধ, রাগ ও তাল-সম্পৃক্ত পদসাহিত্য, আখ্যান ও নৃত্যরূপেরই বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন৷
এবার “গীতগোবিন্দ”-পদগানসম্পৃক্ত রাগ ও তালের কিছুটা আলোচনা এবং সঙ্গে সঙ্গে পদগানগুলির প্রবন্ধরূপ কি তাদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করি৷ পূর্বেই বলেছি যে, গীতগোবিন্দ-পদগান “প্রবন্ধশ্রেণীর গান”৷ যেমন, প্রথম সর্গের দ্বিতীয় গান ঃ “বাগ্‌দেগবতাচরিতচিত্রিতসদ্মা পদ্মাবতীচরণ চক্রবর্তী” প্রভৃতি পদের ব্যাখ্যায় পূজারী গোস্বামী বলেছেন ঃ “এতৎ শ্রীগীতগোবিন্দাখ্য প্রবন্ধং প্রকর্ষেণ বাধ্যতে শ্রোতৃণাং হৃদয়মস্মিন্নিতি প্রবন্ধস্তং করোতি প্রকাশয়তি৷” রসমঞ্জরীকার শঙ্কর মিশ্র বলেছেন ঃ “জয়দেবকবিরেতং গীতগোবিন্দাখ্যং প্রবন্ধং করোতি৷” রসিকপ্রিয়া-টীকায় রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “কবিবিদানীং * * শৃঙ্গারোত্তর প্রবন্ধং কর্তুং প্রতিজানীতে –বাগ্‌দেবতেতি৷ জয়দেব-কবিবেতং গীতগোবিন্দাভিধং প্রবন্ধং করোতি ৷” অবশ্য এই সমস্ত টীকা বা ভাষ্যসিদ্ধান্ত কবি জয়দেবের “শ্রীবাসুদেবরতিকেলিকথাসমেতমেতং করোতি জয়দেবকবিঃ প্রবন্ধম্‌” পদাংশকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে৷ প্রবন্ধের পরিচয় দিয়ে ভোজদেব বলেছেন ,
শৃঙ্গাবৈকপ্রধানো যো গীততালাদিসংযুতঃ ৷
অভিসারার্থনিপুণঃ প্রবন্ধঃ স প্রকীর্তিতঃ ৷৷
গীত অর্থে এখানে রাগ৷ তালযুক্ত হবে শৃঙ্গাররসাত্মক পদ এবং সে পদাভিপ্রায় হবে অভিসারপ্রধান৷ “অভিপ্রায়”-শব্দে প্রয়োগ বুঝতে হবে৷ সংগীতশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, প্রকৃষ্টরূপে গান বা গীত পদবদ্ধ অর্থাৎ রাগ, তাল, পাট, ধাতু, অঙ্গ প্রভৃতি দ্বারা সম্বন্ধ (বন্ধ ও বন্ধ একার্থক) হলে তাকে “প্রবন্ধ” বলে৷ সুতরাং এই “প্রবন্ধ”-শব্দ থেকে আমরা বুঝি যে, গীতগোবিন্দ বা অষ্টপদীগান রাগ, তাল,অঙ্গ, ধাতু প্রভৃতি সমন্বিত হয়ে রূপায়িত হওয়া উচিত৷ গীতগোবিন্দের ভাষ্য ও টীকাকারদের মধ্যে মনে হয় একমাত্র সংগীতশাস্ত্রবিদ্‌ ( রসিকপ্রিয়ার সূচনাশ্লোকে রাণা কুম্ভা নিজেই বলেছেন ঃ “নত্বা মতঙ্গভবতপ্রমুখানাং সুগীতসংগীতশাস্ত্রনিপুণাঞ্জযদেববাচম্‌” এই থেকে জয়দেবের সংগীত -কুশলতার পরিচয়দানের সঙ্গে সঙ্গে রাণা কুম্ভা নিজের সংগীতশাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন বুঝতে হবে৷ ) রাণা কুম্ভাই রাগ, তাল ও প্রবন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কলা, রীতি, ছন্দ, লয়, অলঙ্কার ও বৃত্তিযুক্ত নাট্যগীতিরূপের সবিশেষ পরিচয় দিয়েছেন৷ যেমন, জয়দেবের সূচনাগীতি “মেঘৈর্মেদুরম্ববং বনভুবঃ * * যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ” এই প্রথম পদ বা গানের