কিন্তু বিদ্যাপতির রচনাশৈলীর প্রত্যক্ষ প্রভাবের উদাহরণ বাংলার বিখ্যাত কবিরা এবং প্রারম্ভিক অবস্থায় বাংলা সাহিত্যকে বিদ্যাপতির রচনাধারা সমৃদ্ধতর করে তুলেছিল৷ বাংলায় বিদ্যাপতির জীবনালেখ্য বস্তুত এক রমন্যাস৷ দীর্ঘকাল ধরেই মিথিলার সঙ্গে বাংলার সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ ছিল এবং এই সময়েই বিদ্বৎসমাজ জ্ঞান বর্ধনের ও পরিমার্জনের উদ্দেশে মিথিলার বহুল খ্যাতিমান শিক্ষকসমাজের সংসর্গে আসতে শুরু করেন৷
প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁদের কণ্ঠে অনুরণিত হত বিদ্যাপতির পদাবলী৷ চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুগামীদের কাছে এই গীত ছিল দিব্যোন্মাদনার প্রতীক কারণ সহজিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাবে তাঁরা দেহজ প্রেমকে অধ্যাত্মপ্রেমের রূপে কল্পনা করতে প্রয়াসী হন৷ চৈতন্য সম্প্রদায়ের কাছে বিদ্যাপতির প্রেমপদাবলী ভক্তিগীতির মর্যাদা পায় এবং বিদ্যাপতি ‘বৈষ্ণব মহাজন’ (বাঙালী বৈষ্ণবমতের এক মহান প্রবর্তক) আখ্যা পান৷ কীর্তন ছিল এই নবীন সম্প্রদায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং বহু গীতিকার বিদ্যাপতির অনুকরণে কীর্তনাঙ্গের গান রচনা করতে শুরু করেন৷ এই অনুকরণকালে তাঁরা বিদ্যাপতির ভাষারও পূর্ণ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন এবং যেহেতু এঁরা শুদ্ধ মৈথিলী ভাষা লিখতে সক্ষম ছিলেন না, তাই মৈথিলী ও বাংলার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ সৃষ্ট হয় যা পরবর্তীকালে ‘ব্রজবুলি’ হিসেবে বিখ্যাত৷ চৈতন্যদেবের অনুগামীদের কাছে বিদ্যাপতি ছিলেন আদর্শস্বরূপ এবং ব্রজবুলি ছিল উৎকৃষ্ট কাব্যরচনার মাধ্যম৷ চৈতন্যসম্প্রদায় সম্প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাপতির পদাবলীও প্রচারিত হতে থাকে এবং এইভাবে উড়িষ্যা, আসাম ও সুদূর ব্রজভূমিতেও প্রসিদ্ধিলাভ করে। সর্বত্র বিদ্যাপতি দিব্য প্রেমের এক মহান প্রবর্তক হিসেবে সম্মান লাভ করেন এবং তাঁর পদাবলী ভক্তিগীত রচনার পথপ্রবর্তক স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়৷ পশ্চিমবঙ্গেও বিদ্যাপতি এই সম্প্রদায় নেতারূপে সম্মানলাভ করেন, বহু লোকই তাঁকে বাঙালী বলে ভুল করে এবং বহু কবি পদের মর্যাদাবৃদ্ধির আশায় নিজেদের পদের শেষে বিদ্যাপতির নাম সংযোজন করতে শুরু করেন৷ অন্তত একজন কবির সন্ধান তো পাওয়াই যায় যিনি সবগুলি রচনাতেই বিদ্যাপতির নাম ব্যবহার করেছেন৷ ব্রজবুলি সাহিত্য যথেষ্ট বিশাল এবং এটি ভারতীয় সাহিত্যের গৌরব এবং যখনই আমরা স্মরণ করি যে ব্রজবুলি হল মিথিলার ভাষা বা মিথিলায় জাত মৈথিলী ভাষার অনুরাগীদের ভাষা এবং এটি বিদ্যাপতির কাব্যের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগসঞ্জাত , তখনই আমরা বিদ্যাপতির প্রতিভার সার্থক মূল্যায়নে সক্ষম হই৷
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য আর একটি বিষয় হল বিদ্যাপতি রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর কাব্যজীবনের প্রারম্ভে প্রভাবিত করেছিলেন এবং ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ, যাকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘অনুকৃতি মৈথিলী’ আখ্যা দিয়েছেন৷ এইভাবে বিদ্যাপতির যুগ মিথিলা ও বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত৷
অসমে মহান শংকরদেব ও তাঁর শিষ্য মাধবদেব বিদ্যাপতির প্রত্যক্ষ প্রভাবে মৈথিলীতে সাহিত্য রচনা করেন এবং যদিও তাঁদের রচনার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল মনোরঞ্জক নাটকের মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব মতের প্রবর্তন, তাঁদের মূল প্রেরণা ছিলেন বিদ্যাপতি যিনি সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ মানুষের ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিলেন৷
কথ্য ভাষাতে কাব্যের আনন্দ ব্যক্ত ও সঞ্চারিত করার প্রতিভা এতই জনপ্রিয় হয় এবং কাব্যের অভিব্যক্তিরূপে সুরসমৃদ্ধ গীতের রচনাশৈলী এতই মোহময় হয যে বিদ্যাপতির কাব্যের রচনাশৈলী আমাদের অধিকাংশ মহান কবিরা পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে অনুসরণ করে গেছেন এবং তাঁদের মধ্যে সুরদাস, মীরা, তুলসীদাস ও কবীরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদ্যাপতির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন৷

মিথিলার নবজাগরণের ইতিহাসে বিদ্যাপতি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র৷ তিনি জীবিকার জন্য কবিতা রচনা করেননি৷ তাঁর জীবন ছিল বহুমুখী, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত উদার, বিচারক্ষমতা ছিল যুগের তুলনায় অনেক বেশী আধুনিক ৷
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে তাঁর পরবর্তী বেশ কয়েক শতক ধরে মিথিলায় সাংস্কৃতিক অধঃপতন ঘটেছে৷ ফলস্বরূপ ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যাপতির রূপ এবং তাঁর মতাদর্শ লোকে বিস্মৃত হয়েছে এবং তিনি পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তীতে, উপাখ্যানের নায়কে৷ কিন্তু যেদিন থেকে তিনি নিজের চারিদিকের মানুষজনের জন্য সুরসমৃদ্ধ পদাবলী রচনা করেছেন, তখন থেকে একদিনের জন্যও তাঁর কবিযশ ক্ষুণ্ণ হয়নি৷ বিদ্যাপতি এখনও জীবিত আছেন কবিরূপে এবং জীবিত থাকবেনও কবিরূপেই৷ তিনি ভারতীয় সাহিত্যের এক মহান রূপকার এবং ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে এই পরিচয়েই অমর হয়ে থাকবেন৷