রাগ, তাল, বৃত্তি, কলা প্রভৃতির পরিচয় দিয়ে রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “গমকালাপপেশলতায়া মধ্যমগ্রামে ষাড়বেন মধ্যমগৃহেণ মধ্যমাদিরাগেণ গীয়তে * * * শৃঙ্গারাবস্থানসূচিকা কৌশিকীবৃত্তিঃ৷ সংভাবিতা গীতিঃ৷ তস্যাশ্চ লক্ষণম্‌ –“সম্‌ভাবিতা ভূরিগুরুর্দ্বিকলা বার্তিকে পথি৷ ( এই সম্বন্ধে সংগীত-রত্নাকর ১৷৮৷১৯ শ্লোক দ্রষ্টব্য৷ সিংহভূপাল ও কল্লিনাথ টীকায় বিশদভাবে সম্‌ভাবিতাগীতির পরিচয় দিয়েছেন ব্রহ্মগীতির পর৷ সম্‌ভাবিতাগীতি গ্রামরাগের সংযোগে বিশেষভাবে প্রাচীনকালে গান করা হত৷) মধ্যে লয়ঃ ৷ প্রসাদো গুণঃ৷ অনুকূলো নায়কঃ, স্বাধীনপতিকা নায়িকা৷ পূবার্ধেঽভিলাষলক্ষণো বিপ্রলম্ভঃ৷ অপরার্ধে সংভোগশ্চ শৃঙ্গারঃ৷ * * শাদুলবিক্রীড়িত ছন্দঃ ৷” এখানে প্রথম পদগান-সম্পর্কে রাণা কুম্ভা যে বলেছেন “সম্ভাবিতা গীতিঃ”, শার্ঙ্গদেবও সংগীত-রত্নাকরে সে প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “* * দ্বিরাবৃত্তপদাং পরে৷ সংক্ষেপিতপদা ভূরিগুরুং সম্‌ভাবিতা মতা৷৷” টীকাকার কল্লিনাথ ও সিংহভূপাল দুইজনেই এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন৷ প্রাচীন সংগীতগাস্ত্রী মতঙ্গও সম্ভাবিতাব পরিচয় দিয়ে বলেছেনঃ “সংক্ষিপ্তত সম্‌ভাব্যতে পদানাং যত্র সা সম্‌ভাবিতা৷” মতঙ্গের এই উদ্ধৃতিবাক্য দিয়েছেন কল্লিনাথ তাঁর টীকায়৷ সিংভূপাল এর অর্থ-বিশ্লেষণ করে বলেছেন ঃ “দ্বিরাবৃত্তে পদান্তরে যস্যাং সা সংক্ষেপিতপদা বহুগুরুযুতা সম্‌ভাবিতা গীতিঃ ৷ প্রথমকলায়াং চত্বারি পদানি গীত্বা ভক্ত্যা দেবং রুদ্রং বন্দ ইতি, দ্বিতীয়কলায়াং মধ্যস্থং পদদ্বয়ং দ্বির্গীয়তে দেবং দেবং রুদ্রঃ রুদ্রমিতি, তৃতীয়কলায়াং প্রথমকলাবদ্‌ ভক্ত্যা দেবং রুদ্রং বন্দ ইতি ৷” শার্ঙ্গদেব এর গীতি ও স্বর-রূপের উল্লেখ করেছেন এভাবে —
ধা মা মা বি গা ৷ বা গা সা সা
ভ ০ ক্ত্যা ০ ০ ৷ দে ০ বং ০
নী ধা সা নী ৷ ধা নী মা মা
রু ০ দ্রং ০ ৷ বন ০ দে ০

সেইরকম গীতগোবিন্দের “মেঘৈর্মেদুবমম্ববং বনভূবঃ”- প্রভৃতি পদ প্রথম কলায় চারটি পদের সমাবেশ থাকবে,দ্বিতীয়কলায় মধ্যকার দুটি পদের দুইবার আবৃত্তি এবং তৃতীয় কলায় প্রথম কলার মতো চারটি পদের সমাবেশ থাকবে৷ সম্ভাবতাগীতির ব্রহ্মগীতির মতো গ্রামরাগসম্পৃক্ত হয়ে গীত হোত স্বাধীনভাবে অথবা ধ্রুবাগীতির সঙ্গে৷ সংগীতশাস্ত্রবিদ্‌ রাণা কুম্ভা এই তত্ত্ব জানতেন, সেজন্য তিনি গীতিগোবিন্দের শাস্ত্রীয় গীতিরূপের এই ভাবে পরিচয় দিয়েছেন৷ সুতরাং গীতগোবিন্দের প্রতিটি পদের প্রবন্ধ এবং সঙ্গীত-রূপ লক্ষ্য করার বিষয়৷ রাগ, তাল, লয় প্রভৃতিকে বাদ দিয়ে গীতগোবিন্দগান অর্থহীন ৷ তাছাড়া নৃত্য ও নাট্যরূপ এর স্বতন্ত্র৷ সুতরাং এই সকল দিক থেকে “গীতগোবিন্দের গোত্র ও রূপ নির্ণয় করা সমীচীন ৷
বিশেষ করে “গীতগোবিন্দ”-পদগানের রাগ ও তাল-সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে বলে রাখা সমীচীন যে, রাগনামের ও তালনামের ব্যাপারে পূজারী গোস্বামী ও অন্যান্য টীকা ও ভাষ্যকাররা একমত হলেও রাণা কুম্ভা “রসিকপ্রিয়া”-টীকায় স্বাধীনভাবে একটি বিশ্লেষণরীতির উপস্থাপন করেছেন৷ তাঁর বাগনাম ও তালনামের কোন কোন অংশে অপরাপর টীকাকারদের সঙ্গে মিল থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পৃথক ও নূতন৷ নির্ণয়সাগর-প্রেস থেকে প্রকাশিত গীতগোবিন্দের (১৯৪৯ খ্রীঃ) পরিশিষ্টে দীপিকা, রসমঞ্জরী, রসিকপ্রিয়া, পদদ্যোতনিকা, বালবোধিনী ও সঞ্জীবিনী এই ছটি টীকার সমাবেশ করে তাদের মধ্যে রাগনাম ও তালনামের মধ্যে একটি ঐক্য ও অনৈক্য মতের তালিকার উল্লেখ করা হয়েছে৷ সেই বিশ্লেষণী তালিকা থেকে জানা যায় যে, রাগনামে ও তালনামে ছটি টীকার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মোটামুটিভাবে তারা এক৷ কিন্তু কার্যতঃ তা নয় বলেই আমাদের ধারণা হয় একমাত্র “রসিকপ্রিয়া”-টীকার প্রমাণ থেকে৷ কেননা উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, প্রথম অষ্টপদী “মালবগৌড়রাগেণ রূপক তালেন গীযতে” এই রূপকতালে ও মালবগৌড়রাগে গান করার বিধি আছে যেখানে মূলে, সেখানে রসিকপ্রিয়াকার রাণা কুম্ভা মূলানুসারে “মালবরাগেণ–প্রলয়েতি” শব্দ ব্যবহার করেও “প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্‌” (গমক, আলাপ মধ্যমগ্রাম (গ্রাম তিনটি –ষড়্‌জ, মধ্যম ও গান্ধার), মধ্যমগ্রহ অর্থে মধ্যমস্বরে গানের বা পদের আরম্ভ, মধ্যমাদি বা মধুমাধবীরাগ, ষাড়ব অর্থাৎ ঐ রাগে ছটি মাত্র স্বরের সমাবেশ৷ কিন্তু মধ্যমাদি, মধুমাবতী বা মধুমাধবী রাগের প্রাচীন রূপ ঔড়ব অর্থাৎ পাঁচটি স্বরের সমাবেশ এবং মধ্যমাদি ভৈরবরাগের প্রথম রাগিণী৷ মধ্যম গ্রহ (মধ্যমস্বরে আরন্ত) এবং ঋষভ-ধৈবত-বর্জিত৷ বর্তমান হিন্দুস্তানী পদ্ধতিতে মধ্যমাদি বা মধ্যমাধবীতে গান্ধার ও ধৈবত-বর্জিত, সুতরাং ঔড়ব (স রি ম প নি-কোমল)৷ দুটি কল বিশিষ্ট বার্তিক (লয়েরই সামিল) এবং মধ্যলষে গীত হবে৷) প্রভৃতি পদগানকে “কীর্তিধবল-ছন্দ” এই অভিধা দিয়ে আদিতালে, বিলম্বিতলয়ে ও মধ্যমাদি তথা মধুমাধবীরাগে গান করার নির্দেশ দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন ঃ “অত্র প্রলয়পয়োধীত্যাদ্যেকাদশস্বপি পদেষু (“প্রলয়পয়োধিজলে”……১৷ থেকে “কেশব স্কৃতদশবিধরূপ জয় জগদীশ হরে” এই ১১শ পদ পর্যন্ত কীর্তিধবল-ছন্দ৷ ) কীর্তিধবলং নাম ছন্দঃ। তল্লক্ষণং যথা — “অযুজি পদে দ্বাদশৈব যুজি তু যস্য হি দশ বাষ্ট মাত্রাশ্চেৎ। পরমপি পদযুগমেবং তং কীর্তিধবলমিহ ধীবাঃ প্রাহুঃ ৷৷ * * “ছন্দসা কীর্তিপূর্বেন ধরলেন বিনির্মিতঃ ৷ পদান্তভোগরুচিবস্ততঃ পাটম্বরাঞ্চিতঃ৷৷ দশাবতারকীর্ত্যাভ্যো ধবলোঽয়” প্রবন্ধরাট্‌ ৷ বাগোঽত্র মধ্যমাদিঃ স্যাদাদিতালো বিলম্বিতঃ ৷৷ লয়ঃ স্যান্মাগধী বীতিঃ শৃঙ্গারোঽত্র রসঃ স্মৃতঃ ৷ কীর্তন বাসুদেবস্য বিনিয়োগো নৃত্যোৎসবে”৷৷” “সংগীতরাজ”-গ্রন্থ রচয়িতা সংগীতকুশল রাণা কুম্ভা এই প্রবন্ধের নামকরণ করেছেন “কীর্তিধবলপ্রবন্ধ”৷ ত্রয়োদশ শতকের সংগীতশাস্ত্রী শার্ঙ্গদেব “সংগীত-রত্নাকর”-গ্রন্থে চতুর্থ প্রবন্ধাধ্যায়ে বিচিত্র প্রবন্ধের পরিচয়প্রসঙ্গে “করণ”-প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন এবং মঙ্গল, আনন্দবর্ধন, কীর্তিলহরী বা কীর্তিপূর্বিকালহরী এই প্রবন্ধ তিনটিকে করণপ্রবন্ধের অন্তর্গত বলেছেন৷ টীকাকার সিংহভূপাল কীর্তিলহরী প্রবন্ধের পরিচয়প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “যস্তু ধ্রুবস্যাধস্থানে উদ্‌গ্রাহদ্বিতীয়ার্ধগীয়তে অন্যল্লক্ষণমানন্দবর্ধনবত্তদা কীর্তিলহরী৷” (সংগীত-রত্নাকর ৪৷১৪২, ১৪৫) ৷ ধবলপ্রবন্ধ-সম্পর্কে শার্ঙ্গদেব বলেছেন ঃ “আশীর্ভির্ধবলো গেয়ো ধবলাদিপদান্বিতঃ৷ যদ্দৃচ্ছয়া বা ধবলো গেয়ো লোকসিদ্ধিতঃ ৷৷ (সংগীত-রত্নাকর ৪৷৩০২) ধবলপ্রবন্ধ আবার তিন শ্রেণীর –কীর্তিধবল, বিজয়ধবল ও বিক্রমধবল ৷৷ রাণা কুম্ভা পূর্বোক্ত কীর্তি বা কীর্তিলহরী প্রবন্ধের কথা বলেন নি, বলেছেন ধবলশ্রেণীর “কীর্তিধবল”-প্রবন্ধের কথা৷ “কীর্তিধবল”-প্রবন্ধের পরিচয় দিয়ে টীকাকার সিংহভূপাল বলেছেন ঃ “বিষমে প্রথমে তৃতীয়ে চ চরণে ছগণঃ ছগণদ্বয়ম্‌ সমে দ্বিতীয়ে চতুর্থে চ চরণে তগণঃ দগণো বাধিকঃ, তদা কীর্তিধবলঃ৷” “তদা স্যাং কীর্তিধবলো”” বোলে শার্ঙ্গদেব কীর্তিধবল-প্রবন্ধের পরিচয় দিয়েছেন৷ এই প্রবন্ধে চারটি চরণ থাকে, দুইটি বিষম ও দুটি সম-চরণ৷ দুটি বিষম-চরণে অর্থাৎ প্রথম ও তৃতীয় চরণে দুটি করে ছ-গণ থাকে, আর সম-চরণে অর্থাৎ দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে তা ছাড়া ত-গণ বা দ-গণ থাকে৷ সুতরাং বিষম-চরণে দুটি ছ-গণ থাকলে মোট বারোটি মাত্রার সমষ্টি এবং সম-চরণে সঙ্গে ত-গণ, সুতরাং আরো তিনটি মাত্রা তার সঙ্গে যুক্ত হলে পণেরো মাত্রার সমষ্টি হয়, আর দ-গণ তাতে সংযুক্ত হোলে মাত্রা সংখ্যা হয় চৌদ্দ৷ (এই সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ কল্লিনাথ ও সিংহভূপালের টীকা দ্রষ্টব্য ৷)
এভাবে রাণা কুম্ভা “গীতগোবিন্দ”-পদগানের পদগুলিতে শাস্ত্রীয় অভিজাত তথা ক্ল্যাসিক্যাল রাগ, তাল, প্রবন্ধ প্রভৃতির সমাবেশের উল্লেখ করেছেন৷ এর পরে আমরা সমস্তগুলি রাগ, তাল ও প্রবন্ধের এবং সঙ্গে সঙ্গে পদসাহিত্যের বৃত্তি, রীতি, অলংকার প্রভৃতির আলোচনা করবো, কেননা পরবর্তী পদাবলী কীর্তনের অঙ্গাভরণরূপেও এগুলি গৃহীত হয়েছে৷